ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩১তম আসরটি নভেম্বর মাসের ৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। অখিলবন্ধু ঘোষের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচক ছিলেন ভাষাবিদ, সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত সংগ্রাহক রাজীব চক্রবর্তী। রাজীব চক্রবর্তী নির্মল নাথ এর বই ‘আধুনিক বাংলা গান: স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্তে’র অখিলবন্ধু অধ্যায় এবং অন্য আরো নানান সূত্র ঘিরে, অখিলবন্ধু ঘোষের জীবন ও গান সম্পর্কে বিশদ বলেন। অখিলবন্ধু ঘোষের গাওয়া গান গেয়ে শোনান সঙ্গীত শিক্ষক ও সঙ্গীত শিল্পী সুমন চৌধুরী। তবলায় ছিলেন স্যামসন সরকার।
গত শতকের আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের বড়ো ও নামী শিল্পীদের কথা আমরা জানি। কিন্তু এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘শিল্পীদের শিল্পী’। তাঁর নাম – অখিলবন্ধু ঘোষ। অখিলবন্ধুর গানে পাই পরিমিত গলার কাজ, এর সঙ্গে দরদের মিশেল। এমন সুর-বয়ান কেবল ঐশ্বরিক কোনো কণ্ঠ-কারিগরের পক্ষেই সম্ভব। এমন মাদকতা আর কোনো শিল্পীর গলায় খুঁজে পাওয়া ভার। অখিলবন্ধুর গান তো গান না, যেন হৃদয়ের কান্না, যেন নিবিড় আর্তি, যেন আত্মনিবেদন। হৃদয়ের গভীরতম অংশে গিয়ে স্পর্শ করে তাঁর গান, তাঁর সুর। বাংলা গানের ইতিহাসের বেশ কয়েকটি মাইলস্টোন গান তাঁর গাওয়া, তাঁর সুর করা। বাংলা আধুনিক গানকে রাগাশ্রয়ী করে তোলার অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, অসাধারণ শিল্পী ও সুরস্রষ্টা অখিলবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় এবং পরেও অনেকটা ব্রাত্যই থেকে গেছেন। তবে প্রচারবিমুখ এই শিল্পী স্বীকৃতির পেছনে একদমই ছোটেননি। এমন আত্মভোলা, সাধক শিল্পী বহু যুগে একবারই আসে। তিনি বিয়োগান্তক সুর-গল্পের এক মহানায়ক, এক যুগন্ধর গায়ক।
বাংলা গানের ধ্রুবতারা, ক্ষণজন্মা, আত্মমগ্ন, ধ্যানী এই দরদী-অতুলনীয়-কালজয়ী-যাদুকরী কণ্ঠের স্বতন্ত্র-সাধক গায়কের জন্মশতবর্ষে, পাঠশালার এবারের আয়োজন ছিল অখিলবন্ধুর জীবন ও গান ঘিরে।
আসরের শুরুতেই শিল্পী সুমন চৌধুরী অখিলবন্ধুর খুব প্রিয় শ্যামকল্যাণ রাগে ‘রসঘন শ্যাম কল্যাণ সুন্দর’ নজরুলগীতিটি পরিবেশন করেন। অখিলবন্ধুর কণ্ঠে নজরুলগীতি এক অনন্য মাত্রা পেয়েছিল। অখিলবন্ধু জীবনের শেষদিকে মঞ্চে নজরুলগীতি গাইতেন খুব।
আলোচক রাজীব চক্রবর্তী বলেন, অখিলবন্ধু ঘোষ আমাদের সবার প্রাণের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। অখিলবন্ধু যে গানই গেয়েছেন, সেটাই রসোত্তীর্ণ হয়েছে। ফলে তাঁকে নিয়ে বলা, তাঁর গান নিয়ে বলা খুব কঠিন কাজ এবং তাঁর গানের মধ্যে এমনভাবে হারিয়ে যেতে হয় যে, নৈর্বক্তিকভাবে কাজ করাও খুব কঠিন। তবে বাঙালির একটা দায়বদ্ধতা আছে অখিলবন্ধুর প্রতি। ১৯২০ সালে অখিলবন্ধুর জন্ম। ২০২০ এ তাঁর ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১০১ বছরও পূর্ণ হয়ে গেছে। আমরা কিন্তু দেখিনি যে, অখিলবন্ধুকে নিয়ে সেভাবে কোনো আয়োজন হয়েছে কিংবা আমরা কেউ করে উঠতে পেরেছি। বলা হয়ে থাকে যে, আমরা তাঁকে উপেক্ষা করেছি, তিনি উপেক্ষিত ছিলেন। কিন্তু এই কথাগুলো তো আমরাই বলি। আমরা কি সেই দায় মোচনের জন্য চেষ্টা করেছি? করিনি।
আলোচক রাজীব অখিলবন্ধুর জীবন নিয়ে, তাঁর গান নিয়ে একটা উপস্থাপনা পরিবেশন করেন। তাতে করে এমন কিছু কিছু গানও শোনানো হয়, যেগুলো অখিলবন্ধুর চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। রাজীবের পরিবেশনাটির মাধ্যমে অখিলবন্ধুর জীবনের একটা সামগ্রিক পরিচয় উঠে আসে।
রাজীব শুরুতেই মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একটি প্রাইভেট কনসার্টে তোলা অখিলবন্ধুর একটি দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখান। এই ছবি আগে কোথাও দেখা যায়নি। ছবিটি কোলকাতা বেতারের একসময়ের অত্যন্ত নিবিষ্ট কর্মী, বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী ভবেশ দাশের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পাওয়া।
