শুজা রশীদ : (পর্ব ২৭)
৩৮.
ডিশ ওয়াসার হিসাবে কাজ করার কোন আগ্রহই ছিল না কালামের কিন্তু মরিয়ম তাকে যখন সেই কাজই দিল সে না করতে পারল না। মরিয়মের সাথে ওর কখন আগে দেখা না হলেও তার সম্বন্ধে অনেক ভালো কথা শুনেছে। মরিয়ম তার বিনীত ব্যবহার এবং শান্ত ব্যবহারের জন্য পরিচিত। পিন্টুর মত উগ্র এবং মেজাজী নয়। ঢাকা গ্রোসারীতে কাজ করে রহমান, সে মরিয়মের ভাই আবুলের পারিবারিক বন্ধু। সে সব সময় বলে মরিয়মের মত একটা মেয়ে কোন কুক্ষণে বিয়ে করেছিল পিন্টুর মত একটা লোককে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। প্রথম পরিচয়ের পরই কালাম তার সাথে একমত হল। ভদ্রমহিলার ব্যবহারে, আচার আচরণে এমন একটা চমৎকার কিছু আছে যে তাতক্ষনিকভাবেই যে কারো মন জয় করে নিতে পারে।
প্রথম বার যেদিন আহমেদ’স এ এসেছিল কালাম, সুফির সাথে কথা হয়েছিল। সেও বেশ ভালো মানুষ, সহজ সরল। মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের পরিচয়েই তার জীবনের সব কাহিনী সে কালামকে বলে ফেলেছে। অল্প বয়েসে সে দেশ থেকে পালিয়ে ইউরোপে যায়, বেআইনিভাবে ইটালীতে প্রবেশ করে। সেখান থেকে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে কানাডা আসে, আশা ছিল এখান থেকে আমেরিকায় যাবে। কিন্তু টরন্টো আসার পর অনেক পুরানো বন্ধু বান্ধবের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়ে গেল, তার আমেরিকা যাবার ইচ্ছা পুরো উবে যায়। কিন্তু লোকটা চিমণির মত ধোঁয়া ছাড়ে সারাক্ষণ। সিগ্রেটের গন্ধ কালামের একেবারেই সহ্য হয় না কিন্তু সুফির গল্প শুনতে ভালো লাগে যে জন্য মানিয়ে নেয়। সুফি ইউরোপের অনেক গল্প করে, কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কি কি করেছিল এই জাতীয় অনেক কিছু। কানাডা এসে সে যে অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা ভালো করছে তা নয় কিন্তু তারপরও সব মিলিয়ে ভালোই আছে।
কাজের মাঝে বিরতির সময় ওরা দুজন কিচেনের পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে গলির দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে। কালামের জানতে বেশি সময় লাগে না যে সুফি ক্রিসেন্ট টাউনে থাকে না। একটা ব্যাপারে ওর কোন সন্দেহ নেই গভীর রাতে রিমাদের দরজায় গিয়ে যে বদমাশ টোকা দিচ্ছে সে ক্রিসেন্ট টাউনেই থাকে। এই শহরে পিন্টুর বন্ধু বান্ধব এবং পরিচিত মানূষের সংখ্যা অনেক থাকতে পারে কিন্তু তাদের মধ্যে কয় জন তার হয়ে এই ধরনের একটা অসামাজিক কাজ করবে?
