শুজা রশীদ : (পর্ব ৫২)
৭৬
মিলা স্কুলের পর ফায়জাকে সাথে নিয়ে কিংস্টন রোড এবং মিডল্যান্ড রোডের ইন্টারসেকশনে সদ্য স্থাপিত ডলির নির্বাচনী অফিসে গেল। কয় দিন ধরেই ফায়জা ওকে অতিষ্ট করে দিচ্ছিল নির্বাচনী অফিসে যে কোন ধরনের একটা ভলান্টিয়ারের কাজের জন্য। ফায়জার বয়েস অল্প বিধায় একমাত্র ফোন ক্যানভাসিং করতে পারবে সে, ক্যাম্পেইন ম্যানাজার রায়ান ওকে জানিয়েছে। নির্বাচনী কর্মকান্ড শুরু হতে প্রথম যে কাজটা করেছে রায়ান সেটা হচ্ছে কিছু তরুণ ছেলেমেয়েদেরকে স্বেচ্ছাকর্মী হিসাবে নিয়ে এসে একটা ফোন ক্যানভাসিং টীম তৈরী করেছে। পার্টী অফিস থেকে সমর্থকদের একটা লিস্ট দেয়া হয়েছে তাদেরকে। সেই লিস্টটা ফোন ক্যানভাসিং টিম কে দেয়া হয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে সেই লিস্ট থেকে একে একে সবাইকে ফোন করে জানানো যে ডলি এবারের ইলেকশনে এন ডি পি থেকে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভোট প্রার্থী সে। তাদের অঙ্গনে ডলির নির্বাচনী সাইন পোঁতা যাবে কিনা সেটাও জেনে নিতে হবে। কেউ যদি অনুমতি দেয় তখন তার নাম ঠিকানা টুকে নেয়া হয় এবং ক্যাম্পেইন ম্যানাজারকে জানানো হয়, যে সেই তথ্য পাঠিয়ে দেয় ভি সি ও – র (ভোটার কন্ট্যাক্ট অরগানাইজার) কাছে। ভি সি ও সুযোগ মত একজন ফিল্ড ভলান্টিয়ারকে পাঠিয়ে দেয় উক্ত ঠিকানায় গিয়ে একটা সাইন পুতে আসতে।
প্রশস্ত নির্বাচনী অফিসে পা দিয়ে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করল ফায়জা। স্থানটা বেশ কিছু বছর আগে একটা ইন্ডীয়ান রেস্টুরেন্ট ছিল। সদর দরজার পাশেই একটা রিসেপশন ডেস্ক বসান হয়েছে। আরেকটু ভেতরের গেলে সারি বেঁধে কয়েকটা ডেস্ক বসান। ফোন ক্যানভাসারদের জন্য একটা চতুষ্কোণ স্থান ডিভাইডার দিয়ে পৃথক করা হয়েছে। রায়ানের অফিস একেবারে পেছন দিকে। বেসমেন্টে আরোও অনেক খানি জায়গা আছে। প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যাবে।
অফিসটা নানা বর্ণের, বয়েসের এবং লিঙ্গের সেচ্ছাকর্মীদের কথাবার্তা, হাসিতে গম গম করছে। এদিক ওদিক ছোট ছোট মিটিং চলছে, কেউ কেউ ফোনে আলাপে ব্যাস্ত। ঠিক যেমনটা ফায়জা ভেবেছিল। মিলা আয়েশার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিল। আয়েশা ওকে সাথে নিয়ে গেল সারা অফিসটা ঘুরে দেখাতে।
মিলা ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে এক বান্ডিল ফ্লায়ার তুলে নিল। ভাবছে হয় কোন পাড়ায় কিংবা এপার্টমেন্ট বিলডিংয়ে গিয়ে ফ্লায়ার বিতরণ করবে। প্রতিটা স্বচ্ছাকর্মীকে একজন ভি সি ওর সাথে কাজ করতে হয়। ওর ভি সি ও হচ্ছে আয়েশা। সে ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ফ্রন্ট ডেস্কে যে মেয়েটা বসে আছে তার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিল। এক পর্যায়ে দেখল ফায়জাকে নিয়ে রায়ানের অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে আয়েশা, গেল ফোন ক্যানভাসারদের কামরায়। আর বেশীক্ষণ লাগার কথা নয়।
মিনিট খানেক পরে একাই ফিরে এলো আয়েশা। মুখে বিশাল এক টুকরো হাসি। “মেয়েটা দারুণ!” মিলাকে বলল। “ওকে একজন অভিজ্ঞ ফোন ক্যানভাসারের সাথে লাগিয়ে দিয়েছি। শুরু করবার জন্য একেবারে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছে।”
“পাগল করে দিচ্ছিল আমাকে,” মিলা হেসে বলল। “তো মিস ভি সি ও, আমার জন্য কি প্ল্যান? দেখলাম এই ফ্লায়ারগুলো পড়ে আছে। কতগুলো নিয়ে বিলি করতে শুরু করব?”