রাজীব বলেন, অখিলবন্ধু আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। আমরা তাঁকে ভুলে গিয়েছিলাম প্রায়। সেই ভুলে যাওয়ার হাত থেকে যে মানুষটি প্রথম আমাদের মনে করিয়েছিলেন অখিলবন্ধুর কথা, তাঁর নাম সুমন চট্টোপাধ্যায় (কবীর সুমন)। অখিলবন্ধু মারা যান ১৯৮৮ সালে, ৬৭ বছর ৫ মাস বয়সে। অখিলবন্ধুর মৃত্যুর ৫ বছর পরে, সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি গানে অখিলবন্ধুকে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন। এ পর্যায়ে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সেই গানটি – ‘বয়েস আমার মুখের রেখায় শেখায় আজব ত্রিকোণমিতি- একলা লাগার সময় মানে নিজের সঙ্গে কথা বলা, তারই ফাঁকে কোথায় যেন অখিলবন্ধু ঘোষের গলা’ গানটির কিছু অংশ শোনানো হয়। সুমনের গানের কথায় সুর মিলিয়ে রাজীব বলেন, আমাদের যখন একলা লাগে, আমরা যখন একা হয়ে যাই, তখন অখিলবন্ধু ঘোষের গান আমাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে।
আলোচক বলেন, আমরা যখন ছোটো থেকে বড়ো হয়ে উঠছি, যাদের জন্ম ১৯৭০ ও ৮০র দশকে, আমরা বেড়ে উঠেছি অখিলবন্ধু ঘোষের গানের সময়। কোলকাতা বেতার থেকে অনবরত অখিলবন্ধু ঘোষের গান আমরা শুনেছি। কতো গান ছিল তার মধ্যে। শুধু তো আধুনিক গান না, শুধুমাত্র নজরুলগীতি না, অখিলবন্ধু রীতিমতো একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইয়ে ছিলেন। তিনি রেডিওতে খেয়াল, ঠুমরি, কীর্তন, ভজন, গীতসহ বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন এবং গেয়েছেন দাপটের সঙ্গে। আমরা সেই গান শুনে বড়ো হয়েছি। আরেকটা স্মৃতিও আমাদের আছে। আমরা যারা ক্যাসেটের যুগ থেকে বড়ো হয়ে উঠেছি, তাদের মনে আছে নিশ্চয়ই যে, যে সময় ক্যাসেট বাজারে আসছে, সে সময় রেকর্ড বাজার থেকে বিদায় নিচ্ছে। এইরকম একটা সন্ধিক্ষণের সাক্ষী আমরা। সেই রেকর্ডের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয় লং প্লেতে অখিলবন্ধু ঘোষের ‘ও দয়াল বিচার করো’ গানটি শোনানোর মধ্য দিয়ে। গানটি ১৯৬১ সালে মেগাফোন কোম্পানি থেকে বের হয়। রেকর্ড নাম্বার জেএমজি ৬১১৭। এটি পুলক বন্দোপাধ্যায় ও অখিলবন্ধুর যুগলবন্দী। অখিলবন্ধু তাঁর যাত্রাপথে বহু সুরকার, বহু গীতিকারের গান গলায় তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে অখিলবন্ধুর রসায়ন সবথেকে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল এবং পুলকের প্রায় সমস্ত গান অখিলবন্ধুর সুর করা। কিছু কিছু গান সুর করেছিলেন অখিলবন্ধুর স্ত্রী দীপালি ঘোষ।
আমরা প্রায়ই অভিযোগ শুনি যে, অখিলবন্ধু ঘোষ উপেক্ষিত, শতবর্ষ অতিক্রম করেও। কিন্তু এই উপেক্ষার কথা বলা এবং উপেক্ষার জন্য চোখের জল ফেলা, তাতে করে উপেক্ষার অবসান হয় না। এর জন্য দরকার তাঁকে নিয়ে চর্চা করা, তাঁর জীবন সম্পর্কে জানা।
এ পর্যায়ে আলোচক রাজীব অখিলবন্ধুর জীবনের কিছু প্রাথমিক তথ্য তুলে ধরেন। ২০শে অক্টোবর ১৯২০ সালে ভবানীপুরে জন্ম অখিলবন্ধুর। তবে ওঁদের আদিবাড়ি রানাঘাটে, তারপর হুগলিতে। শোনা যায় শ্রী অরবিন্দ ঘোষের বংশধর অখিলবন্ধু ঘোষ। এই কথা শোনা গিয়েছিল শিল্পীর পত্নী দীপালি ঘোষের মুখ থেকে। অখিলবন্ধুর বাবা বামনদাস ঘোষ, মা মণিমালা ঘোষ। তিনি পড়াশুনা করেছেন ভবানীপুরে, নাসিরুদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে। ১৯৪৭ সালে বিয়ে করেন তাঁর ছাত্রী দীপালি ঘোষকে। দীপালি ঘোষ ছিলেন অসামান্য গুণী গায়িকা ও সুরকার।
