শুজা রশীদ : (পর্ব ৫৮)
নোমানের ফোন যখন বেজে উঠল ও তখন মিডল্যন্ড এভে ড্রাইভ করছে। গাড়ির সাথে বøæ টুথ দিয়ে যুক্ত থাকায় ড্যাসবোর্ডের ডিসপ্লেতে মিলার নাম উঠে এলো। রিমাকে কোন শব্দ না করার ইংগিত করে ফোন ধরল নোমান।
“মিলা!”
“কোথায় তুমি? আজ না আমাদের বাইরে গিয়ে ক্যনভাসিং করার কথা? তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম আমি।” মিলার কন্ঠে পরিষ্কার বিরক্তি।
“আরেক দিন গেলে হয় না, মিলা? আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা।” নোমান অপরাধী কন্ঠে বলে।
“তাই?” মিলার কন্ঠে স্পষ্ট হতাশার ছাপ। “আমরা না মাত্র দুই দিন আগে এটা নিয়ে আলাপ করলাম। তুমি তো তখন বলেছিলে তোমার কোন অসুবিধা নেই।”
“মিলা, এবারের মত মাফ করে দাও। আরেক দিন নিশ্চয় যাবো।”
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে গাড়িতে। ঠিক ধরেছি কিনা?” মিলা তীক্ষ্ণ কন্ঠে জানতে চাইল।
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। আমার বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি। সত্যিই খুব দুঃখিত মিলা। রাতে ফোন দেব। রাগ করলে নাতো?”
মিলা বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকল। “ঠিক আছে। কল দিও। বাই।”
মিলা ফোন না রাখা পর্যন্ত অপেক্ষা করল রিমা। “তুমি ওকে মিথ্যে কথা বললে?” তাকে দেখে মর্মাহত মনে হল।
নোমান কেশে গলা পরিষ্কার করল। “কিছু মনে কর না রিমা কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।”
“উপায় ছিল না বলছ কেন? যদি ওকে কথা দিয়েই থাকো তাহলে তোমার উচিৎ ছিল কথাটা রাখা।”
নোমান মাথা চুলকাল। “আমি যেতে চাই নি কিন্তু ও এতো জোরাজুরি করছিল। ওকে না করা যায় না। কোন আপত্তিই শুনতে চায় না।”
রিমা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকল নোমানের দিকে। “আমার ধারনা ছিল তুমি ওকে পছন্দ কর।”
“করি কিন্তু” নোমান দ্বিধা করে।
“কিন্তু?”
“তুমি তো জানোই” নোমান খুলে বলে না।
“না, জানি না,” রিমা চাপ দেয়। “তুমি আমার সামনে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছে মিথ্যে বলেছ। আমার ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগছে না। সত্যি কথা বলতে কি আমার খুব খারাপই লাগছে। মনে হচ্ছে ওকে ধোঁকা দিয়েছি।”
নোমান অসহায়ের মত ঘাড় নাড়ল। “আমি তোমার সাথে কিছুক্ষণ একাকী কাটাতে চেয়েছিলাম। হল তো? বলে ফেললাম। ও সাথে থাকলে আমরা নিজেদের মত করে কথা বলতে পারি না। যদি তোমার খারাপ লেগে থাকে আমি মাফ চাইছি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল বলে আমার মনে হয় না।”
অল্পক্ষণ পরেই রিমার ফোন বেজে উঠল। হাত ব্যাগ থেকে সেটাকে বের করল রিমা। মিলার কল। “যাহ্! মিলাই করেছে।”
“ধর নইলে আবার সন্দেহ করতে শুরু করবে,” নোমান বলল।
“করলে করুক। আমি ধরছি না। ভয়েস মেইল রাখবে। ওর কাছে মিথ্যা বলতে পারবো না। আমার বোনের মত ও।” রিমা ফোনটা আবার ব্যাগের ভেতরে রেখে দিল। আরোও কয়েকবার বাজার পর এনসারিং সার্ভিসে চলে গেল কলটা।
“ও যদি তোমাকে খুঁজতে তোমার দোকানে যায়?” নোমান বলল। “ঐ দিকেই থাকার কথা ওর।”
“ওর যা ধারণা করার ও করুক। আমি ওর কাছে মিথ্যে বলতে পারবো না। কোন দিন না।” রিমা দৃঢ় কন্ঠে বলল।
নোমান কাধ ঝাঁকাল। “আমারা হয়ত এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করছি। ও অন্য কাউকে সাথে নিয়ে চলে যাবে। ওর একজন সঙ্গী হলেই চলে। দেখা যাবে দুই জনে খুব হৈ চৈ করে ক্যানভাসিং করছে।”
