শুজা রশীদ : (পর্ব ৬৬)
ডেমিয়েনের প্রশ্নের উত্তরে রিমা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল। আগের রাতে পিন্টুর বাসায় পুলিশ এসেছিল। পিন্টু তার কথামত ব্যাপারটা সুন্দরভাবে সামাল দিয়েছিল। রিমার বিরুদ্ধে কোন কেস ফাইল করেনি। বলেছে ইন্সিউরেন্স ক্লেইমও করবে না। সব গাড়িগুলো ও নিজের খরচে পরিচিত এক মেকানিকের কাছ থেকে সারাই করিয়ে নেবে। ক্লেইম করলে রিমার ইন্সিউরেন্স বেড়ে কোথায় যেত কে জানে। এতো কিছুর পর ডেমিয়েনের কাছে সন্দেহভাজন হিসাবে পিন্টুর নাম উল্লেখ করতে ওর মন সায় দিল না। প্রথমে যদিও ওর মনে হয়েছিল পিন্টু ছাড়া আর কারো পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব নয়, মরিয়মের সাথে একাকী কথা বলার পর ওর মত পালটে গেছে। মরিয়মকে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। আহমেদ পরিবার বর্তমানে বিশাল একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এই অবস্থায় এই জাতীয় একটা অচিন্তনীয় কাজ পিন্টু কখনই করবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে যদি না করে থাকে তাহলে করলটা কে?
কালাম? তাকে আর দোলনকে ওর বাড়ি থেকে বের করে দেবার জন্য রিমার উপর অনেক ক্ষেপে ছিল সে কিন্তু তাই বলে এমন ভয়াবহ একটা কাজ কি সে করতে পারবে?
আবুল? দোলনকে ওর বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে দেখে ভীষণ রেগে গিয়েছিল সেও। কিন্তু তার মত একজন মানুষের কি সেই মন-মানসিকতা কিংবা মনবল আছে এই জাতীয় একটা ভয়ানক কাজ করার?
আর কে করতে পারে?
দেলোয়ার? সে কি রিমার জীবনটাকে দূর্বিষহ করে দেবার জন্য কাউকে দিয়ে কাজটা করাতে পারে? তার অবশ্য একটা গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বাচ্চাদের কাসটোডি পেতে চাইলে কোর্টে রিমার সাথে তাদের একই বাসায় থাকাটা বিপদজনক বলে দেখানোর চেষ্টা করতে পারে সে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাচ্চারা বাসার ভেতরে থাকা অবস্থায় সে কেন বাড়ীতে আগুন লাগাতে বলবে?
“মিসেস আহমেদ?” ডেমিয়েন ডাকল। “তুমি অনেক্ষণ ধরে কি যেন ভাবছ। কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?”
রিমা মাথা নাড়ল। “নাহ। সন্দেহভাজন কারো কথাই মাথায় আসছে না।”
“এই পর্যায়ে আমার উল্লেখ করা প্রয়োজন ডিটেকটিভ মার্সেল নিজেই যেঁচে পড়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। সে আমাকে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে।” ডেমিয়েন ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। “তুমি কাল রাতে পিন্টুর বাসায় গিয়েছিলে আমি জানি।” সে অর্থবহুল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল কিন্তু বিস্তারিত কিছু বলল না। “সেখানে যাই ঘটে থাকুক তাতে আমার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু তোমার কি মনে হয় পিন্টুর এই আগুণ ধরানোর ব্যাপারে হাত থাকতে পারে?”