১৯৪৪ সাল থেকে অখিলবন্ধু রেডিওতে গান গাইতে শুরু করেন প্রথাগত তালিম সহ। তখন তিনি তরুণ। ২৪ বছর বয়স মাত্র। আর এর মধ্যেই তিনি প্রথম শিক্ষা পান মামা কালিদাস গুহর কাছে। মামার কাছে গান শিখতে শিখতে তাঁর মনে হয়, গলার কিছুটা মহড়া দরকার এবং এর জন্য প্রয়োজন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা। সেইজন্য তিনি যান নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তারপর তারাপদ চক্রবর্তী, চিন্ময় লাহিড়ি এবং সবশেষে কেশব গণেশ ঢেকনের কাছে। এই কয়েকজনের কাছেই অখিলবন্ধুর প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা।
অখিলবন্ধুকে আমরা দেখেছি, কোনোদিনই তিনি তাঁর নিজের শিক্ষা, নিজের গান, নিজের শিল্পকৃতি নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিভৃতচারী একজন মানুষ, অন্তর্মুখী মানুষ, সঙ্গীতে আপাদমস্তক নিমজ্জিত। মানুষটি সারাজীবন অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন বাঙালিকে। বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্পদ হয়ে রয়েছে সেগুলো। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি কিছুটা অনাদরে, অবহেলায় এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে ৬৭ বছর ৫ মাস বয়সে তিনি চলে যান। অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন অন্ডালে। ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা হয়নি। সেখান থেকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেইখানেই তাঁর মৃত্যু হয় ২০শে মার্চ ১৯৮৮ সালে। কিন্তু ততদিনে তিনি শরীরে, মনে সম্পূর্ণ ধ্বস্ত, জীর্ণ একজন মানুষ। তাই আমাদের কাজ শুধুমাত্র অখিলবন্ধুর অপ্রাপ্তি নিয়ে দুঃখ করা না বরং তাঁর শিল্পকৃতি নিয়ে আলোচনা করা, চর্চা করা এবং তাঁর যে সঙ্গীতের বোধ সেটি নিজেদের মধ্যে তুলে নেওয়া। সেটাই আমাদের সবথেকে বড়ো দায়িত্ব। এ পর্যায়ে নির্মল নাথ এর ‘আধুনিক বাংলা গান: স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্ত’ বই থেকে একটি অংশ পড়ে শোনানো হয়, যেটি থেকে বোঝা যায় অখিলবন্ধু ঠিক কী অবস্থার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। “এক শীতের সকাল। একদিন প্রাতঃভ্রমণকারী এক ভদ্রলোক দেখলেন ওই আলো না ফোটা ভোরে রাসবিহারী এভেনিউ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলেছেন অখিলবন্ধু ঘোষ। কৌতুহলবশত ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনাকে এত সকালে কোনওদিন এদিকে দেখিনি। আপনি তো থাকেন ভবানীপুরের স্কুল রোতে। আজ এদিকে?’ অখিলবন্ধু ঘোষ বললেন, ‘আমার প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস নেই। বালীগঞ্জে একটা ফাংশন ছিল। আমাকে অনেক রাতে গাইতে দিয়েছিল। তারপর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা নেই দেখে হেঁটেই ফিরছি।’ “এইরকমভাবেই অখিলবন্ধুর জীবনের বহু রাত কেটেছে। হেঁটে যাওয়া, হেঁটে ফেরা, উপেক্ষা নিয়েই তাঁকে ফিরতে হয়েছে। পৃথিবী থেকেও তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে।
এ পর্যায়ে সুমন চৌধুরী পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধুর সুরে অখিলবন্ধু ঘোষের বিখ্যাত গান ‘ও দয়াল বিচার করো’ (১৯৬১) ও শান্তি ভট্টাচার্যের কথায় অখিলবন্ধুর সুরে ‘শিপ্রা নদীর তীরে’ (১৯৫৪) গেয়ে শোনান। নির্মল নাথের বই ‘আধুনিক বাংলা গান: স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্ত’তে ‘ও দয়াল বিচার করো’ গানটির কথা আছে: “১৯৬০ সালে অখিলবন্ধু ঘোষ ‘ও দয়াল বিচার করো’ গানটি গাওয়ার দু’বছর আগেই ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না দে গেয়েছিলেন ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’। দুটি গানের ভিন্ন আবেদন। কিন্তু মান্না দে’র গাওয়া ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ এর মতো ক্লাসিক গানটির ব্যাপক জনপ্রিয়তার পরে পরেই গাওয়া ‘ও দয়াল বিচার করো’ গানটি ঢাকা পড়ে গেল না। এরকম একটা চ্যালেঞ্জ কতজন নিতে পারতেন সন্দেহ আছে। অখিলবন্ধু ঘোষ তাঁর গানটিকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন যে, মান্না দে’র গাওয়া গানটির মতোই অখিলবন্ধু ঘোষের গানটিও মানুষের মনে গেঁথে গেল। পাশাপাশি দুটি গান কালজয়ী সৃষ্টি হয়ে রইল। তাও অখিলবন্ধু ঘোষের গানটি কোনও সিনেমার নয়।”