হয়ত হাতে গোনা কয়েক জন। তাদের মধ্যে কাদের উপর পিন্টুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে সবচেয়ে বেশী? অবশ্যই তার উপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে। খানিকটা আন্দাজে আর খানিকটা ভাবনা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত এই রেস্টূরেন্টে আসার সিদ্ধান্ত নেয় সে। এখানে সুফি ছাড়াও আরোও চারজন নিয়মিত কাজ করে। বেথানি হচ্ছে ফুল টাইম ওয়েট্রেস, মধ্য ত্রিশ তার বয়েস, শহরের পূর্বে কোথাও থাকে।
সুন্দরী ভারতীয় বংশদ্ভুত হস্টেস মেয়েটার নাম লরা, বয়েস কালামের কাছাকাছি, সেনেকা কলেজে পড়াশোনা করে। মেয়েটার হাসিটা মন কাড়া আর যখনই হাসে চোখজোড়া যেন ঝলক দিয়ে ওঠে। প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কালাম। মেয়েটা অবস্থাপন্ন ঘরের। কিন্তু তারপরও নিজের টুইশন ফি নিজে দেবে বলে কাজ করে। সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে সে প্রথমেই বাদ।
দিনার হচ্ছে রেস্টুরেন্টের প্রধান শেফ, বলা যায় সে-ই এই রেস্টুরেন্টের প্রাণ কাঠি। উচ্চতায় বড় জোর পাঁচ ফুট, গাট্টা গোট্টা মানুষ, কিন্তু দেশী রান্নায় তার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। তাকে নিয়েই লাট্টু আহমেদ এই রেস্টুরেন্টের শুরু করেছিলেন। দিনার তার সাথেই রয়ে গেছে। উপামহাদেশীয় বিভিন্ন জাতীয় খাদ্যের উপর ভিত্তি করে সে মুখরোচক মেনু তৈরী করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়, তার খাবার খেয়ে সবাই প্রশংসায় উচ্চমুখ। কিন্তু তারপরও ধীরে ধীরে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা পড়ে যাচ্ছে যদিও তাতে দিনারে মর্যাদা কমে নি। বাবার কাছ থেকে রেস্টুরেন্টের দায়িত্ব নেবার পর পিন্টূ দিনারকে খুশী রাখার জন্য ভালো বেতন দিচ্ছে কিন্তু অন্যদেরকে সে অবহেলা করে। এটা নিয়ে সবাই অল্প বিস্তর ক্ষুব্ধ। অন্তত সুফির ভাষ্য অনুযায়ী। দিনার যে কারণে খুব হাব ভাব নিয়ে চলে, তার আচার আচরণ দেখলে যে কারো শরীর জ্বলে যাবে। রেস্টুরেন্টের অন্য কর্মীরা তার সাথে মানিয়ে নেয় এক রকম বাধ্য হয়ে। কে অকারণে কাজ হারাতে চায়?
দিনারের দুঃসম্পর্কের ভাই হচ্ছে জাহান, ছাব্বিশ-সাতাশ হবে বয়েস, এখানকার এসিস্ট্যান্ট শেফ। দিনারকে খুটিনাটী সাহায্য করাই তার কাজ, আর যেদিন দিনার আসে না সেদিন সে শেফ হয়। তেমন দিন কালে ভদ্রে আসে। তার রান্নার ব্যুতপত্তির উপর কারোরই কোন বিশ্বাস নেই।
এই লোকটাই তার সন্দেহের তালিকায় প্রথম। সুফির কাছ থেকে তার সম্বন্ধে যা সে শুনেছে তাতে কালামের ধারনা আরোও বদ্ধপরিকর হয়েছে।
গলিতে ওদের একটা আড্ডার মাঝে সুফি একদিন একটা সিগ্রেট ধরিয়ে খুব আয়েস করে একটা টান দিয়ে বলল, “দিনারের নামের পেছনের ইতিহাস জানতে চাও?”
কালাম কাঁধ ঝাঁকায়। দিনার কোথায় থাকে সেটা জানতেই ওর আগ্রহ বেশী কিন্তু ঝট করে সেই প্রশ্ন করে সবার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে চায় না। মাত্র সপ্তা খানেক হয়েছে এখানে যোগ দিয়েছে, কার সাথে কার কেমন সম্পর্ক এখনও বোঝার অবসর হয়ে ওঠেনি।
“ওর বাবা কুয়েতে ড্রাইভার হিসাবে কাজ করত,” কালামের মৌণতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে গল্প শুরু করে সুফি। “ওর মা গ্রামে থেকে যায়। ওর বাবা দেশে বেড়াতে আসে, যা করার তাই করে এবং ওর মা অন্তস্বত্তা হয়। ওদের পরিবারের আবার বেশ কয়েকটা গরু ছিল। কুয়েতের টাকা দিয়ে ওর বাবাই কিনেছিল। তার মধ্যে কয়েকটা গাভীও ছিল। একটা গাভীও সেই সময় অন্তস্বত্তা ছিল। ওর বাবা ফিরে যায় কুয়েতে। সাত মাস পরে ওর মা এবং গাভী দুজনেরই একই সাথে বাচ্চা হয়। বাছুরটা সময় মতই হয়েছিল, কিন্তু দিনার মাস দুয়েক আগেই বেরিয়ে গেছে। যে কারণে যখন ওর মা কুয়েতে তার স্বামীকে ফোন করে বলল, ‘বাচ্চা হয়ে গেছে’ সে ভাবল বোধহয় বাছুরের কথা বলছে। সে খুব উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওটার নাম দাও দিনার’ – কুয়েতের টাকার নাম। মা ভাবল তার স্বামী বোধহয় তাদের বাচ্চাটার কথা বলছে। সে তার নাম রাখল দিনার। বেচারা পুর দুই মাস আগে বেরিয়েছে, আচার আচরণে যে একটু গর্দভ গর্দভ হবে তাতে অবাক হবার কি আছে।”
কালাম গল্পটা বিশ্বাস করেনি কিন্তু তারপরও জোর করে হলেও খুব গলা খুলে হেসেছিল, সুফিকে খুশী করার জন্যই।
জাহান হয়ত ওর হাসির শব্দ শুনে থাকবে। সে দরজায় এসে উঁকি দেয়। “এতো হাসির ক হল?”
