শুজা রশীদ : (পর্ব ৬০)
ডোরবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল রিমার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুপর সাড়ে তিনটা বাজে। ফায়জা এবং জিব্রান গিয়েছিল ওদের বাবার সাথে দেখা করতে। তিন ঘন্টার উপরে হয়ে গেছে এখনও ফেরেনি। রবিন মেঝেতে ঘুমাচ্ছিল। ও তাকে তুলে সোফায় শুইয়ে দিয়ে গেল দরজা খুলতে। ফায়জার কাছে একটা চাবি থাকে। সে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রিমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “মা, আমরা সেই কতক্ষণ ধরে বাজাচ্ছি। তুমি শুনতে পাওনি?”
“ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম,” রিমা অপ্রতিভ কন্ঠে বলে। “আমি আর রবিন দু’জনাই। তোমাদের মিটিং ঠিকঠাক মত হয়েছে?”
ফায়জা মাথা নাড়ল। “পরে সব খুলে বলব। খুব ক্লান্ত লাগছে।” মাকে একটা আলিঙ্গন করে নিজের কামরায় চলে গেল সে। জিব্রানের হাতে বিশাল একটা মোড়ানো উপহার। সে ছুটে গেল রবিনের খোঁজে, উপহারটা দেখাবে।
“ওকে জাগিও না,” রিমা পেছন থেকে বলল।
নোমান দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল, মুখে এক টুকরো হাসি। “দুই জনকেই বহাল তবিয়তে ফেরত নিয়ে এসেছি। আমার কাজ আপাতত শেষ। দেলোয়ার ভাই কালই দেশে ফিরে যাচ্ছে। ঝামেলা চুকে গেল।” ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য একটু থামল নোমান। “তোমাকে এতো ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?”
রিমা কপাল কুঁচকে তাকাল। “তিন ঘন্টা! কি করল এতক্ষণ ওরা?”
“কথাবার্তা বলল, একসাথে লাঞ্চ করল, উপহার হাত বদল হলÑ ফায়জা একটা টাই নিয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, আমিই ওর সাথে গিয়ে কিনেছিলাম। তারপর ফিরে এলাম। তুমি অকারণে দুশ্চিন্তা করছিলে। ফায়জা তোমাকে পরে সব কিছু খুলে বলবে। আমার যেতে হবে। ক্যানভাসিং করতে হবে। অনেক জায়গায় যাওয়া বাকী এখনও। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তোমার কি প্ল্যান? যাবে?”
রিমা মাথা নাড়ল। “আজ না। দোকানে যেতে হবে। আমার কিছু কাস্টোমার আমাকে ফোন করেছিল। ওদের দুইজনকে নিয়ে যাবার জন্য ধন্যবাদ। ফায়জার জন্য এটার দরকার ছিল।”
নোমান চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে দরজায় ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ও। নোমান কেমন করে যেন আবার ওর জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশে পরিণত হয়ে গেছে, ভাবতেও অবাক লাগছে ওর। এইবার কিভাবে শেষ হবে কে জানে?
ঐ দিন রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে জিব্রান আর রবিন গেল ঘুমাতে। রিমা ফায়জাকে নিজের কামরায় ডেকে বিছানায় বসাল। ফায়জা জানত ওর মা ঘটনার বৃত্তান্ত জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে। সে মাকে ভরসা দেবার জন্য মুচকি হাসল। “ওখানে কিচ্ছু হয়নি মা।”
রিমা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। “তোমরা ওখানে তিন ঘন্টা ছিলে!”
“আমরা ডাইনিং হলে গিয়ে একসাথে লাঞ্চ করলাম, তারপর রুমে ফিরে গিয়ে একটা পে পার ভিউ মুভি দেখলাম আর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম। আর কিছু করিনি।”
“খুলে বল,” রিমা চাপ দিল। ও জানে ফায়জার কাছে এই সাক্ষাৎকারটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার নিশ্চয় আরোও অনেক কিছু বলার আছে।
ফায়জা কাঁধ ঝাঁকাল। “দেখে খারাপ লাগেনি। একটু বুড়িয়ে গেছেন। কিন্তু সেতো আমি আগেই জানতাম। ইন্টেরনেটে ছবি দেখেছি। চুপচাপ ধরনের। তাকে জিব্রানের খুব একটা পছন্দ হয়নি। আমার মনে হয় ও বুড়া মানুষদেরকে পছন্দ করে না।”
রিমা হাসি আটকাতে পারে না। “কথাটা ঠিক না। ও অপরিচিত মানুষদেরকে পছন্দ করে না। তা তোমরা কি নিয়ে কথা বললে?”