আলোচক রাজীব অখিলবন্ধু যাঁদের কাছে সাঙ্গীতিক শিক্ষা নিয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তারাপদ চক্রবর্তী ছিলেন অখিলবন্ধুর অন্যতম গুরু। তার আগে তিনি শিখেছেন নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। নিরাপদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাসটাই এইরকম। ঠিকঠাকভাবে ইতিহাস চর্চা আমরা করি না, ইতিহাস রক্ষাও করি না। তার ফলে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে অখিলবন্ধুর মতো একজন ছাত্র তৈরি হয়েছেন, অথচ তাঁর কথা জানার উপায় নেই আমাদের। তারাপদ চক্রবর্তীর জন্ম ফরিদপুরের কোটালিপাড়ায়। অসম্ভব নামী গাইয়ে ছিলেন। কোলকাতা বেতারে তবলাবাদক হিসেবে তাঁর জীবন শুরু। তারপর গানেও তিনি সমান দক্ষতা অর্জন করেন এবং ভারতবিখ্যাত শিল্পী হন। এ পর্যায়ে অখিলবন্ধুর গুরু তারাপদ চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘বনে বনে পাপিয়া বোলে’ গানটির কিছু অংশ শোনানো হয়। তারাপদ চক্রবর্তীর পরে অখিলবন্ধুর গুরু ছিলেন চিন্ময় লাহিড়ি (১৯১৬-১৯৮৪)। অখিলবন্ধুর মৃত্যুর মাত্র ৪ বছর আগে তিনি মারা যান। চিন্ময় লাহিড়ির জন্মও অখিলবন্ধুর জন্মের ঠিক ৪ বছর আগে। কী অদ্ভুত সমাপতন! চিন্ময় লাহিড়িও একজন যুগন্ধর গায়ক ছিলেন। অসামান্য সব গান গেয়েছেন। আমরা জানি প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর এক অসামান্য গান ‘ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’ এর কথা। কাজেই দেখা যায় যে, নামী সব ঘরানাদার উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীদের কাছে অখিলবন্ধু তাঁর সাঙ্গীতিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এ পর্যায়ে চিন্ময় লাহিড়ির কণ্ঠে খাম্বাজ রাগের একটি ছোটো খেয়ালের কিছু অংশ বাজিয়ে শোনানো হয়।
অখিলবন্ধু ১৯৪৪ সাল থেকে বেতারে গান গাইতেন। আমাদের জানা মতে, তাঁর প্রথম রেকর্ড ১৯৪৭ সালে, মেগাফোন থেকে। কিন্তু তার আগেও নাকি দুটো গান তিনি এইচএমভিতে রেকর্ড করেছিলেন। সেটি কোনো কারণে বাজারে বের হয়নি। এ পর্যায়ে ব্যোমকেশ লাহিড়ির কথায় সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ১৯৪৭ সালের প্রথম রেকর্ডের অখিলবন্ধুর একটি গান ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল’ বাজিয়ে শোনানো হয়। অখিলবন্ধুর গান নিয়ে আমরা যারা চর্চা করি, এই গান সচরাচর আমরা শুনতে পাই না।
রাজীব বলেন, অখিলবন্ধু অনেকের সুরে গান করেছেন। এর মধ্যে প্রথম দিককার একজন অন্যতম সুরকার ছিলেন অনুপম ঘটক। অখিলবন্ধু অনুপম ঘটকের ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু সুরে গান গাওয়াও এক ধরনের শিক্ষা। অখিলবন্ধু কী ধরনের উত্তরাধিকার বহন করেছেন সেটি বোঝানোর জন্য এ পর্যায়ে অনুপম ঘটকের গান ‘চোখের জলে পূজব এবার উমা মায়ের চরণ দুটি’র কিছু অংশ বাজিয়ে শোনানো হয়। এরপর শোনানো হয় কমল ঘোষের কথায় অনুপম ঘটকের সুরে অখিলবন্ধুর গান ‘শ্রাবণ রজনী শেষে’। অখিলবন্ধুর এই রেকর্ডের দুটো গান অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। বিখ্যাত রেকর্ড সংগ্রাহক রন্তিদেব মৈত্রের সৌজন্যে গানদুটো প্রাপ্ত।
অখিলবন্ধুর বেশিরভাগ গানই বেরিয়েছিল মেগাফোন থেকে। এইচএমভি থেকে মাত্রই তিনটি রেকর্ড বের করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। আর হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে বেরিয়েছিল ৪টি। এর মধ্যে হিন্দুস্তান রেকর্ডের গানগুলো কিছুটা দুষ্প্রাপ্য। ১৯৪৯ সালের এই রেকর্ডের দুটো গান বিশেষভাবে দুষ্প্রাপ্য। অখিলবন্ধুপ্রেমী শ্রোতাদের অনেকেই আগে এই গানটি শোনেননি। মধুগুপ্তর কথায় ও অখিলবন্ধুর সুরে, এই গানটির চেয়েও আরো দুষ্প্রাপ্য একটি গান ‘আর তো চলে না রাধা শ্যাম অভিসারে’ শোনানো হয় তারপর। এটি অখিলবন্ধু ঘোষের প্রথম সুর করা গান এই অর্থে যে, বাজারে বেরিয়েছিল এই সুর করা গানটি প্রথম। এর আগে মেগাফোন থেকে যে গানটি তিনি সুর করেছিলেন, সেটি বাজারে এসেছিল পরে। তার আগেই এটি বাজারে এসেছিল। যে কারণে এটিই অখিলবন্ধুর প্রথম সুর করা প্রকাশিত গান এবং গানটি সত্যিকার অর্থেই দুষ্প্রাপ্য। এই গানটিও রন্তিদেব মৈত্রের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