“কিছু না,” সুফি দ্রুত বলে।
“আপনাদের না কাজে ফেরার সময় হয়ে গেছে?” চলে যাবার আগে তিক্ত কন্ঠে বলে জাহান।
“এইতো আসছি,” সুফি জাহানের পেছনে মুখটাকে বিকৃত করে বলে। “দুই মুখো সাপ!” কালামকে লক্ষ্য করে ফিসফিস করে বলে। “ও থাকলে খুব সাবধানে কথা বার্তা বলবে। যা শোনে সব গিয়ে দিনারের কানে লাগায়।”
“তাই? আচ্ছা দিনার থাকে কোথায়?” কালাম এই সুযোগে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।
“সে তো ধণী মানুষ। পিকারিঙে তার নিজস্ব ডিটাচড বাড়ী আছে,” সুফি দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে। “সেই জন্যেই তো আমিও শেফ হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রান্নাবান্নাটা আমার ঠিক আসে না। তুমি যদি এই রেস্টুরেন্ট সংক্রান্ত কাজই করতে চাও তাহলে রানা বান্না শেখ।”
“সব কুকরাই কি ভালো টাকাপয়সা পায়?” জানতে চায় কালাম।
“আরে না!” সুফি মাথা নাড়ে। “দুই মুখো সাপ তো প্রায় কিছুই পায় না। সে থাকে এপার্টমেন্টে। ক্রিসেন্ট টাউনের কোন একটা বিল্ডিঙয়ের নীচের তলায় থাকে মনে হয়।”
কালামের বুকটা নেচে উঠেছিল সেই ক্ষণে। তোকে পেয়েছি শালা দুই মুখো সাপ! কিন্তু কে করছে জানা এক কথা আর তার মুখের উপর গিয়ে তাকে দোষারোপ করা আরেক কথা। জাহান বেশ লম্বা চওড়া, শক্তিশালী, খেলোয়াড়দের মত শরীর। শারীরিকভাবে তার সাথে পাল্লা দেয়াটা কালামের জন্য ঠিক সম্ভব হবে না। অন্য কোনভাবে ব্যাটাকে নাজেহাল করে গভীর রাতের বিটলামীটা বন্ধ করতে বাধ্য করতে হবে।
৩৯.
লিয়াকতকে ওর কাজের জায়গা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে দুপরের দিকে আবু বকর মসজিদে গেল রিমা। লরেন্স এভ আর মিডল্যন্ড এভের ইন্টারসেকশনে অবস্থিত মসজিদটা। সেখানে জোহরের নামাজ হয় একটার দিকে। আহমেদ সাধারণত চলে আসেন তার বেশ আগেই। রিমা এমন জায়গায় গাড়ী রেখেছে যেখান থেক মসজিদে যারা ঢূকবে তাদেরকে সে দেখতে পাবে। ওদেরকে খুব বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। নিজের গাড়ী থেকে নেমে লিয়াকতকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব বিস্মিত হলেন তিনি। “আরে লিয়াকত, তুমি এই সময়ে এখানে কি করছ?”
লিয়াকর মাথা চুলকায়। “চাচা, আমার সাথে রিমা ভাবি আছে। আপনার সাথে একটু কথা বলতে চায়।”
মিন্টুর সাথে বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে যাই ঘটে থাকুক না কেন আহমেদ রিমাকে পছন্দ করেন। খুব কঠিন মেয়ে। মেয়েটার প্রতি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ আছে। “কোথায় ও?”
