শুজা রশীদ : (পর্ব ৩১)
ঢাকার সেরা ক্লিনিকে দেশের শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের তত্বাবধায়নে জন্ম হয়েছিল ফায়জার। বাংলাদেশের চেয়ে সিঙ্গাপুরে নাকি মেডিকেল সিস্টেম ভালো, সেই জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবারও কথা উঠেছিল। স্থানীয় ডাক্তারেরা যখন নিশ্চয়তা দিলেন এখানে সন্তান প্রসবে কোন সমস্যাই হবে না শুধু তখনই সেই পরিকল্পনা বন্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত সিজারিয়ান করাতে হয়। দীর্ঘ নয় মাসের শত যন্ত্রণা আর কষ্টের পর শিশু কন্যার অপুর্ব সুন্দর মুখখানা দেখে তার মন আনন্দে নেচে উঠেছিল, ভুলে গিয়েছিল সব ব্যাথা-বেদনা। দেলোয়ার তার শত ব্যস্তাতার মধ্যে ক্ষনিকের জন্য সময় করে এসেছিল মেয়েকে দেখবার জন্য, রিমার জন্য নিয়ে এসেছিল এক তোড়া ফুল আর কিছু অলঙ্কার। লোকটাকে আর আপন মনে হত না রিমার।
হাসপাতালের বিছানায় পাশেই রাখা ক্রিবে শুয়ে থাকা শিশুর পাশে আধা ডজন নার্সের সেবায় আর অসংখ্য অপিরিচিত মানুষের আনাগোনায় সে যখন অতিষ্ট হয়ে একটা পরিচিত মুখ দেখবার জন্য অসম্ভব রকম বিচলিত হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখন এক স্বগীয় উপস্থিতির মত হাতে এক গুচ্ছ ফুল আর মুখে অপরাধী এক হাসি নিয়ে হাজির হয়েছিল নোমান, যেন তার দীর্ঘ অনুপিস্থিতির জন্য নীরবে ক্ষমা চাইছিল। তার দর্শনে আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিয়েছিল রিমা, তার দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে নেমেছিল অশ্রুর ধারা। সেই দিন থেকে যেমন আচমকা তার জীবন থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল নোমান তেমন আচমকাই আবার তার জীবনে ধুমকেতুর মত প্রত্যাবর্তন করে সে।
ফায়জার জন্মের অল্প কিছু দিন পরেই, মেয়েটা যখন মাত্র হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে, আরেক প্রস্থ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হল রিমাকে। গুলশানের আলিশান বাড়ী থেকে তাকে স্থানান্তর করা হল ধানমন্ডির অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আরেকটি বাসায়। তাকে জানানো হল দেলোয়ারের ব্যবসায়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাই গুলশানের বাড়ীটাকে ভাড়া দেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে কোন এক এমব্যাসিকে। রিমা সেসব নিয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি করে নি। ঐ বিশাল ভুতুড়ে বাড়ীতে ওর কোনদিনই ভালো লাগে নি। বরং ছোট বাসাটাই ভালো লেগেছিল, কেমন একটা উষ্ণতা ছিল। তার রাধুনী এবং অধিকাংশ কাজের মানুষেরা বিদায় হয়ে গেল। থাকল শুধু একজন বাঁধা কাজের মানুষ। দামী গাড়ী পালটে গিয়ে এলো একটা টয়োটা করল্লা। ড্রাইভার থাকল। সব মিলিয়ে মন্দ না। রিমা মনে মনে খুশীই ছিল। কিন্তু যখন হঠাৎ দেলোয়ার ঘোষণা দিল তার নতুন ব্যবসার কেন্দ্র হবে হং কং এবং তাকে বছরের অধিকাংশ সময় সেখানেই কাটাতে হতে পারে তখন সন্দিহান হয়ে পড়েছিল ও। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেলোয়ারের দেখা সাক্ষাৎ কিংবা যোগাযোগের সংখ্যা প্রায় শুণ্যে নেমে এলো। সে কখন কোথায় থাকত জানতেও পারত না ও। সে সত্যি সত্যিই ব্যবসার জন্য হং কংয়ে আছে নাকি ঢাকাতেই অন্য কোন মেয়ের সাথে ভিন্ন কোন বাসাতে আছে জানার তার কোন উপায়ও ছিল না।