“না, আমার মনে হয় না,“ রিমা একটু দ্বিধা করে বলে। “পিন্টু এমন কাজ কখন করবে না।”
“সে তো অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারে, তাই না?” ডেমিয়েন বলল।
“অসম্ভব নয় কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না,” রিমা বলল। মুখে যাই বলুক অতি সামান্য হলেও মনে মনে এখনও পিন্টুর প্রতি ওর সন্দেহ কিছুটা রয়েই যায়।
ডেমিয়েন নোটবুকে কিছু একটা লিখল। “আমার সন্দেহভাজনদের লিস্টে তার নাম আগেই ছিল। অন্য কাউকে তোমার সন্দেহ হয়? ভালো করে ভেবে বল।”
রিমা না সূচক মাথা নাড়ল। কালাম, আবুল কিংবা দেলোয়ারের নাম ও দিতে চায় না। তাদের নাম পেলে ডেমিয়েন কি করবে কে জানে। আগুন কে ধরিয়েছে সেটা ডেমিয়েনের নিজকেই বের করতে হবে। চারদিকে সেকিউরিটি ক্যামেরা বসানো। তাদের কোন একটাতে কিছু না কিছু ধরা পড়ার কথা।
ডেমিয়েন মনে হল ওর মনের কথা পড়তে পারল। “তোমার দোকানের বাইরের সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা থেকে কিছু ছবি পেয়েছি। পেছনের গলি থেকে একটা লোক হাতে একটা তেলের গ্যালন নিয়ে হেঁটে এসে তোমার দোকানের এক পাশের দেয়ালে তেল ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। লোকটাকে আমরা খুঁজে পেয়েছি। মাঝ বয়েসী ভবঘুরে। বলেছে এক লোক নাকি মুখোশ পরে এসেছিল ওর সাথে কথা বলতে। ওর হাতে দুই শ ডলার গছিয়ে দেয়, আর একটা কাগজের টুকরো দেয়। তাতে টাইপ করে লেখা ছিল কি করতে হবে। অন্ধকারে ও লোকটাকে ভালো করে দেখতেও পারেনি। ভবঘুরের জন্য দুই শ ডলার অনেক টাকা। মুখোশধারী লোকটা নোটটা পুড়িয়ে ফেলে। সুতরাং, ভবঘুরের মুখের কথা ছাড়া আপাতত আর কিছুই আমদের হাতে নেই। কিন্তু সে পুলিশের কাস্টোডিতে আছে। আশা করছি একটু চাপাচাপি করলে হয়ত আরোও কিছু মনে পড়বে তার।
“যাইহোক, এইবার আসি তোমার বাড়ীর প্রসঙ্গে। ঐ রাস্তায় কয়েকটা বাড়ীতে সেকিউরিটি ক্যামেরা আছে। সেগুলো চেক করে দেখেছি ঐ দিন রাত বারোটার দিকে একটা সন্দেহজনক গাড়ি তোমার বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল। গাড়িটার নাম্বার প্লেট পেয়েছি আমরা। একটা রেন্টাল কম্পানির গাড়ি। লোকটা প্রফেশনাল নয় সেটা বোঝাই যায়। প্রফেশনাল হলে গাড়ি ভাড়া না করে চুরি করত। যাইহোক, রেন্টাল কম্পানীটা খুঁজে পেতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। লোকটা ভুয়া নাম ব্যবহার করলেও তার চেহারার বর্ণনা থেকে তার হদিস আমরা বের করে ফেলেছি। তার নাম হচ্ছে জাহান আলী। সে একসময় মিঃ পিন্টুর রেস্টুরেন্টে কাজ করত। ডিটেকটিভ মার্সেলের কাছ থেকেই জেনেছি। তুমি কি জাহান আলী বলে কাউকে চেন?”