“হ্যাঁ, তা ঠিক,” রিমা বলল। “কোন কিছু নিয়ে ও বেশিক্ষণ মাথা ঘামায় না।”
মেঘলা দিনে বাইরে থাকাটা এক রকম আশীর্বাদের মত হয়ে গেল ওদের জন্য। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মানুষ জনকে বাসায় পাওয়া গেল, কেউ কেউ ওদের সাথে আলাপ করতেও আপত্তি করল না। কিছু ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথেও আলাপ হল। একজন তো তাদেরকে তার বাড়ির সীমানার বাইরেই বের করে দিল। রিমা খুব অবাক হল। মতের মিল না হলে কিছু কিছু মানুষ যে কতখানি উগ্র হয়ে উঠতে পারে না দেখলে ও বিশ্বাস করতে পারত না।
নোমান ওর পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করে। “মন খারাপ কর না। কিছু মানুষ এই রকম আছেই।”
এই দেশের সিটিজেন হবার পর এখন পর্যন্ত একবারও ভোট দেয়নি রিমা। ওর মত আরোও অনেকেই আছে নতুন ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে। ওর কোন ধারণাই ছিল না কিছু কিছু মানুষ রাজনৈতিক ব্যাপারকে কতখানি গুরুত্ব দেয় এবং দেশের কিংবা প্রভিন্সের ভেতরে কি হচ্ছে তা নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামায়।
ঘন্টা খানেক পরেই নোমান ঘোষণা দিল তার ভীষণ ক্ষিধা লেগেছে। কোথাও গিয়ে লাঞ্চ করবার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। রিমার খুব ক্লান্তি লাগছিল, একটু ঠান্ডাও লাগছিল। এই প্রস্তাবে ঝট করেই রাজি হয়ে গেল। চাইনীজ খাওয়াই সাব্যস্ত হল।
এগলিন্টন রোডের উপর ছোট একটা রেস্টুরেন্ট। বেশ ভীড়। একটা চৌকোণা ছোট্ট টেবিলে দুজন বসেছে। ভেতরে আলো কমিয়ে রাখা। হালকা বাজনা বাজছে। সব মিলিয়ে বেশ একটা ঘরোয়া পরিবেশ। ওরা ফ্রাইড রাইস আর সুইট এন্ড সাওর চিকেন অর্ডার দিল। খেতে খেতে অকারণে কিছু একটা বলে চমৎকার পরিবেশটা দু’ জনার কেউই নষ্ট করতে চাইল না। এক রকম নীরবেই খেতে থাকে।
অবশেষে নোমান নীরবতা ভাঙে। “মিন্টুর সাথে তোমার কিভাবে পরিচয় হয়েছিল?”
রিমা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত তাকালো নোমানের দিকে। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ তুলবার কারণটা পরিষ্কার হয়নি ওর কাছে।
“কৌতূহল,” নোমান লাজুক কন্ঠে বলে। “কানাডা আসার পর তোমার জীবনে কি কি ঘটেছে তার প্রায় কিছুই জানি না আমি। যদি ঐসব নিয়ে কথা বলতে না চাও তাহলে থাক। এই প্রসঙ্গ তোলাটাই আমার অনুচিত হয়েছে।”
“না, না, ঠিক আছে,” রিমা দ্রুত বলল। “তুমি তো নিশ্চয় জানো আমি ঢাকা গ্রোসারীতে কাজ করতাম। মিন্টু ওখানেই আমাকে কাজ করতে দেখেছিল। আমাকে ওর সাথে ডিনারে যেতে আমন্ত্রণ জানায়। কয়েকটা ডেট করবার পর আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি রাজী হয়ে যাই। ঝট করেই আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।”
“ওর পরিবার কেন তাতে সমর্থন করেনি?” নোমান কথাচ্ছলে জিজ্ঞস করল।
রিমা কাঁধ নাড়ল। “নানা কারণ ছিল, আমি যা বুঝি। আমি ছিলাম এক ডিভোর্সি রিফুজি, আবার দুই বাচ্চার মা। তারা বোধহয় ভেবেছিলেন আমি মিন্টুর ভালো মানুষীর সুযোগ নিচ্ছি। পরে অবশ্য জেনেছি তারা মিন্টুর সাথে দেশে কোন এক্স মিনিস্টারের মেয়ের বিয়ের সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। বিয়ের পর ওদের বাসায় কখন পাও রাখিনি। মিন্টু ক্রিসেন্ট টাউনে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিল। সেখানেই আমাদের বিবাহিত জীবনের শুরু এবং শেষ।”
“ওর সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছি,” নোমান বলল। “ভালো এবং মন্দ, দুটোই। কেমন ছিল মানুষ হিসাবে?”