রাজীব বলেন, অখিলবন্ধু নিজে সুর করেছেন অনেক। কিন্তু তাঁর একটি প্রিয় বিষয় ছিল বিভিন্ন শিল্পীর গান বিভিন্ন সময় গাওয়া। তাঁর অন্যতম প্রিয় এবং গুরুস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন শচীনদেব বর্মণ। শচীনদেব বর্মণের গান তিনি মাঝেমধ্যেই গলায় তুলে নিতেন এবং অনুকরণ করে গাইতেন। তবে শুধু শচীনদেব বর্মণের মতো প্রথিতযশা শিল্পীই না, নিজের চেয়ে বয়সে ছোটো, তরুণ শিল্পীদের গানও তিনি একইরকম মমতায় ও যত্নে গলায় তুলে নিতেন, রেডিওতে গাইতেন। তিনি অন্য অনেকের গান রেডিওতে গেয়ে সেগুলো আগে জনপ্রিয় করেছেন, পরে সেগুলোর রেকর্ড বেরিয়েছে। এই যে নিরহঙ্কারী একজন শিল্পী, শিল্পগতপ্রাণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি, এটিই তাঁর পরিচয় বহন করে। এ পর্যায়ে গায়ক মৃণাল চক্রবর্তীর আত্মজীবনী ‘খোলা জানালার ধারে’ থেকে এই অংশটি রাজীব পড়ে শোনান – “পেশাদার শিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করার শুরুর সময় থেকেই অখিলদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। দেখলেই একগাল হেসে সাগ্রহে খোঁজখবর নিতেন, সঙ্গে সঙ্গে নতুন গানের সুর বা সুর করার খবরই বলতে হত। ‘অহল্যা কন্যা’ ওঁর খুব পছন্দের গান ছিল। আমাদের চেয়ে অনেক সিনিয়র আর্টিস্ট। আমার বড়দার সঙ্গে একই সময়ে তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে যেতেন। পরে শুনেছি উনি বয়সে ধনঞ্জয়দার থেকেও কিছুটা বড় ছিলেন। আমার মতো একটা প্রায় মূর্খ গায়কের কাছে উনি নিজের আগ্রহে ‘অহল্যা কন্যা’ গানটি শিখেছিলেন, সেই বিস্ময় ও আনন্দের ঘোর আমার দীর্ঘদিন কাটেনি। কোথাও রেকর্ড করা নেই, কী করে বোঝাব উনি গানটা কী চমৎকার যে গাইতেন। পঞ্চাশের শুরুর দিকের ঘটনা এ-সব। কিন্তু তখনও জীবনের চিত্রনাট্যের কিছুটা অংশও দেখতে পাইনি। পরে, অনেক পরে, ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি অখিলদার কাছে গিয়েছিলাম ছোট ভাই ও ছাত্র হিসেবে। তারাপদ চক্রবর্তী, চিন্ময় লাহিড়ি, পণ্ডিত কে জি ঢেকনের ছাত্র অখিলদা রেডিওতে খেয়াল থেকে শুরু করে কীর্তন পর্যন্ত গাইতেন। সব গানই গাইতেন যথারীতি উঁচুমানের দক্ষতার সঙ্গে। উনি চিরকাল শচীনদেব বর্মণের ভক্ত, আমিও মনে মনে কত্তার স্টাইলে মজে থাকতাম। একেবারে খোলামেলা মনের মানুষ, কখনও কোথাও কোনও প্যাঁচ ছিল না। কারও ব্যবহারে আহত হলেও মুখে প্রকাশ করতেন না। সর্বদা গানের মধ্যে ডুবে থাকতে চাইতেন। বানিজ্য-বুদ্ধি, কথার প্যাঁচ – দুটোর একটাও তাঁর মধ্যে ছিল না। অত্যন্ত দরদী, সহানুভূতিসম্পন্ন মনের মানুষ ছিলেন।” শুধুমাত্র গানের কথা না, একজন মানুষের, একজন প্রকৃত শিল্পীর যে নিরহঙ্কারী স্বভাব হওয়া উচিৎ, চরিত্র হওয়া উচিৎ সেটি অখিলবন্ধুর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ছিল। জীবনের শেষের দিকে বিশেষত তাঁকে যে ভয়ানক দারিদ্র্যের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, সেটিও কিন্তু তাঁর এই মুখচোরা স্বভাবের জন্য। কোথাও নিজের দাবিটুকু তিনি জানাতে পারেননি। কোথাও বলতে পারেননি তাঁরও যে অর্থের দরকার। তাঁরও যে বেঁচে থাকার অধিকার আছে এটি কোথাও উচ্চকিত সুরে তিনি বলতে পারেননি। গানটাও তিনি আত্মনিমগ্ন হয়েই গাইতেন। উচ্চকিত মানুষ তিনি ছিলেনই না কখনো। গানের মতোই তাঁর জীবনযাপনও ছিল অনুচ্চকিত। নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়োজনটুকুও তিনি