“স্কুল, নতুন বাড়ি, তোমার দোকানৃতোমার সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা জিজ্ঞেস করেছেন। যেমন তুমি বেশি কাজ কর কিনা, তোমার কোন অসুখ বিসুখ আছে কিনা। তোমার অপারেশনের খবর জানেন। তার অন্য ছেলেমেয়েদের ছবি দেখালেন। দুই ছেলে এক মেয়ে। নাম বলেছিলেন কিন্তু ভুলে গিয়েছি। বাংলা নাম। মনে রাখা কষ্ট।”
“এ ছাড়া আর কোন কিছু নিয়ে আলাপ করনি?” রিমা নাছোড়বান্দা।
ফায়জা আহত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। “আমাকে বিশ্বাস কর না তুমি? নোমান আঙ্কেল পুরো সময়টাই সেখানে ছিল। তাকেই জিজ্ঞেস কর। সে তোমার কাছে মিথ্যে বলবে না।”
“আমি সেটা বোঝাতে চাইনি,” রিমা ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল। “আমি আরেকটু বিশদ জানার চেষ্টা করছি। তোমার মুখেই শুনতে চাই। নোমানকে জিজ্ঞস করতে চাই না।”
ফায়জা মাথা দোলাল। মায়ের মনের অবস্থা সে বোঝে। “আগের কথা নিয়ে আমরা আলাপ করিনি, মা। অতীত নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। হয়ত একদিন তুমিই আমাকে সব কিছু বলবে। আমার জন্মদাতা বাবাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। একদিন না একদিন দেখা করতেই হত। হয়ে গেল। আমার সব কৌতূহলের এখানেই ইতি।”
মেয়ের কৌতূহল থাকার কারণটা রিমা বোঝে। ফায়জাকে খানিক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকল। “তুমি আমার গর্ব। একদিন, তুমি যখন আরেকটু বড় হবে, তখন তোমাকে সব কিছু খুলে বলব আমি।”
বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। ফায়জা ঘুমাতে চলে গেল। যাবার আগে দরজার সামনে থামল, পিছু ফিরে তাকাল, একটু দ্বিধা করছে।
“কিছু বলবে?” রিমা জানতে চায়।
“উনি বাবাকে চিনতেন। তুমি জানতে?” ফায়জা বলে।
“মিন্টুর কথা বলছ?” রিমা নিশ্চিত হতে চায়।
“অবশ্যই! আমার বাবা বলতে তো সে-ই।”
“তাদের মধ্যে কখন পরিচয় হয়েছিল বলে তো আমার জানা নেই। হয়ে থাকলেও আমাকে মিন্টু কখন কিছু বলেনি।”
“ও আচ্ছা! উনি বললেন কয়েক বছর আগে ঢাকাতে নাকি বাবার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। যাইহোক, ভাবলাম তোমাকে জানিয়ে রাখি। গুড নাইট, মা।” ফায়জা নিজের কামরায় চলে যায়।
রিমা মিন্টুর ঢাকা ভ্রমণের সময়কাল মনে করার চেষ্টা করে। দেলোয়ারের সাথে তার কি কোন কাজ ছিল? মিন্টু যে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি খোলার চেষ্টা করছিল তার সাথে কি দেলোয়ারের যোগসূত্র ছিল? হয়ত ছিল। কে জানে? ঐসবে আর কিছু এসে যায় না। কোম্পানি আদতেই কখন বাস্তবায়িত হয়েছিল বলে মনে হয় না। মানুষটাওতো আর নেই।
৯২
পরদিন সন্ধ্যায় ওর দোকানে এলো নোমান। দেলোয়ারকে প্লেনে তুলে দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এসেছে। তার দিকে এক নজর তাকিয়েই রিমা বুঝল ভেতরে ভেতরে একটু অস্থির হয়ে আছে সে। দোকানে কাস্টোমার ছিল, অপেক্ষা করতে বলল। মিনিট বিশেক পরে যখন দোকান ফাঁকা হয়ে গেল তখন নোমানকে খুঁজতে গিয়ে দেখল দোকানের সামনে পায়চারী করছে। ভেতরে আসতে বলল। ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল নোমান। “দোকানে আর কেউ আছে?”