রিমা আবার ঘাড় নাড়ল। “প্রথম দিকে খুব ভালো ছিল। বাচ্চা দুজনকে ভীষণ ভালোবাসত। বাবা-মা-ভাইয়ের উপর অনেক রাগ ছিল বুঝতে পারতাম কিন্তু কখন মন্দ কিছু বলত না। সত্যি বলতে কি তাদের কথা প্রায় কখন বলতই না। পিন্টুর সাথে অবশ্য ওর সম্পর্ক ভালোই ছিল। আমার বিয়ের পরও ওদের রেস্টুরেন্টে ও কাজ করত। হঠাৎ কি হল, সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে ট্যাক্সি চালানো শুরু করল। পরে উবার। আমার ধারণা ওর মা-ই ওকে তাড়িয়েছে। সাংঘাতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাকে দেখে বুঝতেও পারবে না ভেতরে ভেতরে কত কুটিল হতে পারেন তিনি।”
“হ্যাঁ, শুনেছি।” কিছুক্ষণ নীরবে খেল নোমান। “মিন্টুর মৃত্যুর পর কাগজে অনেক কিছু পড়েছিলাম। আসলে কি হয়েছিল? ও কি ডিপ্রেশনে ভুগছিল? ওর বাবা-মায়ের সাথে গোলমাল হচ্ছিল দেখে? নাকি রবিনকে নিয়ে?”
রিমা মাথা নাড়ল। “জানি না। মৃত্যুর আগের দুই বছরে বেশ বদলে গিয়েছিল। বাসায় অবশ্য তেমন কোন ঝুট ঝামেলা হত না। রবিনকে নিয়ে অনেক ভাবত। কিন্তু ঐ ধরনের একজন বাচ্চা থাকলে সব পরিবারেই তো নানা ধরনের চিন্তা থাকেই। ওর বাবা-মায়ের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল বলে মনে হয় না।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “জানি না কি হয়েছিল। আমার স্বামী হলেও ওর সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু একটা জানি দাবি করব না। কিন্তু যতখানি জানি সে সুইসাইডাল ছিল না। এখন আমার সবসময় মনে হয় হয়ত আলামত কিছু একটা ছিল, আমি দেখেও বুঝতে পারিনি। হয়ত স্ত্রী হিসাবে আমার দেখা উচিৎ ছিল। দেখলে হয়ত বাঁচাতে পারতাম ওকে।” রিমা খাবারের আধা সমাপ্ত প্লেটটা সরিয়ে রাখল। ওর খাবার রুচি চলে গেছে।
“আমি খুবই দুঃখিত,” নোমান অপরাধী কন্ঠে বলল। “তোমার মনটা খারাপ করে দিলাম। এই প্রসঙ্গ তোলাই ঠিক হয়নি।”
“ঠিক আছে,” রিমা শান্ত কন্ঠে বলল। “আমার মনের মধ্যে এই সব নিয়ে আর কোন অপরাধবোধ নেই। আমি ভালো স্ত্রী, মা, গৃহিণী হতে চেষ্টা করেছিলাম। অন্যায় কিছু করিনি। ঐ সব নিয়ে ভেবে ভেবে নিজের বাকী জীবনটা বরবাদ করতে চাই না।”
নোমানের মনে হল হঠাৎ করেই যেন পরিবেশটা খুব ভারী হয়ে উঠল। সেও নিজের প্লেট সরিয়ে রাখল। “যথেষ্ট খেয়েছি। চল, যাওয়া যাক। তোমার কি দোকানে ফিরতে হবে এখন?”
