
সুহেল ইবনে ইসহাক, টরন্টো, কানাডা: ভ্যাকসিন বিতরণের প্রশ্নে সব দেশে বহু মানুষের মনে এখন একটাই বড় প্রশ্ন- আমার টিকা হবে তো? আমি কখন টিকা পাব? হাতে গোণা কয়েকটি দেশ টিকাদান কর্মসূচির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এগোচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে এই চিত্র পরিষ্কার নয়। আমরা কী জানতে পারছি? বিশ্বের সব দেশের মানুষকে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় আনার উপরই আমাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।
কিন্তু টিকা পৌঁছে দেবার গোটা প্রক্রিয়াটা খুবই জটিল। এর সাথে জড়িয়ে আছে নানা জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারের অনেক পরস্পরবিরোধী প্রতিশ্রæতি, বিশাল আমলাতান্ত্রিক বেড়াজাল এবং বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ নীতি। এসবের ফলে সারা বিশ্বে সবার কাছে টিকা কখন ও কীভাবে পৌঁছে দেয়া হবে সেটা নিরূপণ করা খুব সহজ নয়।
ইকোনমিস্ট ইন্টালিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর বৈশ্বিক পূর্বাভাস বিভাগের পরিচালক আগাথ দ্যেমারে এ বিষয়ে সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক কিছু গবেষণার কাজ করেছেন।
এই টিকা সব মানুষের বাহুতে পৌঁছে দেবার জন্য বিশ্ব সর্বমোট কত পরিমাণ টিকা উৎপাদন করতে সক্ষম এবং পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যসেবা দেবার অবকাঠামো কী ধরনের সে নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে ইআইইউ। পাশাপাশি এই গবেষণায় তারা আমলে নিয়েছে কোন্ দেশের জনসংখ্যা কত এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আর্থিক সামর্থ্য কতটা।
তাদের গবেষণার ফলাফলে স্বাভাবিকভাবেই যে চিত্রটা বেরিয়ে এসেছে সেটা হল ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর সক্ষমতায় বৈষম্য। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ টিকার সরবরাহ রয়েছে আমেরিকা আর ব্রিটেনের কাছে। কারণ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজে তারা সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে পেরেছে, ফলে ভ্যাকসিন প্রাপকদের তালিকায় তারা শীর্ষে জায়গা করে নিতে পেরেছে।
তাদের অল্প পেছনে রয়েছে অন্য কিছু ধনী দেশ যেমন কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটের দেশগুলো। (খবর: বি.বি.সি’র)
অনেক স্বল্প আয়ের দেশ টিকাদান এখনও শুরুই করতে পারেনি। তবে কিছু কিছু দেশ বিস্ময়করভাবে কর্মসূচি চালু করে দিয়েছে, বিশেষ করে মাঝামাঝি অবস্থানে যারা। কানাডার সব মানুষকে টিকা দেবার জন্য যত ভ্যাকসিন প্রয়োজন দেশটি তার পাঁচ গুণ বেশি টিকা কেনায় গত বছরের শেষ দিকে সমালোচনার মুখে পড়ে কানাডা। তবে যেটা দেখা যায় যে, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা পাবার তালিকায় তারা নাম লেখায়নি।
এর কারণ হল, কানাডার একটা উদ্বেগ ছিল যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ক্ষমতায় থাকলে আমেরিকা রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা বসাবে আর সেই উদ্বেগ থেকে কানাডা ইউরোপের ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কারখানাগুলোয় অর্থ লগ্নীর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তাদের সেই সিদ্ধান্ত সুবিবেচনার হয়নি।
ইউরোপের কারখানাগুলো এখন টিকা সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং স¤প্রতি দেখা গেছে, আমেরিকা নয় বরং ইইউ-ই রফতানির ওপর এখন নিষেধাজ্ঞা জারির হুমকি দিয়েছে। “ইউরোপের বাজারে যথেষ্ট পরিমাণ টিকা যতদিন থাকবে না, ততদিন কানাডার জন্য বড়ধরনের আমদানির পথ বন্ধ থাকবে,” বলছেন মিজ আগাথ দ্যেমারে। তবে কিছু কিছু দেশ, যা আশা করা হয়েছিল, তার থেকে অনেক ভাল করছে।