“নিশ্চয়। ফার্মেসী আর ড্যানফোর্থের কাছাকাছি এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলো থেকে শুরু কর। যে কোন একটা বিল্ডিং বেছে নাও। ওদের অফিসে গিয়ে বললে সাধারণত ভেতরে ঢুকতে দেয়। কাকে সাথে নেবে?”
আয়েশা কামরায় উপস্থিত সবার উপর দ্রুত চোখ বোলায়। মিলার সাথে কাকে পাঠাবে ভাবছে। কয়েক জন মহিলাকে ওর সাথে পাঠাতে চাইল কিন্তু মিলা যখন কারো ব্যাপারেই খুব একটা আগ্রহ দেখাল না তখন কৌতূহলী হয়ে তাকাল। “মিলা আপা, কি বুদ্ধি আঁটছ? আমি এখন যেতে পারব না। সন্ধ্যায় অফিসে আমার কিছু কাজ আছে।”
মিলা এক মুহুর্ত ভাবল। “নোমানের কি খবর? সব সময় বলে সাহায্য করতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে। দেখা যাক তার কথার দাম আছে কিনা।”
আয়েশা বলল, “নিশ্চয়। কিন্তু উনি তো আজ এখানে আসেননি।”
“সেই সমস্যার সমাধান আমি করে ফেলছি।” মিলা ফোন বের করে নোমানকে কল করল। নোমান তখনও অফিসে ছিল। সাধারণত পাঁচটা পর্যন্ত কাজেই থাকে। এখনও পাঁচটা বাজে নি। কলার আইডি তে মিলার নামটা দেখে ফোন ধরল।
“হ্যালো! মিলা?” নোমান ধরেই নিয়েছে ক্যাম্পেইন সম্বন্ধীয় কিছু হবে।
“নোমান! কোথায় তুমি?”মিলা স্বতস্ফূর্তভাবে বলল। তার গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যায় ফোনের ওপাশের মানুষটাকে তার বেশ পছন্দ। আয়েশা চোখ ঘুরিয়ে মুচকি হেসে সেখান থেকে সরে পড়ল।
“আমি তো এখনও অফিসে।”
“ফার্মেসী আর ড্যানফোর্থের ইন্টারসেকশনে কত তাড়াতাড়ি আসতে পারবে? আমাদের কিছু ক্যাম্পেইনের কাজ করতে হব।” নোমানকে ফসকে বেরিয়ে যাবার সুযোগ দেবে না বলে বদ্ধপরিকর মিলা।
নোমান গলা পরিষ্কার করল। “আধা ঘন্টাতো লাগবেই। অফিস থেকে বের হতে পাঁচ-দশ মিনিট। বিশ পঁচিশ মিনিটের ড্রাইভ। এই সময় রাস্তায় ট্রাফিক বেশি থাকে।”
“গ্রেট!” মিলা ঘড়ি দেখল। “২৬৩ ফার্মেসী রোডের সামনে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এটা একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। আজ আমরা দু জনে মিলে কিছু ফ্লায়ার বিলি করব।”
নোমান দ্রæত ভাবছে। এর আগে এই জাতীয় কাজ সে কখনও করে নি ও। মজাই হবে। “আসছি। দেখা হবে। কিছু চাও? কফি? চা? ডোনাট?”