বলতে পারতেন না। যে কারণে এমন হয়েছে যে, তাঁর সঙ্গে অনেক তরুণ শিল্পী গাইতে গেছেন। তরুণ শিল্পী হয়তো পয়সা পেয়েছেন ভালোমতো কিন্তু তাঁর ভাগ্যে একটি ফুলের তোড়া ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। অখিলবন্ধুকে এভাবেই বহু অভিমান, বহু কষ্ট সহ্য করে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অখিলবন্ধুর মৃত্যুর কিছুদিন আগে কোলকাতা দূরদর্শনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও রতু মুখোপাধ্যায়। সেটিতেও দেখা যায় কতখানি নিভৃতচারী মানুষ তিনি। নিজের প্রয়োজনটুকু ঢেকে রেখে কথা বলতেন। নিজের সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলতেন না।
তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতকারী ছিলেন তাঁর স্ত্রী দীপালি ঘোষ। সেই সাক্ষাৎকারে রতু মুখোপাধ্যায় অখিলবন্ধুকে বলছেন, ‘বৌদিওতো আপনার অনেক গানে সুর করেছেন। সে সম্পর্কে বলুন।’ কিন্তু তিনি বলছেন ‘আমি কী বলব, তোমরাইতো বলবে।’ স্ত্রী সম্পর্কে বলেননি সে তো বড়ো কথা না। নিজের সম্পর্কেই তো বলেননি তিনি কখনো। এরকমই অনুচ্চকিত মানুষ ছিলেন তিনি সবসময়।
অখিলবন্ধু যে বিভিন্ন শিল্পীর গান গলায় তুলে নিতেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন শচীনদেব বর্মণ। শচীনদেব বর্মণের প্রভাব তাঁর সুরে কীভাবে পড়েছে সেটি দেখাতে এ পর্যায়ে শচীন দেবের ‘আহ্ বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ ও পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধুর সুরে অখিলবন্ধুর গাওয়া ‘ওই যাঃ আমি বলতে ভুলে গেছি সে যেন বাঁশি না বাজায়’ এই দুটো গানের প্রথম অংশ পরপর বাজিয়ে শোনানো হয়। শচীন তাঁর গানটিতে আহ্ বলে শুরু করছেন। ঐ স্টাইলটিই অখিলবন্ধু তাঁর এই গানটির মধ্যে নিয়ে এসেছেন একইরকমভাবে। এই প্রভাবগুলো এইভাবেই বয়ে চলে। শিল্পের প্রভাব তো ঐভাবে দেখানো যায় না কিন্তু এইভাবে বুঝে নিতে হয়।
এ পর্যায়ে সুমন চৌধুরী পরপর দুটো গান গেয়ে শোনান। একটি পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় দীপালি ঘোষের সুরে অখিলবন্ধুর বিখ্যাত গান ‘যেন কিছু মনে করো না’ এবং দ্বিতীয়টি একটি নজরুলগীতি ‘কুহু কুহু কোয়ালিয়া।’
অখিলবন্ধু অনেকের সঙ্গেই কাজ করেছেন, গান গেয়েছেন। কিন্তু অখিলবন্ধুর সুরে খুব বেশি মানুষ গান করেননি। এটা একটা দুঃখের বিষয়। এর কারণ জানা নেই। একমাত্র সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তিনটি গান অখিলবন্ধুর সুরে গেয়েছিলেন। এর মধ্যে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় একটিতে সুর বসিয়েছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। এ পর্যায়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার মনে নেই মন’ গানটি শোনানো হয়। অখিলবন্ধু খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, গীত, কীর্তন নানাকিছু গাইতেন এবং সেসব একেবারে পরিপূর্ণ মাত্রায় তিনি গেয়েছেন। কিন্তু সেগুলোর কোনো নিদর্শন আমাদের হাতে নেই। তাঁর আধুনিক গান, রাগপ্রধান কিছু নজরুলগীতি আর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আমাদের হাতে তাঁর অন্য গানের নিদর্শন খুব একটা নেই। খেয়াল ঠুমরির মতো, ভজনের মতো গান আমরা শুনিনি। কিন্তু এই অখিলবন্ধুর সুরেই কবীরের ভজন গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১৯৮৫ সালে। এ পর্যায়ে সেই গানটি ‘গুরু মোহে দে গ্যয়ে’ বাজিয়ে শোনানো হয়। গানটি শুনলে, এর সুর শুনলে বোঝা যায়, এই গানের সঙ্গে তিনি কতখানি ওতপ্রোত ছিলেন।