প্রথম প্রথম খুব কেঁদেছিল। নিজেকে অসহায় মনে হত। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর কান্না বন্ধ হয়ে আসে। ওর এবং মেয়ের সমস্ত খরচা খরচ যতদিন দেলোয়ার বহন করবে ততদিন সে কোন অনুযোগ করবে না বলে মনস্থির করে। বরং সেই সময়টাতেই তার নিজেকে খানিকটা স্বাধীন মনে হত। মনে মনে পরিকল্পনা করছিল ফায়জা একটু বড় হলে ওকে ডে কেয়ারে রেখে সে আবার ইউনিভার্সিটীতে গিয়ে পড়াশুনাটা শেষ করবে। সেই সময় ওর একজন বন্ধু ছিল, যে কারণে আগের মত নিঃসঙ্গতার সাথে যুঝতে হত না। নোমান নিয়মিত আসত, ফায়জার জন্য রাজ্যের সুন্দর সুন্দর সব খেলনা কিনে আনত, ঘন্টার পর ঘন্টা খেলত মেয়েটার সাথে, ডায়পার পালটে দিত, গোছল করিয়ে দিত। মেয়েটা তর বাবার সঙ্গ প্রায় না পেলেও নোমান বাবার অভাব তাকে একেবারেই বুঝতে দেয় নি। রিমা মাঝে মাঝে ভাবত দেলোয়ার কি জানত যে নোমান প্রায়ই ওদের বাসায় আসে, দীর্ঘক্ষন থাকে? না জানার কোন কারণ ছিল না। বাসার কাজের লোক, ড্রাইভার সবাই তার কর্মচারী। তারা নিশ্চয় তাকে জানিয়েছে। কিন্তু সে হয়ত ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় নি কিংবা ঘামানোর সময় কিংবা প্রয়োজন অনুভব করে নি। তবে মেয়েকে দেখতে আসার সময় না থাকলেও মেয়ের জন্য নিয়মিত গাড়ী ভর্তি করে উপহার ঠিকই পাঠাত – দামী বিদেশী জামা কাপড় থেকে শুরু করে খেলনা, নাচ-গানের ভিডিও, জুতা এমন আরও কত কিছু। যেন তার অভাবটুকু সে উপহারের আতিশয্যে ভুলিয়ে দিতে চাইত।
যে মানুষটা মাত্র বছর খানেক আগেও এমন প্রেমময় ছিল তার অকস্মাৎ পরিবর্তনের কারণ রিমা একেবারেই বুঝতে পারে না। নিজের একমাত্র মেয়েকে নিয়মিত দেখতে আসার জন্য সামান্য সময় তার কেন হবে না? একেবারে আসত না তা নয়, কিন্তু কখন হয়ত সপ্তাহে একবার, কখন আবার মাসে একবার। তার সেই ব্যবহারের কারণেই রিমা একরকম ধরেই নিয়েছিল দেলোয়ারের সমস্যা শুধু প্রেম সংক্রান্ত নয়, আরোও গুরুতর কিছু। তাকে প্রশ্ন করে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না, জানত। নোমানকে জিজ্ঞেস করেছিল। নোমানের সেই ব্যাপারে কোন ধারনা ছিল না। সে কোন উত্তর দিতে পারেনি।
কেন অকারণে রিমা আর তার মেয়ের পেছনে নিজের মূল্যবান সময়ের অপচয় করছে সে? নোমানের কাছে জানতে চেয়েছিল একবার রিমা।
ভবিতব্য! সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিল নোমান।
৪৪
নোমান এলো সবার জন্য উপহার নিয়ে। রিমার জন্য ফুল, ফায়জার জন্য একটা জনপ্রিয় টিনএজ সিরিজের হার্ডকভারে বাঁধান বই, জিব্রানের জন্য বিশাল এক বাক্স লেগো আর রবিনের জন্য টকিং পুতুল। তাতে লাভ একটা হল – সে ঝট করেই বাচ্চাদের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে গেল।
“কি করেছ এটা?” রিমা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলে। “পুরো দোকান কিনে এনেছ দেখছি!”