“ফুল চাই!” কথাটা বলে অন্য পাশের নীরবতাটুকু বেশ উপভোগ করল মিলা, তারপর হাসিতে ফেটে পড়ল। “ঠাট্টা করছি! টিম হর্টনস থেকে কফি আনলে মন্দ হয় না। একটা মিল্ক, একটা শুগার। স্মল। একটা ডোনাট হলে আরোও ভালো হয়। ডাবল চকোলেট। বেশী দেরী কর না।” ফোন রেখে দিল ও।
নোমান হাতের কাজটা দ্রæত সেরে অফিস ল্যপটপের পাওয়ার অফ করে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। ওর স্ত্রী চলে যাবার পর থেকে একরকম সাধু-সন্ন্যাসীদের মত জীবন যাপন করছে সে। নিজের মধ্যেই গুটিয়ে থাক অধিকাংশ সময়। ক্যাম্পেইনের কাজ করতে ওর যে খুব একটা আগ্রহ তা নয় কিন্তু জানত কোন না কোন ভাবে ঠিকই জড়িয়ে পড়বে শেষ পর্যন্ত।
৭৭
মিলা লবিতে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। একজন ভাড়াটিয়া ওকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে। বাইরে এখনও বেশ ঠান্ডা। সবাই ভেবেছিল এবার আগে আগেই বসন্ত আসবে কিন্তু আবহাওয়া এমন বেতাল যে বলা কঠিন কোন দিকে যাবে। মিলা একটা আঁটসাঁট লাল জ্যাকেট পরেছে, ওর শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা জিনসের প্যান্ট আর লম্বা বেণী করে বাঁধা চুলের সাথে বেশ ভালোই মানিয়েছে। নোমানকে দেখে দরজাটা অর্ধেকটা খুলে ওকে ভেতরে ঢুকতে দিল। নোমানের হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “ আমার প্রিয় কফি। ধন্যবাদ! যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত?”
“যুদ্ধ?” নোমান চমকে ওঠে। “কার সাথে?”
মিলা হেসে ওঠে। “তুমি এতো সরল! ঠাট্টা করছি। আমরা ফ্লায়ার বিলি করব আর চেষ্টা করব মানুষ জনের সাথে কথাবার্তা বলতে।”
“মানুষজন দরজা খুলবে মন হয়?” বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাম্পেইন করার ব্যপারে নোমানের কোন ধারণাই নেই।
“সত্য কথা বলতে কি,” মিলা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “এর আগে আমি আয়েশার সাথে মাত্র একবার গিয়েছিলাম। যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে মেয়েদেরকে দেখলে অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ মনে করে, অনেকেই দরজা খোলে। না খুললেও অসুবিধা নেই। আমরা দরজার নীচ দিয়ে ফ্লায়ার গলিয়ে দেব। আমাদের কাজ হচ্ছে সবাইকে আমাদের ক্যান্ডিডেট সম্বন্ধে জানানো।”
“আমারতো ধারনা ছিল এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙয়ের মধ্যে এই ধরনের প্রচারণা চালানোটা নিষেধ,” নোমান দ্বিধা নিয়ে বলল।
“আমরাতো প্রাচরণা চালাচ্ছি না, স্রেফ সবার হাতে আমাদের ফ্লায়ার পৌঁছে দিচ্ছি,” মিলা হেসে বলল। “এতো ঘাবড়ে যেও না। সব পার্টিই করে এইসব। চল, এই ফ্লোর থেকেই শুরু করা যাক। তুমি রেডী?” মিলা খিল খিল করে হেসে উঠল। “তোমাকে দেখে একেবারে দিশেহারা মনে হচ্ছে। যা কিউট লাগছে না!”