রিমা হাতব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। “এক ঘন্টার মধ্যে না। এই সময়ে দোকানে প্রায় কেউই আসে না।”
“বøাফার্স পার্কে যাবে?” নোমান প্রস্তাব দিল। “অনেক দিন হয়ে গেল লেকের পাশে যাওয়া হয় না।”
রিমা কাঁধ ঝাঁকাল। “পানির পাশে একটু ঠান্ডা ঠন্ডা হতে পারে। তাও যাওয়া যায়। এখন গেলে মাছুয়াদের স্যালমন আর ট্রাউট ধরা দেখা যেতে পারে।”
“যাই চল। অনেক দিন মাছ ধরাও দেখি না।” নোমান ক্যাশীয়ারের কাছে গেল বিল মেটাতে।
ক্রেডিট কার্ডে বিল মিটিয়ে রিসিট নিল। রিমা ওর জন্য দরজার সামনে অপেক্ষা করছিল। রেস্টুরেন্ট থেকে একই সাথে বাইরে পা রাখল, খান দুই পদক্ষেপ নিয়েই একেবারে জমে গেল দুজন। বড় জোর দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে মিলা, তার মুখ থমথমে, দৃষ্টিতে বিহ্বলতা। একটা দীর্ঘ অপ্রীতিকর মুহুর্ত পেরিয়ে গেল। মিলা নোমানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, তার চোখে মুখে এবার বিদ্বেষ দেখা দিল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, “মিথ্যুক!”
নোমানকে দেখেই বোঝা গেল সে ঘাবড়ে গেছে। অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকল, কিছু বলে পারল না। রিমার মনে হল ধরণী বিভক্ত হলে সে লজ্জায় তলিয়ে যেতেও দ্বিধা করত না।
মিলা ওর দিকে একবার দৃকপাত করেই আবার তার অগ্নি দৃষ্টি নোমানের উপর স্থির করল। “বের করতে বেশি কষ্ট হয় নি। সব ভলান্টিয়ারদের জায়গা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। সেই লিস্ট চেক করলাম। তারপর গেলাম তোমার লোকেশনে। কাউকে দেখলাম না। জানি রিমা চাইনীজ খাবার পছন্দ করে। প্রত্যেকটা স্থানীয় চাইনীজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে চেক করছিলাম। কেন জান? কারণ সত্য্যটা জানা আমার দরকার ছিল। আমাকে সরাসরি কেন বললে না?” এবার রিমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। “খুব বোন হয়েছ, না?” ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের গাড়ীর দিকে হেঁটে গিয়ে ভেতরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। এতক্ষণে রিমার কন্ঠ ফিরে এসেছে। সে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে চীৎকার করে মিলাকে থামতে অনুরোধ করল। মিলা তার দিকে আরেকবার কড়া একটা দৃষ্টি হেনে গাড়ি নিয়ে ফুড়ুত করে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আরেকটু হলে আরেকটা গাড়িতে প্রায় মেরেই দিয়েছিল।
রিমা নোমানের দিকে তাকাল। নোমানকে দেখে মনে হল বেচারা একেবারে বিধস্ত হয়ে পড়েছে। এই দুর্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকে গালমন্দ করতে ইচ্ছা হচ্ছে রিমার। মিলার কলটা নেয়া উচিৎ ছিল ওর। ওকে সত্য কথাটা বলাই হত যথাযথ। মিলা শক্ত মেয়ে। সত্যটা ও গ্রহণ করতে পারত। ওরা দুজন মিলে মিলার সাথে যা করেছে সেটা শুধু যে বিশ্বাসঘাতকতা তাইই নয়, অপমানজনকও বটে। কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে ভেবে পেল না। নোমান অবশেষে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। ওর পাশে হেঁটে এসে বিড়বিড় করে ক্ষমা চাইল।
“ক্ষমা তোমার মিলার কাছে চাওয়া উচিৎ,” রিমা নীচু স্বরে বলল। “আমারও।”
৮৯
নোমান ওকে দোকানে নামিয়ে দিয়ে যাবার পর দোকানের ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে পাক্কা দশ মিনিট নিঃশব্দে বসে থেকে কিভাবে এই ভয়ানক ভুলের মাশূল দেওয়া যায় তাই নিয়ে ভাবল রিমা। নোমান ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে সে মিলাকে ফোন করে ব্যাপারটা খোলাসা করবে। কিন্তু রিমার ধারনা ওর প্রতি যে নোমানের রোমান্টিক অনুভূতি আছে এই তথ্যটা মিলাকে দেবার মত সাহস নোমানের নেই। যদি থাকত তাহলে ইতিমধ্যেই বলে ফেলত। মিলাকে আদৌ ফোন করবার সাহস তার আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু নোমানের সমস্যা নোমান বুঝুক। ওর চিন্তা মিলার সাথে ওর নিজের সম্পর্ক নিয়ে।