ফুট পঞ্চাশেক দূরে একটা গাড়ীর দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে লিয়াকত। আহমেদ তাকে সঙ্গে আসতে বলে রিমার গাড়ীর দিকে বড় বড় পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। রিমা তাকে দেখে গাড়ী থেকে নীচে নেমে এসে সালাম দিল।
“কেমন আছো, রিমা?” আহমেদ জানতে চাইলেন।
রিমা কাঁধ ঝাঁকাল। “আব্বা, আপনার সাথে আমার খুব জরুরী কথা আছে। গাড়ীর ভেতরে এসে একটু বসবেন? আমি চাই না অন্য কেউ শুনুক।”
আহমেদ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ইতিমধ্যেই মনে হল সমস্যাটা কাকে নিয়ে হতে পারে তিনি খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। তিনি সামনে প্যাসেঞ্জার সীটে উঠে বসলেন। রিমা ড্রাইভিং সীটে বসল। লিয়াকত বসল পেছনে। রিমা সব জানালা তুলে দিল।
“আব্বা, আপনাকে যেভাবে হোক এই শয়তানী বন্ধ করাতে হবে,” রিমা আকুতি নিয়ে বলে। “পিন্টূ এবার আমার বাচ্চাদের পেছনে লেগেছে। আমি এখনও পুলিশ ডাকি নি। আগে আপনার কাছে এসেছি। ও যদি এখনও ক্ষান্ত না দেয় তাহলে আমাদের সবার জীবন নষ্ট হবে।”
আহমেদ আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। “বিশ্বাস কর, এই সব ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। ওরা জানে আমি এই সব ফাজলামী সহ্য করব না যেকারণে আমাকে আর কিছু বলে না। যাই হোক, আমাকে খুলে বল কি সমস্যা হয়েছে।”
রিমা ওর সন্দেহের কারণটা সবিস্তারে বর্ণনা দিল। লোক দুইটার চেহারার বর্ণনা শুনে মাথা নাড়লেন আহমেদ। তিনি ওদেরকে চেনেন না। বললেন পিন্টূর সাথে এটা নিয়ে কথা বলে কোন লাভই হবে না। সে সব কিছু অস্বীকার করবে। “আমি এই ব্যপারে তোমাকে তেমন কোন সাহায্যই করতে পারব না,” তিনি অকপটে স্বীকার করলেন। “কিন্তু কে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে আমি জানি। তোমার শ্বাশ্বুড়ির সাথে আলাপ কর। পিন্টু মায়ের কথা শোনে। এখনই যাও। বাসায় সে একা আছে। এখনই তার সাথে কথা বলার ভালো সময়।”
রিমা খুব একটা ভরসা পায় না। “আম্মা কথা বলবেন আমার সাথে?”
আহমেদ মাথা দোলালেন। “বলবে। সে হচ্ছে রাজনীতিবিদ। কথা বলাই তার কাজ।”
আহমেদ গাড়ি থেকে নেমে মসজিদের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। রিমা লিয়াকতের দিকে তাকাল, তারপর ঝট করেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে গাড়ী পেছালো, ঘুরিয়ে রাস্তায় নামল তারপর সামনে ছুটিয়ে দিল। যদি এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাবার জন্য স্বয়ং শয়তানের সাথে সাক্ষাৎ করতে হয় তাও সে করবে।
আহমেদ নিবাসে পৌঁছে বাসার সামনে পর্শাটাকে ড্রাইভয়েতে পার্ক করা দেখে একটু ভড়কে গেল রিমা। লাট্টূর ভাষ্য অনুযায়ী এই সময়ে পিন্টূ বাসায় থাকে না। হতে পারে মরিয়ম আজকে রেস্টূরেন্টে লাঞ্চের সময় কাজ করছে, পিন্টূ রাতে সামলাবে। যেহেতু বাচ্চা কাচ্চা আছে সেটাই তো করা উচিৎ। রাতে মরিয়ম বাচ্চাদের দেখভাল করতে পারে।
“ও থাকলেই ভালো,” লিয়াকত গাড়ি থেকে নীচে নামতে নামতে বলে। “মা ছেলে সাধারণত এক জোট হয়েই কাজ করে।”
রিমা মাথা দোলায়। “জানি। যেমন মা তেমন ছেলে। কিন্তু আমাদেরকে খুব ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। নতুন কোন ঝামেলা চাই না আমি।”