এ পর্যায়ে দূরদর্শনে প্রচারিত অখিলবন্ধুর সাক্ষাৎকার ‘কথায় ও সুর’ থেকে দীপালি ঘোষের সুরে ও পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধুর গাওয়া ‘যেন কিছু মনে করো না’ গানটি শোনানো হয়। গানটির চিত্রায়নে অসম্ভব মিষ্টি একটা দাম্পত্যের চিত্র আমরা পাই। একমাত্র অখিলবন্ধুর দিকে তাকিয়েই দীপালি এই দাম্পত্যে আগ্রহী হয়েছিলেন এবং সারাজীবন তাঁর সঙ্গে ছিলেন, অখিলবন্ধুকে ঘিরে রেখেছিলেন। অখিলবন্ধুর মতো প্রায় নিঃস্ব, দরিদ্র একজন গায়কের তিনি একজন কল্যাণী শক্তি হিসেবে ছিলেন সবসময়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই প্রসঙ্গে নির্মল নাথ এর বই ‘আধুনিক বাংলা গান: স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্ত’ থেকে এই অংশটি পড়ে শোনানো হয় – “অখিলবন্ধুর মতো রোমান্টিক গানগুলি এত সহজ অথচ এত মনের কথা মিশিয়ে দেওয়া, শোনার পর মনে হয়, সব গানই তিনি বুঝি স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে গাইছেন, একান্তভাবে তাঁর স্ত্রীর জন্যই। যেহেতু তাঁর বেশিরভাগ গানই পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা, তাই শব্দের ব্যবহারে কোনো আড়ম্বর নেই, একেবারে গল্প করতে করতে গাওয়া। এমনই একটি গান – ‘সেদিন চাঁদের আলো চেয়েছিল জানতে, ওর চেয়ে সুন্দর কেউ আছে কি? আমি তোমার কথা বলেছি।’ “অখিলবন্ধুর অস্তিত্ব, অখিলবন্ধুর শিল্পীসত্তার একটা বড়ো অংশ জুড়ে যেহেতু দীপালি ঘোষ আছেন তাই তাঁর সম্পর্কেও সবার জানা দরকার। সবসময় হয়ত তাঁরা নেপথ্যেই থেকে যান। এ পর্যায়ে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধুর সুরে ‘সেদিন চাঁদের আলো চেয়েছিল জানতে’ গানটি গেয়ে শোনান সুমন চৌধুরী।
এই গানের সূত্র ধরেই রাজীব বলেন, অখিলবন্ধু গান গেয়েছিলেন প্রথাগত তালিম পেয়েই। খেয়াল ঠুমরির মতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তিনি শিখেছেন, গলা তৈরি করেছেন, অত্যন্ত সমর্থ গায়ক ছিলেন। কিন্তু এই সামর্থ্যর প্রকাশ কখনো তাঁর গানের মধ্যে আসেনি, গানকে প্রভাবিত করেনি। তাঁর গান কখনোই কালোয়াতির একটা জায়গা হয়ে ওঠেনি। তাঁর গানের মধ্যে ছিল সহজ, নিয়ন্ত্রিত আবেগ। এই নিয়ন্ত্রণ একজন শিল্পীর সবচাইতে বড়ো সক্ষমতার পরিচয়, যেটা অখিলবন্ধুর ছিল।
আলোচক বলেন, অখিলবন্ধুর আধুনিক গান, নজরুলগীতি ইত্যাদি বিভিন্ন গানের পরিচয় আমরা পেয়েছি। রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন তিনি। অসম্ভব ভালো গাইতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর নানা স্মৃতি আমরা শুনতে পাই বিভিন্ন মানুষের কাছে। কিন্তু রেকর্ডে মাত্র দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরে রাখা আছে। তার মধ্যে একটি আর শুনতে পাওয়া যায় না। ১৯৬১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মেগাফোনে এই দুটো গান রেকর্ড হয়েছিল – ‘তুমি মোর পাও নাই পরিচয়’ এবং ‘কার মিলন চাও বিরহী’। আমরা জানি, ‘কার মিলন চাও বিরহী’ গানটি পরে একটি সংকলনে অনেকের গানের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। কিন্তু আলাদা করে এই রেকর্ডটি বাজারে আসেনি কখনো। যে কারণে একটি গান চিরতরে হারিয়ে গেছে। তবে সংকলনে যেটি আছে সেই গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।
এই প্রসঙ্গে একটি স্মৃতিচারণা পড়ে শোনান রাজীব। এই স্মৃতিচারণা খুব ব্যক্তিগত স্তরে লিখেছিলেন কোলকাতা দূরদর্শন ও কোলকাতা বেতারের নিবিষ্ট কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক ভবেশ দাশ। তিনি অখিলবন্ধুর মৃত্যুর কিছুদিন আগে অখিলবন্ধুকে তাঁর পারিবারিক বৃত্তে সংবর্ধিত করেছিলেন। সেই স্মৃতি লেখা রয়েছে এই স্মৃতিচারণে। “মনে আসছে ব্যক্তিগত স্মৃতি। অখিলবন্ধুর প্রয়াণের আগের বছর তাঁকে একটা পারিবারিক সংবর্ধনা প্রদানের সুযোগ ঘটেছিল আমাদের। ওঁর গানের এতটাই অনুরাগী ছিলাম, মনে হয়েছিল একবার যদি খুব কাছ থেকে আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান জানাতে পারি তো ভালো হয়। তখন আমি আকাশবাণীর সংবাদ বিভাগে কাজ করি। একদিন সংগীত বিভাগে গিয়ে তাঁর ঠিকানা জোগাড় করি। তখন সংগীত বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন প্রভাত ঘোষ। এক সন্ধ্যায় চলে যাই অখিলবন্ধু ঘোষের