“না, শুধু আমি!” রিমা বেশ অবাক হয়। “কি হয়েছে?”
“একটু আগে কি জেনেছি শুনলে বিশ্বাস করবে না,” নোমান চাঁপা স্বরে বলে। “এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম দেলোয়ার ভাইকে প্লেনে তুলে দিতে। চেক ইন করার আগে আমাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে দেলোয়ার ভাই যা বলল জানলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে।”
রিমার মাথায় নানান ধরনের চিন্তার স্রোত বয়ে যায়। কি হতে পারে? সে শান্ত দৃষ্টিতে নোমানের দিকে তাকিয়ে থাকে, রহস্য ভাঙার জন্য অপেক্ষা করে।
“তুমিতো জানো পিন্টু সবসময় বলে বেড়ায় তার ভাই সম্পত্তি বিক্রি করে টাকাপয়সা মেরে দিয়েছে,” নোমান বলে।
“হ্যাঁ, সব মিলিয়ে নাকি দুই মিলিয়ন ডলার হবে,” রিমা বলল। “হঠাৎ ঐ প্রসঙ্গ কেন উঠছে?”
“পিন্টুর কথা সত্য। দেলোয়ার ভাই নিজের মুখে আমাকে বলেছে। তার স্ত্রীর পরিবার মিন্টুর কাছ থেকে বেশ কিছু সম্পত্তি কিনেছিল। ভুয়া দলিল বানিয়ে বিক্রি করেছিল মিন্টু। জেনে শুনেই কিনেছিল। তাদের কত ক্ষমতা সে তো তুমি জানই।”
রিমা মনে মনে ভীষণ আশ্চর্য হলেও বাইরে সেটা খুব একটা প্রকাশ করে না। এতো মানুষ থাকতে ঐ মহিলার কাছেই যেতে হল মিন্টুকে!
“ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি ছিল ভুয়া,” নোমান বলল। “মিন্টু সব টাকা নিয়ে একটা ট্রাস্টে রেখেছে রবিনের জন্য। ও প্রাপ্তবয়ষ্ক হলে এবং মানসিকভাবে সক্ষম থাকলে এই অর্থ ওকে দেয়া হবে। যদি ওর অবস্থার কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে ট্রাস্ট ওর মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে একটা সিদ্ধান্ত নেবে।”
রিমা একটা গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। “রবিনের জন্য ট্রাস্ট! খুবই সম্ভব। সবসময় ওর জন্য চিন্তা করত। এতো ঝুট ঝামেলা করেছে ছেলেটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, যেন ওর কোন সমস্যা না হয়। আমাকে কেন কখন কিছু বলেনি সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি।”
“চায়নি তুমি কোন বিপদে পড়,” নোমান বলল। “দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিল । নিজেই সব খুলে বলেছিল তাকে। ট্রাস্টি কে আন্দাজ করতে পারবে?”
রিমা একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল। মিন্টু যদি দেলোয়ারের সাথে দেখা করে থাকে তাহলে সে কাকে ট্রাস্টি করতে পারে সেটা নির্ধারণ করতে খুব বেশি কল্পনা শক্তির প্রয়োজন হয় না। ওর চোখ ভিজে এলো। “আমার বাবা।”
নোমান মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আর তুমি হচ্ছ সাকসেসর ট্রাস্টি। তিনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন কিংবা মারা যান তাহলে তুমি ট্রাস্টি হবে।”
নিজেকে শান্ত রাখতে কষ্ট হয় রিমার। চোখের পানি মুছে দোকানের মধ্যে কয়েকবার পায়চারী করে, তারপর আনমনে বলে ওঠে, “মিন্টু কি করে ভাবল আমি চুরির টাকা আমার ছেলের হাতে তুলে দেব? ছয় বছর আমার সাথে সংসার করেছিল। আমাকে একটুও চেনেনি।”
নোমান তাকে কয়েক মুহুর্ত নীরবে দেখল। “ঐ টাকার তাহলে কি হবে?”