“আমি বীর পুরুষ নই,” লিয়াকত ভয়ে ভয়ে বলে। “পিন্টূ মানুষকে ইজ্জত দিতে জানে না। মিন্টুও ওকে পছন্দ করত না। ভালবাসত অবশ্য- যেহেতু একমাত্র ভাই ছিল।”
লিয়াকতের আগে আগে হেঁটে দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজাল রিমা। এই বাসায় ক্যামেরা সহ মনিটরিং সিস্টেম আছে। বুঝতে পারল ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যন্ত্রণাদায়ক একটা মিনিট পেরিয়ে গেল। তারপর জীবন্ত হয়ে উঠল ইন্টারকম। “কে?” নীতার কন্ঠ।
রিমা কেশে গলা পরিষ্কার করে। “আমি রিমা।”
বিয়ের পর যখন মিন্টু তার পরিবারের সাথে রিমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তখন প্রথাগতভাবে নীতাকে আম্মা বলে ডেকেছিল রিমা। ততদিনে সেই বিয়েতে তার অমত প্রকাশ করতে কোন রকম দ্বিধা করেন নি নীতা। রিমার ডাকে তিনি কোন সাড়াই দেননি। একমাত্র আহমেদই তার প্রতি খানিকটা সহানুভুতি দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। আজ নীতাকে কি বলে সম্বোধন করবে বুঝতে পারে না রিমা।
ইন্টারকম অল্প কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায়। “আচ্ছা! পিন্টু! দরজাটা খুলে দিবি?” তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “এখানে এসেছে কি জন্যে আবার?”
রিমা চেষ্টা করে এইসব গায়ে না মাখতে। আজ ও এখানে এসেছে এই উন্মাদনা বন্ধ করতে। তাকে যতই অপমান করা হোক সে সেই সব একেবারেই গায়ে মাখবে না। প্রায় মিনিট খানেক পর দরজার দিকে একটা পদক্ষেপ এগিয়ে আসতে শুনল ওরা, দরজার তালা খোলার শব্দ শোনা গেল, ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা খুলে ওদের দু জনার দিকে শীতল, ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকাল পিন্টু।
“এই পিন্টু! কেমন আছো?” লিয়াকত চেষ্টা করে তার কন্ঠস্বর সহজ রাখতে।
“আছি ভালোই,” পিন্টু তেমন কোন আবেগ দেখায় না। “এই মহিলা এখানে কি করছে? আমার বিরুদ্ধে তার না একটা রেস্ট্রেইনিং অর্ডার আছে? তার এক শ ফুটের মধ্যে আমার থাকার নিয়ম নেই। এতো একেবারে মুখোমুখি!”
রিমা খোচাটা গায়ে নিল না। “আম্মার সাথে কথা বলতে চাই।”
“আম্মা! আচ্ছা!” পিন্টু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। “ভেতরে আসুন মহারাণী!” এক পাশে সরে গিয়ে ওদেরকে ভেতরে ঢোকার পথ দেয় পিন্টূ, পরে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। তারপর খুব ঢং করে ওদেরকে রাজকীয় কায়দায় নীতার কামরার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। নিজের কামরায় জানালার সামনে রাখা একটা লেদার সোফা চেয়ারে বসে ছিলেন নীতা, বাইরের রোদটা তার গায়ে এসে পড়ছে, ভালোই লাগছে আঁতটুকু। ওদের উপস্থিতি টের পেলেও ফিরেও তাকালেন না।
“সালাম চাচী,” লিয়াকত নরম গলায় বলে। সেই কলেজ জীবন থেকে নীতাকে চেনে সে। ঢাকায় থাকতে মিন্টুর ঘনিষ্ট বন্ধু বিধায় প্রায়ই তাদের বাসায় হুট হাট করে গিয়ে হাজির হত। একটা সময় ছিল যখন নীতা তাকে খুব পছন্দ করতেন এবং তার বড় ছেলের সাথে তার বন্ধুত্বকে একটা মূল্য দিতেন। কিন্তু সেই সব ভালোবাসা মিন্টু রিমাকে বিয়ে করার পর ঝট করেই উবে যায়। মিন্টুর সাথে সাথে লিয়াকতও তার কাছে হয়ে ওঠে অবাঞ্ছিত।
– টরন্টো, কানাডা