রিমা মাথা নাড়ল। “না। নামই শুনি নি কখন। কিন্তু পিন্টুদের রেস্টুরেন্টে আমি কখন যাইনি।”
“আমার কাছে তার ছবি আছে। দেখ চিনতে পারো কিনা।” সে রিমাকে জাহানের একটা রঙিন প্রিন্টেড ছবি দেখাল। “ইন্টারনেট থেকে পেয়েছি। ওকে খুঁজতে ওর বাসায় গিয়েছিলাম। পাই নি। আশা করছি ওকে খুঁজে পেলে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবো।”
রিমা ছবিটা মনযোগ দিয়ে দেখল। নাহ, এই লোকটাকে সে কখন দেখেনি।
ডেমিয়েন ছবিটা তার ফাইলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। “আমি তার ফোন রেকর্ড চেক করেছি। মিস্টার পিন্টুর কাছ থেকে বেশ কয়েক সপ্তাহ সে কোন ফোন কল বা মেসেজ পায়নি। তবে তাদের অন্য কোন যোগাযোগের মাধ্যম থাকতে পারে। আমি অন্য যাদের সাথে গত কয়েক দিনে তার যোগাযোগ হয়েছে তাদের সবার সাথে আলাপ করবার চেষ্টা করছি। এই রহস্যের সমাধান আমি করেই ছাড়ব। তবে তোমার বাড়ীর ইন্সিউরেন্স নিয়ে কোন সমস্যা হবার কোন কারণ নেই।”
রিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এমন একটা জঘন্য কাজ কে করতে পারে সেটা ও নিশ্চয় জানতে চায় কিন্তু তার চেয়েও বেশী যেটা চায় সেটা হচ্ছে আবার সব কিছু আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে। ডেমিয়েন অল্প কিছুক্ষণ পরেই বিদায় নিল। যাবার আগে বলে গেল নতুন কোন তথ্য পেলে সে রিমাকে জানাবে।
রিমা নোমানকে ফোন দিল। কাছেই একটা পার্কে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল সে। সেখানে জিব্রান ফুটবল খেলেছে তার সাথে আর ফায়জা তুলেছে বুনো ফুল। রিমা আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে চায়। যেখানেই থাকুক আর যাই করুক ওর মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ ঘুরছে রবিনের কথা। একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে নিথর শুয়ে আছে ছেলেটা। দুঃখ, বেদনা এবং অপরাধ বোধ রিমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
১০৩
মাংসের সেকশনে কাজ করতে জাহানের একেবারেই ভালো লাগে না। কিন্তু আপাতত না করেও উপায় নেই। মানিক এবং শেফালী যে তাকে এই কাজটা দিয়েছে তাতেই তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। খুব সম্ভবত পিন্টু তাদেরকে ব্যাক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিল কাজটা তাকে দেবার জন্য। কালামের সাথে মারপিট করে রেস্টুরেন্টের কাজটা হারানোর পর তার জীবন খুব একটা সুখময় ছিল না। রান্নায় তার কখনই তেমন দক্ষতা ছিল না। আহমেদ’স কিচেনে সে শুধুমাত্র দিনারের সহকারী হিসাবে কাজ করত। অন্য কোথাও কুক হিসাবে কাজ পেতে তার বেশ অসুবিধা হয়। অনেক খুঁজে পেতে যাওবা কিছু একটা পেয়েছে সেখানেও কোন না কোন ভাবে ঝুট ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। মাত্র কয়েক মাসে তিনবার কাজ পাল্টাতে হয় ওকে।
অবশেষে, নিরুপায় হয়ে পিন্টুর সাথে যোগাযোগ করে সে। সরাসরি নয়, দিনারের মাধ্যমে। রেস্টুরেন্টে ওর কাজটা ফিরিয়ে দেবার জন্য অনুনয় করে। পিন্টু সরাসরি নাকচ করে দেয় কিন্তু ঢাকা গ্রোসারীতে কাজটা পাবার ব্যবস্থা করে দেয়। কিছুদিন আগে মাংশের সেকশন থেকে কাজ ছেড়ে কালাম চলে যাবার ফলে সেখানে একটা শূন্যস্থান ছিল। শত্রুতা থাকলেও কালামের প্রতি ও খানিকটা কৃতজ্ঞতাই বোধ করে। সমস্যা একটাই। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে মাংশ কাটতে ওর ভয়ানক একঘেয়ে লাগে। রহমান এবং আখন্দÑ দুই জন মাঝবয়েসী লোক সেখানে বহুদিন ধরে কাজ করছে। তাদের মুখে কখন কোন অভিযোগ শোনে না ও। উজবুককা পাঁঠা!