“ম্যাডাম, আমি আছি তোমার সাথে। চল, শুরু করা যাক।” নোমান করিডোরে মিলার পিছু নিল। মিলা তার হাতের ঝোলানো ব্যাগের ভেতর থেকে এক গাদা ফ্লায়ার বের করে নোমানের হাতে ধরিয়ে দিল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একটু পর পরই নোমানের শরীরের সাথে ঘষা খাচ্ছে তার শরীর। নোমানের মনে হল মিলা ইচ্ছে করেই করছে। মেয়েটা যেমন সুন্দরী তেমনি আকর্ষণীয়া। সে যদি তার প্রতি কোন আগ্রহ দেখায় সেটা নিয়ে কোন অভিযোগ করাটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা।
নোমান যা ভেবেছিল কাজটা তার চেয়ে কিঞ্চিৎ সহজই মনে হল। সবাই দরজা না খুল্লেও কিছু মানুষ খুলেছে, তাদের সাথে আলাপ করেছে। ইলেকশন নিয়ে সবার যে মাথা ব্যাথা আছে তা নয়। কারো কারো বর্তমান লিবারেল সরকার নিয়ে অভিযোগ আছে, কেউ কেউ আবার এন ডি পি কে পছন্দ করে না– আলাপ করাতো দূরে থাক, ফ্লায়ারে নজর বোলাতেও তারা অনাগ্রহী। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রথম তলা মোটামুটিভাবে সেরে ফেলল ওরা। অভিজ্ঞতা হিসাবে ভালো কিন্তু ক্লান্তিকর, নোমান ভাবল। মিলাকে দেখে অবশ্য মনে হল সে যেন আরোও বেশী উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে।
“আর কতক্ষণ করব আমরা?” নোমান এক পর্যায়ে জানতে চাইল। বেশ কয়েক দিন হল রিমা এবং ওর বাচ্চাদেরকে দেখতে যায় নি ও। ভাবছিল আজ সন্ধ্যায় যাবে।
“কেন? ইতিমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে গেছ!” মিলা দুইহাত কোমরে রেখে ওর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ঠোঁটের ডগায় মিটি মিটি হাসি। “আচ্ছা, ঠিক আছে। আমারও অনেক ক্ষুধা লেগেছে। আমাকে ডিনার খাওয়াবে?”
“নিশ্চয়! কি খাবে?” নোমান দ্রুত বলল। সাড়ে ছয়টার মত বাজে। তার ডিনার খাবার সময় এখনও না হলেও এমন সঙ্গিনী পেলে সময় নিয়ে কে মাথা ঘামায়?
“ইটালিয়ান চলবে? কাছাকাছি একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে।”
নোমান শ্রাগ করল। “ইটালিয়ানই সই।”
মিনিট বিশেক পরে, ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে একটা টেবিল নিয়ে মুখোমুখি বসে মিলা তাদের দু’ জনার জন্যই অর্ডার দিল, নোমানকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করল না সে কি চায়। মিলাকে চিনতে শুরু করেছে নোমান। সে খবর্দারী করতে পছন্দ করে। রিমার একেবারে উল্টো।
“তোমার কথা বল,” মিলা দুই হাতের তালুতে মুখখানা রেখে নোমানের চোখে চোখ রেখে বলল।
নোমান মনে মন একটু ঘাবড়ে গেল। বেশ কিছুদিন হল এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে নি। এখন আর দুই বন্ধু একসাথে খেতে এসেছে মনে হচ্ছে না বরং ডেটিং মনে হচ্ছে। রিমা মিলাকে ওর সম্বন্ধে কতটুকু বলেছে বোঝার চেষ্টা করল। আদৌ কিছু বলেছে কিনা সন্দেহ। রিমা ঐ রকমই। অনেক চাঁপা।
“আমার কথা বলার তেমন কিছু নেই। ডিভোর্সড। বাচ্চা কাচ্চা নেই। কিন্তু এইসবতো মনে হয় তুমি ইতিমধ্যেই জানো।”
মিলা হাসল। “রিমার মুখ থেকে কিছু বের করা অনেক কষ্ট। আমাকে শুধু এই টুকুই বলেছে যে তুমি তার অনেক দিনের বন্ধু। ব্যাস, আর কিচ্ছু না।”
নোমান মাথা দোলাল। “ও বরাবরই কথা একটু কম বলে।”
মিলা মাথা উপরে নীচে নেড়ে সমর্থন জানাল। “তোমার আর তোমার আগের স্ত্রীর মধ্যে কি হয়েছিল?”