নোমান লাজুক ভঙ্গিতে হেসে মাথা দোলায়। “বাড়িয়ে বলছ কেন? খালি হাতে আসতে চাইনি তাই হাতের কাছে যা পেলাম নিয়ে এলাম। তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”
রিমা হাসে। মানুষটার কোন পরিবর্তন হয় নি। সেই বিনীত স্বভাব। তার এই ব্যবহার দেখে কেউ বুঝতেও পারবে না ধানমন্ডীর বাসায় থাকতে তাদের দুজনার মধ্যে কি দারুন সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল। সে যে শুধু ফায়জার পিতৃতুল্য হয়ে উঠেছিল তাই নয়, রিমার বিশ্বস্ত বন্ধু এবং সঙ্গীও হয়ে গিয়েছিল। ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় ছিল সেই দিনগুলো। নোমানের কি সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে? দশ বছর অনেক লম্বা সময়। বিশেষ করে যখন দুজন মানুষের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয় এক অভাবনীয় পরিস্থিতির শীকার হয়ে। সেই সব প্রসঙ্গ আজ আর তুলতে চায় না রিমা। ফায়জা এবং ছেলে দুজনকে দেখতে চেয়েছিল নোমান। ওদের নিয়েই আলাপটা না হয় সীমাবদ্ধ থাক।
ফায়জা অনেক চেষ্টা করেছে নোমান আসার আগে তার সম্বন্ধে খুব বেশি আগ্রহ না দেখাতে। কিন্তু মনে মনে সে যে খুবই কৌতূহলী হয়ে ছিল সেটা বুঝতে বাকী থাকে নি। যে মানুষটা ছোটবেলায় তার ডায়পার পর্যন্ত পালটে দিয়েছে তার কথা বিন্দুমাত্র মনে না থাকলেও ভেবেছিল সামনাসামনি দেখলে কোন একটা স্মৃতি স্মরণ হতে পারে। মায়ের কাছে শুনেছে শেষবার যখন নোমান ওকে দেখেছিল তখন ওর বয়েস ছিল মাত্র তিন বছর। অত ছোট বয়েসের স্মৃতি মনে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তারপরও আজব ঘটনা তো ঘটেই।
নোমান পরিপাটি হয়েই এসেছে। পরনে কালো ট্রাউজার আর সাদা শার্ট ইন করে পরা। তার উপরে একটা নীল বেøজার। অক্টোবার মাসের শেষে সন্ধ্যায় বেশ শীত শীত ভাব থাকে। রিমা তার সাথে ফায়জার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে সে হেসে মাথা দুলিয়ে তার হাতে বইটা ধরিয়ে দেয়। হাসিমুখে বলে, “তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ!”
কথাটা সে যেভাবে বলেছিল তার মধ্যে নিশ্চয় কিছু একটা ছিল কারণ ফায়জা ফিক করে হেসে ফেলে। তার জন্য ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। অপরিচিত মানুষদের সাথে সে পারতে পক্ষে কথাবার্তা বলে না, হাসা তো দূরের কথা। নোমানের জন্য সে একটা ব্যাতিক্রম করেছে। খুশীতে নোমানের দাঁত বেরিয়ে পড়ে। “ছোটবেলায় তুমি সারাক্ষণ ঐ রকম করতে!”
“কি করতাম?” ফায়জা জানতে চায়, তার দু’ চোখে হাসির ছটা। ছোটবেলার কোন কথাই তার তেমন মনে পড়ে না কিন্তু মানুষটার সাথে কেন যেন একটা যোগসূত্র সে অনুভব করে।
“ঐভাবে ফিক করে হাসতে!” নোমান বলে। “গত দশ বছরে তোমার কথা কত যে ভেবেছি!”
ফায়জা আবার ফিক করে হেসে ফেলে। তার জন্য এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। মিন্টু তাকে খুবই ভালবাসত কিন্তু সেই অনুভূতি ছিল ভিন্ন। নোমান এপার্টমেন্টে প্রবেশের পর থেকেই সে বুঝে গেছে এই মানুষটার তার প্রতি রয়েছে নিঃশর্ত ভালোবাসা।
রিমা যখন দেশ ছেড়ে চলে এসেছিল তখন জিব্রানের বয়েস ছিল মাত্র তিন মাস। তার সাথে মমতার বাঁধনে জড়ানোর মত যথেষ্ট সময় নোমানের হয় নি। সে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার হাতে লেগোর বাক্সটা তুলে দেয়। তারপর এলো রবিনের পালা। সে ঝট করে তার ঘাড়ে চড়ে বসল যেভাবে বাবার ঘাড়ে চড়ত। নোমান যে সাবলীলতায় তার সন্তানদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে দেখে একটা দুশ্চিন্তা দূর হয় রিমার। সে আসার আগ পর্যন্ত মনে মনে ভয়ে ভয়েই ছিল। না জানি বাচ্চারা কিভাবে তাকে গ্রহণ করে।
রাতের খাবারের পর ছেলেরা তাদের খেলনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। রিমা এবং নোমান কফি হাতে লিভিংরুমে গিয়ে মুখমুখি দুটা সোফায় বসে। ফায়জা মায়ের পাশে এসে গা ঘেঁষে বসে। খেতে খেতে ওর ছোটবেলার কিছু হাসির ঘটনা নোমান বলেছিল – একবার সে একটা জ্যান্ত তেলাপোকা ঘপাত করে মুখে ভরে দিয়েছিল; আরেকবার নোমানের মুখের উপর এত্তোগুলা বমি করেছিল। শুনে খুব হেসেছিল ফায়জা। ওর ধারণাই ছিল না ওর জীবনের প্রথম দুই বছর এতো মজার সব ঘটনা ঘটেছিল! রিমা কখন সেই সব সময়ের কথা বলে না। ফায়জাও মাকে অতীত নিয়ে কখন কোন প্রশ্ন করে না।
পরদিন ফায়জার স্কুল আছে। কিছুক্ষণ পরে সে ঘুমানোর অজুহাতে নিজের কামরায় চলে গেল, ওদের দুই জনকে একাকী আলাপ করবার সুযোগ দিল।
“ওর বাবার কথা ওকে বলেছ?” নোমান প্রায় ফিসফিসিয়ে জানতে চায়।
রিমা মাথা নাড়ে। “না। বলব?”