রমজানের সময় দোকানের ব্যাস্ততা অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে মাংশের সেকশন ভীষণ ব্যাস্ত থাকে। ঘন্টা দুয়েক এক টানা কাজ করে জাহান ওর সহকর্মিদেরকে বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে দোকানের বাইরে চলে এলো, দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আয়েস করে সিগ্রেট ধরাল। একটা জোর টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ঘন ধোঁয়া ছাড়ল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাস্তার লাইটগুলো একে একে জ্বলে উঠছে, হালকা ঝিরঝিরে একটা বাতাস ওর চোখে মুখে কোমল পরশ বুলিয়ে যায়। মনটা বেশ ভালো লাগছে ওর। পাশেই খাবারের দোকানগুলোতে মানুষেরা ভীড় করেছে রোজা ভাঙার জন্য; ইফতারির নানা ধরনের মজাদার খাবারের গন্ধে ওর মুখে লালা এসে যাচ্ছে। রোজা রাখার অভ্যাস ওর নেই কিন্তু ইফতারি খেতে খুব পছন্দ করে।
এই পর্যায়ে জাহানের কোন ধারনাই নেই যে ডেমিয়েন জনসন তার ছবি স্থানীয় প্রতিটা পুলিশ স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে রিমার বাড়ী এবং দোকানে আগুন লাগানোর প্রধান সন্দেহভাজন ব্যাক্তি হিসাবে। তার বাড়িতে তার খোঁজে মানুষ পাঠিয়েছিল ডেমিয়েন কিন্তু সেখানে কাউকে পায়নি। জাহানের স্ত্রী কাছেই একটা ডলার স্টোরে ফুল টাইম কাজ নিয়েছে। সেখানে সে রাত পর্যন্ত কাজ করে। তাদের বাচ্চা এক বান্ধবীর বাসায় থাকে। এক প্রতিবেশী পুলিশকে জানায় সে সেইদিন সকালেই জাহানকে দেখেছে। ডেমিয়েন ভয় পাচ্ছিল জাহান হয়ত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে। সে পুলিশকে অনুরোধ করেছিল জাহানকে খুঁজে বের করতে।
জাহান যখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মহা আয়েশে সিগ্রেট টানছে, ঠিক তখন অফিসার জাভেদ ওমর ড্যানফোর্থ এভেনিউ ধরে ধীরে ধীরে ড্রাইভ করে যাচ্ছিল, তার সতর্ক দৃষ্টি ফুটপথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ জনের উপর। এই হচ্ছে টরন্টোর বিখ্যাত ড্যানফোর্থ বাংলা পাড়া। এখানে জাহান কোথাও লুকিয়ে থাকলে অবাক হবার কিছুই থাকবে না। তার সেলফোনে জাহানের একটা ছবি আছে। ফুটপথে প্রচুর মানুষের ভীড় থাকলেও জাভেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি খুব সহজেই জাহানকে সনাক্ত করে ফেলল। নিশ্চিত হবার জন্য সেলফোন তুলে নিয়ে সে জাহানের ছবিটা আরেক বার দেখল। নাহ, ভুল হবার কোন কারণই নেই। মনে মনে বেশ সন্তুষ্টি অনুভব করল। রুটিন মাফিক কাজ করলেও মাঝে মাঝে যে চমৎকার ফল পাওয়া যায় এটা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
জাহানের ঠিক সামনে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে লাল-নীল বাতি জ্বালিয়ে দিল জাভেদ। ধীরে সুস্থে গাড়ি থেকে নামছিল, হঠাৎ লক্ষ্য করল জাহান তাকে দেখেই টর্পেডোর মত দৌড়াতে শুরু করেছে, ছুড়ে দেয়া তীরের মত দ্রæত দূরে সরে যাচ্ছে সে। চিন্তা করবার মত সময় ছিল না জাভেদের। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল। এমনটা যে হতে পারে সেটা তার বোঝা উচিৎ ছিল। দৌড়ে গাড়ীর ভেতরে ঢুকে এবার সাইরেন বাজিয়ে দিল সে। পিছু নিল জাহানের। সাইরেনের শব্দ শুনে চারদিকের গাড়ি সব থেমে যাওয়ায় জাহানকে ধরে ফেলতে তার কয়েকটা মুহুর্ত লাগার কথা। ড্যানফোর্থ এভেনিউয়ের পাশের ফুটপথ ধরে উন্মাদের মত ছুটছে জাহান, মানুষের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াচ্ছে, খিস্তি করে আবার ছুটছে, পিছু ফিরে ফিরে দেখছে পুলিশের গাড়িটা কোথায়।