নোমান কাঁধ ঝাঁকাল। বেশ কিছু বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও ঐ ব্যাপারে কথা বলতে ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। “পি এইচ ডি করতে আমেরিকা গিয়েছিল। সেখানে একজনের প্রেমে পড়ে যায়। মানুষের মন। হতেই পারে, তাই না? আমার কোন রাগ নেই। আমরা দু’ জনাই এখন সুখী।”
ওদের খাবার চলে এলো। মিলা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারে উপর। “ইটালিয়ান খাবার আমার খুব প্রিয়!” মুখ ভর্তি খাবারের ফাঁক দিয়ে কোন রকমে বলল। তারপর ফিক করে হাসল। “মুখে খাবার নিয়ে কথা বলাটা ঠিক না।”
নোমানকে স্বীকার করতেই হল মিলার মধ্যে এক ধরনের নিষ্পাপ ছেলেমানুষি আছে, ভালো লাগে।
“সে কি আবার বিয়ে করেছে?” মিলা মুখের মধ্যে এক টুকরো কালামারি ভাজি ঢোকানোর আগে জানতে চাইল।
নোমান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “জানি না। মনে হয়। আমার জানা মতে ওর সম্পর্কটা খুব সিরিয়াস ছিল।”
“বেচারী জানেও না কি হারিয়েছে,” মিলা হাসি নিয়ে বলল। “তুমি অনেক ভালো একটা মানুষ। যেমন সুদর্শন, তেমনি স্মার্ট, ভালো শ্রোতা। আমি ঠিক যা যা চাই!” নিজের মুখ ঢেকে খিল খিল করে হাসিতে ভেঙে পড়ল। “যাহ্! তোমাকে প্রপোজ করে ফেললাম!”
এই জাতীয় একটা প্রপোজাল পেলে ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে বুঝতে পারে না নোমান। সেও একটু হেসে খাবারে মনযোগ দিল।
৭৮
গত করেক দিন ধরে নীতা লক্ষ্য করেছেন পিন্টু রাত ন’টার আগেই বাসায় চলে আসে, তাকে ডিনার বানাতে সাহায্য করে এবং বাবা-মায়ের সাথে একসাথে রাতের খাবার খায়। রেস্টুরেন্ট তো রাত দশটার আগে বন্ধ হয় না। তাহলে ক্যাশিয়ারে কে কাজ করে? নীতা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরে মনে হল মরিয়ম চলে যাবার পর ইদানীং তিনি নিজেই অভিযোগ করছিলেন পিন্টু বাবা-মায়ের সাথে বেশী সময় কাটায় না বলে। এখন ছেলেটা যখন তাদেরকে কিছু সময় দিচ্ছে সেটা নিয়েও অভিযোগ করার কোন অর্থ হয় না। ছেলের সঙ্গ তিনি বেশ উপভোগ করছেন।
তার পুত্নী দুই জন চলে যাবার পর এতো বড় বাড়িতে নীতার ভীষণ একাকী লাগে। লাট্টু গত দুই বছরে যতখানি সময় বাসায় কাটাতেন তার চেয়ে এখন অনেক বেশী সময় কাটান, কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু নীতা জলি আর হ্যাপির অভাব ভীষণভাবে অনুভব করেন। প্রতিদিন অবশ্য ফোনে তেদের সাথে কথা হয় কিন্তু তাতে তার মন ভরে না। সামনা সামনি বসে কথা বলার আনন্দ আলাদা। ভাবছেন শীঘ্রই এই প্রসঙ্গে পিন্টুর সাথে আলাপ করতে হবে। মেয়ে দুইটাকে বাসায় ফিরিয়ে আনার সময় হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পিন্টু কখনই তার স্ত্রী কিংবা মেয়েদেরকে নিয়ে তার সাথে কোন আলাপই করে না। তার অনুরোধ শুনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে জানার কোন উপায় নেই।