“সেই সিদ্ধান্ত আমার বাবাই নেবেন,” রিমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে। “ঐ দায়িত্ব তাকে কে নিতে বলেছিল? আমি বলিনি।”
“টাকাটা কোথা থেকে এসেছে সেই ব্যাপারে তার কোন ধারনা নেই,” নোমান বলে।
“তাতে আমার কিছু এসে যায় না,” রিমা একটা চেয়ারে ধপাস করে বসতে বসতে বলল। রাগ করবে না হতাশ হবে বুঝতে পারছে না। ওর বাবা ওর প্রতি যে অবহেলা দেখিয়েছিলেন তার ক্ষতিপূরণ দেবার জন্যই যে এই ভূমিকা নিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
“তোমাকে এই মুহুর্তে কিছুই করতে হবে না,” নোমান বলল। “ট্রাস্টের ব্যাপারটা দেলোয়ার ভাই আমাকে জানিয়েছে যেন আমি তোমাকে জানাই। আর কারোর এটা জানার কোন দরকার নেই। আর কেউ জানেও না। তার স্ত্রীও না।”
রিমা কিছু বলে না। কংক্রিটের মেঝের দিকে নিথর তাকিয়ে থাকে, তার মুখে একাধারে বেদনা এবং উষ্মা।
৯৩
বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর স্বামী এবং শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথে সময়টা ভালোই কাটছে মরিয়মের। আগের মত ঝুট ঝামেলা আর হয় না। পিন্টুও একেবারেই পালটে গেছে। স্বেচ্ছায় মরিয়মের হাতে ডাউন সাইজ সংক্রান্ত সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজে রেস্টুরেন্টটা সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছে।
মরিয়ম অবশ্য বেশ বিপদেই পড়েছে। ভালো দামে বাড়ি বিক্রি করা যদি কষ্টসাধ্য হয় তাহলে পছন্দের জায়গায় পছন্দ সই বাড়ি পাওয়া রীতিমর দুষ্কর। মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ রিমার বাসার দুই কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ডজন খানেক বাড়ি ওর পছন্দ হলেও নাকচ করতে হল। সবার পছন্দ হয়নি। খোঁজ চলতে থাকে।
রাতে খাবার পরে মেয়েদেরকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে সাধারণত ফ্যামিলি রুমে গিয়ে বসে রিমা, রিয়েল স্টেট সাইটগুলোতে কিছুক্ষণ বাড়ি খোঁজে। আজ ফ্যামিলি রুমে ঢুকেই মনে হল মা ছেলেতে মন কষাকষি চলছে। লাট্টু গেছেন নামাজ পড়তে। মরিয়ম ফিরে আসার পর তিনি আবার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করেছেন।
থেমে দু’ জনার দিকে নজর বোলাল মরিয়ম। দু’ জনার দৃষ্টিই টেলিভিশনের উপর নিবদ্ধ। “আমি কি একটু পরে আসব? আমার ঘরে গিয়েও কাজ করতে পারি।”
“না, না, মরিয়ম, যেও না,” পিন্টু বলল। “এটা তোমারও জানা উচিৎ। বস।”
“ওর এইসব জানার কোন দরকার নেই,” নীতা বেশ জোরের সাথেই বললেন।
“ওর জানার দরকার আছে, মা,” পিন্টুও জেদ ধরল। “এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখাটা ঠিক নয়।”
মরিয়ম ভয়ে ভয়ে একটা সোফায় বসল। আবার কি সমস্যা দেখা দিল? এই পরিবারের সমস্যার শেষ নেই। পিন্টু আবার কি করেছে কে জানে। “কি হয়েছে?” পিন্টুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ও কি বলবে? আমাকে জিজ্ঞসে কর,” নীতা ক্ষেপে গিয়ে বললেন। “আমার আদরের ছোট্ট পিন্টু আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখবে চিন্তাও করি নি আমি।”
পিন্টু হেসে ফেলল। “ছোট্ট পিন্টু? আমাকে দেখে কি ছোট্ট মনে হচ্ছে?”
“মায়ের কাছে বাচ্চারা কখন বড় হয় না,” নীতা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন। “তুমি আমার মনে ব্যাথা দিয়েছ।”
মরিয়ম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পিন্টুর দিকে চাইল। শ্রাগ করল পিন্টু। “তোমার মনে আছে আমরা যে সবসময় বলতাম মিন্টু ভাই আমাদের সম্পত্তি চুরি করে বেঁচে দিয়েছে?”