জাভেদ ভেবেছিল সে জাহানকে পেরিয়ে গিয়ে তার সামনে গাড়ি থামিয়ে তাকে হাতেনাতে ধরবে। কাজ পরিকল্পনা মোতাবেকই হত যদি না এক মধ্য বয়েসী ভারতীয় মহিলা একটা সাইড রোড থেকে ভোঁস করে বেরিয়ে এসে ওর সামনের রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যেত। কড়া ব্রেক কষতে হল জাভেদকে। মহিলা নিজের ভুল বুঝতে পেরে এবং পুলিশের গাড়ি দেখে এতো ভকচকিয়ে গেল যে বোকার মত চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগল।
জাহান পিছু তাকিয়ে দেখল প্রায় শ’ খানেক ফুট পেছনে পুলিশের গাড়ীটা রাস্তায় ভীড়ে আটকে গেছে। সিদ্ধান্ত নিল রাস্তা পেরিয়ে অন্য পাশে চলে যাবার, তাহলে ঘুরে ওর পিছু নিতে সমস্যাই হবে পুলিশটার। একটা আউট-অফ-সার্ভিস বাস অন্য পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, একটু জোরেই ছুটছিল। বাসের ড্রাইভারের দৃষ্টি ছিল সামনের ছোটখাট যানযটের উপর। দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া ছুটন্ত শরীরটাকে একেবারেই লক্ষ্য করে নি সে। বাসের সাথে সংঘর্ষে ছিটকে প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে গিয়ে পড়ল জাহান। তার মাথা সজোরে ঠুকে গেল কংক্রিটের ফুটপথের সাথে। তৎক্ষণাৎ মারা গেল সে।
দুই দিকের যাবতীয় গাড়ি থামিয়ে অবশেষে অফিসার জাভেদ যখন জাহানের মৃত দেহের সামনে এসে দাঁড়াল ততক্ষণে প্রায় মিনিট দশেক পেরিয়ে গেছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। বেচারী অমন পাগলের মত দৌড়াচ্ছিল কেন? তবে কি সেই আগুনগুলো লাগিয়েছিল? একজন তরুণের কি করুন অপমৃত্যু!
রাত এগারোটার সময় ডেমিয়েনের ফোন পেল রিমা। ফায়জা এবং জিব্রানের সাথে হাসপাতালে ছিল ও তখন। নোমান ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে গেছে ওদের জন্য কিছু খাবার দাবার আনতে। হাসপাতালে ওদের তেমন কিছু করার না থাকলেও রবিনের কাছাকাছি থাকতে ভালোই লাগে। ডাক্তার এবং কয়েক জন নার্সের সাথে আলাপ হয়েছে। কেউই খুব উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু বলে নি। শারীরিকভাবে আগের চেয়ে কিঞ্চিৎ ভালো দেখালেও রবিনের জ্ঞান কখন কিংবা কবে ফিরবে বলার কোন উপায় নেই। এক ঘন্টা পরেও ফিরতে পারে, আবার মাস খানেক পরেও ফিরতে পারে।
জাহানের অকাল মৃত্যূর খবর শুনে মনে মনে থমকে গেলেও ওর প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ বুঝতে পারে না রিমা। পুলিশের হাতে ধরা না পড়ার জন্য লোকটা যখন অমন জান প্রাণ দিয়ে ছুটছিল তখন ধরেই নেয়া যায় আগুণ লাগানোর ব্যাপারে তার কোন না কোন ভুমিকা ছিল। কিন্তু সে কেন রিমার বাসায় আগুন দেবে? কিংবা ওর দোকানটা ধ্বংস করতে চাইবে? রিমাতো তো লোকটাকে চিনতও না। তারপর হঠাৎ ওর মনে পড়ল রেস্টূরেন্টে কালামের সাথে কারো মারপিট হবার কথা। তবে কি জাহানের সাথেই মারপিট হয়েছিল? ফলস্বরুপ রেস্টুরেন্টের কাজটা হারায় জাহান। হয়ত সেই জন্যেই রিমার উপর তার রাগ ছিল।