এক রাতে, খাবারের পর, পিন্টু হঠাৎ করেই পারাবারিক অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে আনলো। নীতা জানতেন টাকা প্য়সা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে কিন্তু লাট্টু কিংবা পিন্টু তাকে এই সমস্ত ব্যাপারে কিছুই খুলে বলে না তার দূর্বল স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে। পিন্টু যখন বলল, “আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে তোমাদের সাথে আলাপ করা দরকারৃ” তিনি তাৎক্ষনিক ভাবে ধরে নিলেন মন্দ কিছু একটা শুনতে চলেছেন।
“মা, আব্বা তোমাকে কিছু বলেছে কিনা জানি না কিন্তু আমরা প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার ডলার গচ্চা দিচ্ছি।”
“এতো টাকা!” নীতা অবাক হয়ে গেলেন। “আমাদের অবস্থা এতো খারাপ হয়েছে সেটা তো জানতাম না।” তিনি স্বামীর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। “তুমি আমাকে কিছু বল নি কেন?”
লাট্টু নীরবে কাঁধ ঝাঁকালেন।
“ও আচ্ছা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি তো অবসর নিয়েছ!” নীতা খোঁচা দিলেন। “এখন আমরা সামাল দেব কিভাবে?” প্রশ্নটা পিন্টুকে লক্ষ্য করে করা। “প্রতি মাসে এতো টাকা কম হচ্ছে? রেস্টুরেন্টটা কি খুব খারাপ করছে?”
“রেস্টুরেন্ট নিয়ে সমস্যা না মা,” পিন্টু বলল, “আমরা খরচটা অতিরিক্ত বেশী করছি। আমাদেরকে একটু ডাউন সাইজ করতে হবে।”
“কি?” নীতা নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। “খরচ কমাতে বলছিস? কোথায়, কিভাবে?”
“চারদিকে তাকিয়ে দেখ মা,” পিন্টু কণ্ঠস্বর সহজ রেখে বলল। “এই বাসা একটা প্রাসাদের মত যার মধ্যে আমরা তিনজন মানুষ এক কোনায় পড়ে থাকি। তারপর এতোগুলো গাড়ী… আমার পর্শা…”
নীতা হাত তুলে ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিলেন। “মরিয়ম তোকে এইসব বুদ্ধি দিয়েছে, ঠিক কিনা?”
“আমরা দুজনে মিলে এই সব নিয়ে আলাপ করেছি,” পিন্টু নরম গলায় বল্ল।
“ও আচ্ছা, তাহলে তুই আমাদের পেছন পেছন তার সাথে ঠিকই আলাপ করছিস?” নীতা রাগী গলায় বললেন।
“হ্যাঁ। আমরা কথা বলি। সে তো এখনও আমার স্ত্রী।”
“তা তো বটেই! তা সে কি বলে?” নীতা তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করলেন।
“শুধু ও বলছে না মা। আমিও ভেবে দেখেছি। আমাদের উচিৎ আরেকটু ছোট বাসায় যাওয়া। আমার এতো দামী স্পোর্টস কারের কোন দরকার নেই। আমাদের দরকার আগে অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া। বিলাসীতা পরে।”