২২ মার্চের সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনে ডোজ পেয়েছে ৩৭.২,এবং সর্বমোট ডোজ পেয়েছে ১২৪,৪৮১,৪১২ জন। চিনে প্রতি ১০০ জনে ডোজ পেয়েছে ৫.২,এবং সর্বমোট ডোজ পেয়েছে ৭৫,৩৪৬,৮৫৯ জন। ভারতে প্রতি ১০০ জনে ডোজ পেয়েছে ৩.৩, এবং সর্বমোট ডোজ পেয়েছে ৪৫,০৬৫,৯৯৮ জন। যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০০ জনে ডোজ পেয়েছে ৪৪.৭, এবং সর্বমোট ডোজ পেয়েছে ২৯,৮৫৯,৭৪২ জন। কানাডাতে প্রতি ১০০ জনে ডোজ পেয়েছে ১০.৫, এবং সর্বমোট ডোজ পেয়েছে ৩,৯৫৪,২৮৫ জন। বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে ডোজ পেয়েছে ২.৯, এবং সর্বমোট ডোজ ৪,৭৬০,৪৭৪ জন। (সূত্র: ওডাব্লিউআইডি, gov.uk ড্যাশবোর্ড, ওএনএস)
এই প্রতিবেদন লেখার সময়, জনগোষ্ঠীর শতকরা হিসাবের বিচারে সার্বিয়ার অবস্থান ছিল বিশ্ব তালিকায় আট নম্বরে। ইইউ-র যে কোন দেশের থেকে টিকাদানে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সার্বিয়া। তাদের সাফল্যের কারণ আংশিকভাবে টিকাদান কর্মসূচি দক্ষতার সাথে শুরু করা।
তবে তারা ভ্যাকসিন ক‚টনীতি থেকেও লাভবান হয়েছে। কারণ পূর্ব ইউরোপে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে রাশিয়া আর চীন। যে অল্প ক’টি দেশে রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক ভি এবং চীনা ভ্যাকসিন সাইনোফার্ম ইতোমধ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে, সার্বিয়া তার একটি।
কাগজপত্রে সার্বিয়ার জনগণকে পছন্দ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে তারা কোন্ টিকা নিতে চায়- ফাইজার, স্পুটনিক না সাইনোফার্ম। কিন্তু বাস্তবতা হল, বেশিরভাগ মানুষকেই দেয়া হচ্ছে সাইনোফার্ম ভ্যাকসিন। চীন চাইছে দেশটির বাজারে তাদের প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদী করতে। যেসব দেশ সাইনোফার্মের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা জনগণকে দেবে, তারা ভবিষ্যতে বুস্টার ডোজ দিতে চাইলে সেজন্যও তাদের চীনের মুখাপেক্ষী হতে হবে।
এদিকে, কানাডার প্রধান চারটি প্রদেশ অন্টারিও, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, আলবার্টা এবং কুইবেকে আশঙ্কাজনকভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
আর করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে হাসপাতাল, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ব্যাপকহারে চাপ পড়ছে। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ সরকারি বিভিন্ন বিধিনিষেধ দেওয়া সত্তে¡ও করোনাভাইরাস কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, কানাডায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সাত লাখ আট হাজার ৬১৯ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮ হাজার ১৪ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ছয় লাখ ১৫ হাজার ৩২৪ জন।
২১ মার্চ ২০২১ তারিখ পর্যন্ত মোট টেস্ট সম্পন্ন ২৬,৫৯২,৬২৬, মোট সিএসএস ৯৩৩৭৫, সক্রিয় সিএসএস ৩৫০০৯, কবিড-১৯ হতে উদ্ধার (রিকভার্ড) ৮৭৬,১০০, মৃত্যু ২২,৬৭৬ জন। (সূত্র : গভর্নমেন্ট অফ কানাডা ওয়েবসাইড)।
অন্টারিও প্রভিন্সে মোট কেইস ৩৩০,৬৭৩, রিসল্ভড ৩০৮৫৭৮, মৃত্যু ৭৭,২৪৪, হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮১৩, আইসিইউতে ২৯৮ এবং ভেন্ডিলেশনে আছেন ১৮৬ জন। (সূত্র : অন্টারিও গভর্নমেন্টের ওয়েবসাইড)।