“এখন কি হবে?” ফায়ার মার্শালকে জিজ্ঞস করেছিল ও।
“তদন্ত চলেতে থাকবে,” ডেমিয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল। “লোকটার সাথে আলাপ করতে পারলে খুব ভালো হত। এই রহস্যের চাবি কাঠি তার হাতেই ছিল। আগুন সে ধরালেও হয়ত অন্য কারো নির্দেষে ধরিয়েছে। সত্যটা জানার দরকার ছিল। যাই হোক, তার ফোন রেকর্ড এখনও আমার কাছে আছে। ইদানীং আর কার কার সাথে তার কথা হয়েছে খুঁজে বের করব। অন্য কেউ এর সাথে জড়িত থাকলে ঠিকই বের করে ফেলব। তোমার যদি অন্য কোন কিছু মনে পড়ে থাকে আমাকে বলতে পারো।”
রিমার নতুন করে আর কিছুই বলার ছিল না। মার্সেলের বদান্যতায় ডেমিয়েন ইতিমধ্যেই জেনে গেছে জাহান রেস্টুরেন্টের কাজটা কেন হারিয়েছিল। মারপিটের ঘটনাটা নিয়ে বেশী আলাপ করতে চায় নি রিমা। কালাম অকারণে সমস্যায় পড়ে যেতে পারে। ওর একটা দৃঢ় বিশ্বাস আছে ওর উপর যত রাগই হোক না কেন কালাম কখন ওর এবং ওর সন্তানদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু আবার এটা ভেবেও খটকা লেগেছে যে রবিনকে দেখার জন্য একবারও হাসপাতালে আসে নি কালাম। কেন এলো না?
মরিয়ম এবং পিন্টু তাদের দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে এসেছিল। কয়েক ঘন্টা ছিল। রবিনের শরীর খারাপের কথা শুনে সেই যে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন নীতা তারপর আর বিছানা ছেড়ে এক রকম উঠতেও পারছেন না। লাট্টু বাসায় থেকে স্ত্রীর সেবা করছেন। পিন্টু ওকে কথা দিয়েছে সে তার সাধ্যমত চেষ্টা করবে রবিন যেন সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পায় সেটা নিশ্চিত করতে। হাসপাতালের বড় বড় কয়েকজন ডাক্তারের সাথে তার খুব জানাশোনা আছে। রিমার গাড়ী এখনও মেকানিকের কাছে। লোকটা আংটিটা খুঁজে পেয়েছে। পিন্টু জানিয়েছিল পরদিন গাড়ী এবং আংটিটা রিমার কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবাস্থা করবে সে। রিমা পিন্টু এবং মরিয়মকে ধন্যবাদ জানিয়ে ক্ষয় ক্ষতির পুরোটাই শোধ করে দেবার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল কিন্তু তারা দুই জনই সমবেত কন্ঠে যে কোন ধরণের ক্ষতি পুরণ নিতে অপরাগতা জানায়।
ডেমিয়েনের সাথে কথা শেষ হবার পর মরিয়মকে ফোন দিল রিমা, জাহানের করুণ পরিণতির কথা জানাল। মরিয়ম বলল সে ইতিমধ্যেই খবরটা পেয়েছে। তদন্তকারী অফিসারই ফোন করেছিল। জাহান যেহেতু পিন্টুদের রেস্টুরেন্টে বহু দিন কাজ করেছিল, সেইহেতু পিন্টুও পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। কিন্তু দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। পিন্টুর সাথে মাস খানেকের বেশী হয়ে গেছে জাহানের কোন যোগাযোগই ছিল না। শুনে রিমা স্বস্তি বোধ করেছে। আহমেদ পরিবারের সাথে নতুন গড়ে ওঠা বন্ধুত্বটূকু ও ভীষণ উপভোগ করছে। এই আগুণ ধরানোর ঘটনার সাথে পিন্টুর যেন কোন ভাবে কোন হাত না থাকে মনে মনে শুধু সেই প্রার্থনাই করছে ও।