“ও জানতে চায়নি?” নোমান উল্টো প্রশ্ন করে।
“চায়নি। মিন্টুই ছিল ওর বাবা। ওকে ভীষণ ভালোবাসত মিন্টু।”
নোমান আনমনে মাথা দোলায়। “কেন বাসবে না? কি যে মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা!”
“আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলে না। বলা উচিৎ আমার?” রিমা আবারও জানতে চায়।
“হ্যাঁ, আমার মনে হয় তোমার ওকে বলা উচিৎ,” নোমান বলে।
রিমা মাথা দোলায়। “জানতাম তুমি সেটাই বলবে। বলব। কোন একদিন।”
একটা দীর্ঘ নীরব মুহুর্ত পেরিয়ে যায়। “তোমার সাথে কখন যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছে?” নোমান অবশেষে জিজ্ঞেস করে।
রিমা মাথা নাড়ে। “না। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে।”
আরেকটা দীর্ঘ বিরতির পর নোমান বলে, “ভীষণ অবাক হয়েছিলাম।”
দশ বছর আগের ঘটনা কিন্তু রিমার বুঝতে বিন্দুমাত্র বাকী থাকে না কোন প্রসঙ্গে কথা বলছে নোমান।
রিমার নজর আটকে যায় তার নখে। গত বছরগুলোতে কত অসংখ্যবার সে যে নিজেকে এইভাবে এই মানুষটার মুখোমুখি বসিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। কোনদিন ভাবে নি সেটা একদিন এইভাবে বাস্তব হয়ে যাবে। সমস্যা হল, তখন তার কাছে যা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল এতো বছর পর সেই অনুভূতিকে উপলব্ধি করাটা নোমানে জন্য সম্ভব নাও হতে পারে।
“আমার অন্যায় হয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গ আমার তোলাটা একেবারেই ঠিক হয়নি।” নোমান ওর শুষ্ক মুখ দেখে লজ্জিত কন্ঠে বলে। “অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তারপরও কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারিনি।”
চোখে তুলে তার দিকে তাকায় রিমা। “আমি চলে আসার পর কি হয়েছিল?”
নোমান ঘাড় দোলায়। “তেমন কিছুই হয়নি। দেলোয়ার ভাই খুব ক্ষেপে গিয়েছিল। আমার সাহায্য চেয়েছিল। আমিও তো তার মতই অবাক হয়েছিলাম। তাকে কিভাবে সাহায্য করব? কিছুটা ভেঙ্গেও পড়েছিল একটা সময়ে। এতোখানি প্রতিক্রিয়া হবে আমি আশা করিনি। বাইরে না দেখালেও ফায়জার প্রতি তার অনেক দূর্বলতা ছিল। প্রথম সন্তান।”
“আর জিব্রান?” রিমা জানতে চায়।
“ততখানি নয়। ও তো তখন খুবই ছোট।” নোমান রিমার মুখের উপর তার দৃষ্টি আবদ্ধ রাখে। বোঝাই যায় রিমার মুখ থেকে কিছু একটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সে। রিমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে।
“তুমি কোন কিছু সন্দেহ করনি?” জিজ্ঞেস করে রিমা।
“কি সন্দেহ করব? তোমার অন্তর্ধান? না। করা কি উচিৎ ছিল? তুমি কি কোন ইংগিত দিয়েছিলে? তুমি তো জানোই এইসব ব্যাপারে আমি বরাবরই খুব কাঁচা।”
রিমা মাথা নাড়ে। “না। কোন ইঙ্গিত দেইনি। গোপনীয়তা বজায় রাখাটা জরুরি ছিল। চাইনি দেলোয়ার কোনভাবে আন্দাজ করুক। টের পেলে আমার কাছ থেকে বাচ্চাদেরকে নিশ্চয় ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করত। ওদের ছাড়া আমি কি নিয়ে বাঁচতাম?”