মিলাকে কম করে হলেও ডজন খানেক বার কল করল। ধরে নি মিলা। ফলে প্রতিবার ভয়েস মেইল রেখেছে রিমা।
ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে। মাফ চাই। একবার কথা বলার সুযোগ দাও।
যখন ঘন্টা দুই পেরিয়ে গেল অথচ মিলা ওকে ফোন করল না তখন রিমা দোকান বন্ধ করে মিলার বাসায় চলে গেল। মিলার গাড়ি দেখল না। বাড়িওয়ালার কাছে শুনল মিলা বিকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে, তখনও ফেরেনি। রিমা কি করবে বুঝতে পারে না। কোথায় খুঁজবে মিলাকে। মিলার অনেক বন্ধু বান্ধব। রিমা তাদের অধিকাংশকেই চেনে না। অসহায়ের মত শেষ পর্যন্ত আয়েশাকেই কল দিল। জানল মিলা তার বিকালের ক্যনাভাসিং সেশন ক্যানসেল করে দিয়েছে। মিলা কোথায় গিয়েছে সেই ব্যাপারে আয়েশার কোন ধারনাই নেই।
লজ্জা এবং অপরাধবোধে পীড়িত রিমা আর কোন উপায় না দেখে বাসাতেই ফিরে গেল। ফায়জা নিশ্চয় খেয়াল করে থাকবে রিমার মেজাজ ভালো নেই। সে আলাপ করবার তেমন একটা চেষ্টা করল না। রিমা সরাসরি নিজের কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে একটা লম্বা শাওয়ার নিল। তারপর আবার মিলাকে ফোন করল, বেশ কয়েকবার। কোন লাভ হল না। বাচ্চাদেরকে রাতের খাবার দিল কিন্তু নিজে কিছু খেতে পারল না। একেবারেই খাবার রুচি নেই। মিলা শক্ত মেয়ে হলেও খুব স্পর্শকাতর। হয়ত নোমান এবং রিমাকে জব্দ করবার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটা করে বসতে পারে।
মাঝরাতের একটু পরে ফায়জা ধীরে ধীরে ওর মায়ের ঘরে ঢুকল। রিমা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ছিল, হাতে ফোন, চোখে মুখে বিষন্নতা। নিজেকে ক্রমাগত দোষারোপ করছিল।
“ও ভালো আছে, মা,” ফায়জা নীচু গলায় বলল।
রিমা একরকম লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। “কি?”
“মিলা আন্টি ঠিকঠাক আছে,” ফায়জা অপরাধী কন্ঠে বলল। “তোমার সব ভয়েস মেইল পেয়েছে। আমাকে একটা টেক্সট পাঠিয়েছে। বলেছিল মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর তোমাকে জানাতে। সরি মা। আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল।”
রিমা পরিত্রানের নিঃশ্বাস ছাড়ে। “আর কিছু জানিয়েছে তোমাকে?”
ফায়জা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। তার বদ্ধ ধারনা তুমি আর নোমান আঙ্কেল দুজন দুজনকে ভালোবাসো। তোমাদের উচিৎ ঘর বাঁধা।”
রিমা ফায়জাকে পর্যবেক্ষণ করে। মিন্টু মারা যাবার পর একটা বছর পার হয় নি আর ইতিমধ্যেই রিমা এক পুরানো বন্ধুর প্রেমে পড়ে গেছে!
“এতে অন্যায় কিছু নেই মা,” ফায়জা নরম গলায় বলল। “সে খুব ভালো মানুষ। তোমাকে অনেক সুখী রাখবে। আমি তাকে খুব পছন্দ করি। ছেলে দুই জনও। সে তাদের সাথে অনেক খেলে। সব দিক থেকেই সে চমৎকার।”
রিমা নীরবে মাথা নাড়ল। নোমানের সাথে এখনওতো কিছুই হয় নি। হবে যে সেই নিশ্চয়তাও নেই।
“মা! আরেকটা ব্যাপার।”
রিমা মেয়ের দিকে ফিরল, অপেক্ষা করছে।
“আমি আমার বাবাকে বলেছি আমার আর জিব্রানের সাথে দেখা করবার জন্য টরন্টো আসতে।”
রিমা মাথা নাড়ল। “জানি। নোমান বলেছে।”
“তোমার তো কোন আপত্তি নেই, মা?”
“নাহ!”
“তুমি ঘুমাও তাহলে, মা,” ফায়জা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেল।
রিমা আবার মিলাকে ফোন দিল। এবারও ধরল না পাজী মেয়েটা।