মরিয়ম নীরবে মাথা দোলাল।
“আমরা এখনও জানি না সেই টাকা ও কি করেছিল,” পিন্টু বলল।
“মিথ্যে বল না বাবা,” নীতা ওকে বাঁধা দিলেন। “মিনার আমাকে যা জানিয়েছে সেটা যদি তুমি আগেই জেনে থাকো তাহলে তুমি নিশ্চয় আরোও কিছু জানো যা আমাকে জানাও নি।”
“বিশ্বাস কর মা, আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই লুকাচ্ছি না। আমি যা জানতাম তা তোমাকে বলিনি কারণ চাই নি তুমি এইসব নিয়ে অকারণে দুশ্চিন্তা কর।” এবার মরিয়মের দিকে তাকাল সে। “তোমাকে সংক্ষেপে বলি কি হয়েছে। মা তার এক ভাইগ্নাকে বলেছিল টাকাটার হদিস করতে। সে জানতে পেরেছে পিন্টু ভাই সম্পত্তিগুলো খুব ক্ষমতাশালী একটা পরিবারের কাছে বিক্রী করেছিল। আমি আগেই জানতাম। কাউকে বলি নি। যে কারণে এখন মা আর আমার কোন কথাই বিশ্বাস করছে না।”
“তোমার উচিৎ ছিল আমাকে জানান,” নীতা বললেন।
“যদি বলতাম তুমি কি করতে মা?” পিন্টু তেঁতো গলায় বলল। “আমরা আর ঐ দেশে থাকিনা। আগে আমাদের যে ধরনের যোগাযোগ ছিল সেটা আর নেই। ওদের সাথে ঝামেলায় জড়ানো আমাদের পক্ষে একেবারেই উচিৎ হবে না। পরিণতি ভালো হবে না।”
“আমরা কোর্টে কেন যেতে পারব না?” নীতা গম্ভীর কন্ঠে বললেন। “তারা ভুয়া দলিল নিয়ে জমি কিনেছে সেটা আমাদের দোষ না। তাদের উচিৎ ছিল ভালো করে খোঁজ খবর নেয়া।”
পিন্টু মাথা নাড়ল। “অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে, মা। ঐসবের মধ্যে আমি যেতে চাই না।”
“তা যাবে কেন? বসে বসে বুড়া আঙ্গুল চুষবে,” নীতা ব্যাঙ্গ করে বললেন।
পিন্টু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। মরিয়ম তাকে শান্ত হতে ইংগিত করল।
“মা, আমি টাকাটা খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছি,” পিন্টু বলল। “মিন্টু ভাই সেই টাকা নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। আমি যাকে কাজটা দিয়েছিলাম সে এখনও কিছু বের করতে পারে নি। কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছে। মিনারকে চেপে যেতে বল। ও সমস্যা পাকিয়ে ফেলবে। আমাদের এখন ধৈর্য ধরতে হবে।”
“ধৈর্য নিয়ে কবরে যাবো!” নীতা বিড়বিড়িয়ে বললেন। “আমারা তলিয়ে যাচ্ছি আর তুমি এখন আমাকে ধৈর্য শেখাতে এসেছ।”
মরিয়ম ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে পিন্টুকে চুপ করে থাকার জন্য আবেদন করল। কথা শুনল পিন্টু। নীতা বিড় বিড় করতে করতে চলে গেলেন। তিনি তার শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করল মরিয়ম। তারপর পিন্টুকে বলল, “মিন্টু ভাই ঐ রকম একটা কাজ কেন করেছিল?”
পিন্টু কাঁধ ঝাঁকাল। “রিমা ভাবীকে বিয়ে করার পর বাবা-মা তাকে উইল থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। হয়ত তার প্রতিশোধ নেবার জন্যই।”
“সত্যি সত্যিই উইল থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন?”
“জানি না। মা-ই আমাকে বলেছে। যে দিন মারা গেল ভাইয়া সেই রাতে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আমিই আসতে বলেছিলাম। বলেছিলাম আমি মায়ের সাথে কথা বলে আবার উইল পালটে দেব। কিন্তু সম্পত্তি বিক্রির সব টাকা ওকে ফেরত দিতে হবে। আমার কথা শুনতেই চায় নি। স্বীকারই করে নি যে কোন অন্যায় করেছে। দাবী করছিল ঐ সম্পত্তি নাকি ওরই ছিল। দলিল সব আসল। আমার খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। বের হয়ে যেতে বলি। কে জানে হয়ত ওর মৃত্যুর জন্য আমিও খানিকটা দায়ী। শালার সম্পত্তি!”
মরিয়ম কিছু বলে না। ওর দেখে ভালো লাগছে যে অবশেষে পিন্টু সহায় সম্পত্তি আর সাফল্যের বাইরেও চিন্তা করতে সক্ষম হচ্ছে।