“কিন্তু তোমার চলে আসতে হল কেন?” নোমান প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত তাকিয়ে থাকে। “সব কিছুতো ভালোই চলছিল।”
তার জন্য রিমার মনটা মুচড়ে ওঠে। জানত নোমান ভীষণ আঘাত পাবে। ওর নিজের বুকটাও ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু অন্য কোন উপায় ছিল না। ব্যাপারটা নোমানের সম্পূর্ণ অগোচরে রাখাটা ভীষণ জরুরী ছিল।
“কি হয়েছিল আমাকে বলতে চাও না?” নোমান আহত কন্ঠে বলে। কি হয়েছিল সেটা জানার অধিকার তার নিশ্চয় আছে। সপ্তাহে দুই থেক তিনবার রিমা এবং বাচ্চাদেরকে দেখতে যেত সে। কোন সপ্তাহে আরোও বেশি। একদিন গিয়ে দেখে শুধু ড্রাইভার আর কাজের মহিলা বাড়ীতে। রিমা বচ্চদের নিয়ে কোথায় গেছে তারা জানে না। প্রথম ভেবেছিল তাদের হয়ত কোন বিপদ হয়েছে। দেলোয়ারকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়েছিল। দেলোয়ার ততক্ষণে জেনে গিয়েছিল রিমা বাচ্চাদের নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। চারদিকে মানুষ লাগিয়ে দিয়েছিল তাদেরকে খুঁজে বের করবার জন্য, পুলিশে রিপোর্ট পর্যন্ত করে নি। নোমান থানায় গিয়ে একটা কেস ফাইল করেছিল। পরে সেই কেস বন্ধ করে দেয়া হল। অবাক হয়েছিল নোমান। কারণটা জানতে চেয়েছিল। তাকে জানানো হয়েছিল রিমা এবং বাচ্চারা বিদেশে চলে গেছে। দেলোয়ার তাকে নির্দেষ দিয়েছিল এসব নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্চ্য না করতে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় নিজেকে একরকম হারিয়ে ফেলতে বসেছিল সে যখন দুবাই থেকে রিমার একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি এলো।
প্রিয় নোমান ভাই,
আগে থেকে বলিনি বলে রাগ কর না কিন্তু আমি বাচ্চাদের নিয়ে দুবাই এসেছি এবং এখানে কিছুদিন থাকব। তোমাকে আমার সাথে যোগযোগের কোন ঠিকানা আমি দিতে পারব না। আমার আর বাচ্চাদের জন্য তুমি যা করেছ সেই জন্য চিরদিন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমাকে ভুলে যেও। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে সংসারী হয়ো। আমার দোয়া রইল।
রিমা।
তারপর আর রিমার সাথে তার কখন কোন যোগাযোগ হয় নি। নিজেকে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, উচ্ছিষ্ট মনে হয়েছিল তার, এক গভীর দুঃখ আর বেদনার সরবরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। তার বাবা মা জোর করে একটা মেয়ে দেখে তার বিয়ে দিলেন। বঁধুকে নিয়ে নতুন একটা এপার্টমেন্টে সংসার পেতেছিল সে কিন্তু রিমার এমন আচমকা অন্তর্ধানে তার ভেতরে যে বিশাল এক ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে নিজেকে সে পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করতে পারে নি, নতুন সংসারেও নীরবে বহন করেছে সেই গ্লানি। রিমার প্রত্যাখ্যান যদিও সে গ্রহণ করতে পেরেছিল, তার উপেক্ষা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
রিমা গভীর একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। “তোমাকে আমার সব খুলে বলা উচিৎ ছিল। একটা চিঠি লিখেও জানাতে পারতাম। জানাইনি কারণ আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সাথে তোমাকে আর জড়াতে চাই নি। কিন্তু সব কিছু জানার অধিকার যদি কারো থাকে সে হচ্ছ তুমি।”