টার্ফ রোডের বাড়িতে। মুহূর্তেই চোখে পড়ল তীব্র দারিদ্র্য আর অর্থ কষ্টের ছাপ। নিশ্চয়ই আরও এমন অন্য শিল্পীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে, এখনও ঘটে চলেছে কিন্তু নিজের চোখে এমন অসহায় দারিদ্র্যের ছবি কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে আর দেখিনি। একটু ভুল হলো – দেখেছিলাম বেচু দত্ত-এর শেষ জীবনে। সেদিন অখিলবন্ধু স্মিত হাসি নিয়ে সস্ত্রীক সামনে এসে বসলেন। তাঁর ব্যবহারে মনে হলো আমি যেন তাঁদের কতদিনের চেনা। রাজি হয়ে গেলেন আমাদের পারিবারিক সংবর্ধনা প্রদানের প্রস্তাবে। বললেন, আমি সংবর্ধনার উত্তরে কি বা দিতে পারি একমাত্র গান ছাড়া! আমি বললাম, সে আপনার যতটুকু ইচ্ছে অবশ্যই গাইবেন। সেদিন কিছু গান করেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তাঁর বয়স তখন ৬৭। দাঁতের সমস্যা। কিন্তু গলা অকৃত্রিম, সুর আর স্বরের কারুকাজ অ¤øান, পরিবেশনায় সেই চোখ বুজে থাকা ধ্যানমগ্নতা। সময়টা ছিল পঁচিশে বৈশাখের কাছাকাছি। প্রথম গানটি গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি’ — আমার বিস্ময় আর আনন্দ দুটোই অশেষ। সেই প্রথম তাঁর গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনে মনে হলো সারাজীবন তো নজরুলের গান গেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের গান যদি গাইতেন, কী ক্ষতি হতো? পরে জেনেছি, বেশকিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন। একটি ছায়াছবিতে গেয়েছিলেন ‘কার মিলন চাও বিরহী’। কোনো সংকলনে একটি দুটি গান সম্ভবত রেকর্ডে আছে। তাছাড়া বিশ্বভারতী তাঁর গান অনুমোদন করেনি এমন অভিজ্ঞতাও তাঁর হয়েছে। অভিমানে হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান ওঁর সামনে বসে না শুনলে বোঝা যাবে না, সে-গানও তাঁর কতখানি আত্মগত। তাঁর এক ছাত্র একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কি আর রবীন্দ্রসংগীত গাও না?’ প্রশ্নের উত্তরে গেয়ে উঠেছিলেন ‘দীপ নিবে গেছে মম নিশীথ সমীরে’। তাঁর যেকোনো গানের সময় বই, গানের খাতা কোনোটাই দরকার হতো না। সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক গাইয়ের ক্ষেত্রেই আমরা বিপরীত ছবিটা দেখতে অভ্যস্ত।” অখিলবন্ধুর একটা ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব আন্তরিক মূল্যায়ন এই লেখায় আমরা পাই।
এ পর্যায়ে শিবকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা অখিলবন্ধু ঘোষের সুরে অখিলবন্ধুর আরেকটি দুষ্প্রাপ্য গান ‘গোকুল ছাড়িয়া কালা গেছে মথুরায়’ বাজিয়ে শোনানো হয়। অখিলবন্ধুর যে সমস্ত সংকলন এখন বাজারে পাওয়া যায় তার মধ্যে এটি নেই। এটিও রেকর্ড সংগ্রাহক রন্তিদেব মৈত্রের সৌজন্যে প্রাপ্ত। এর সময়কাল জানা যায় না, কারা বের করেছে তাও না। কারণ রেকর্ডটি এইচএমভির রেকর্ড না, কলম্বিয়ারও না, হিন্দুস্তান রেকর্ডেরও না, এমনকি মেগাফোনেরও না।
সুমন চৌধুরী এবারে গেয়ে শোনান পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধুর সুরে মাঝ- খাম্বাজ রাগে অখিলবন্ধুর অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ গানটি।
অখিলবন্ধুর জীবনে কয়েকটি মাত্র রেকর্ড বাজারে বেরিয়েছিল। সেই রেকর্ডের কিছু ছবি দেখিয়ে রাজীব বলেন, এই ছবিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ বর্তমানে এই রেকর্ড খুব বেশি লোকের কাছে নেই। আমাদের দেখার সুযোগও নেই। এইগুলোর মধ্য দিয়েই অখিলবন্ধু চিরজীবি, চিরযুবা হয়ে রয়েছেন আমাদের কাছে। নশ্বর দেহ তাঁর চলে গেছে কিন্তু মানুষটি এখনো রয়ে গেছেন এই রেকর্ডগুলোর মধ্য দিয়ে। কাজেই এই রেকর্ডগুলোর ছবি দেখাও এক ধরনের শুশ্রূষা আমাদের পক্ষে।
এরপর দূরদর্শনের ‘কথায় ও সুরে’ থেকে দুর্গা সেনের সুরে অখিলবন্ধুর গাওয়া গান ‘তুমি কি গো শুধু দূরে রবে সাথি গো মায়ামৃগ সম’ শোনানো হয়। এই গানটি শোনার অভিজ্ঞতা নিয়ে, আজকাল প্রকাশনী থেকে ২০০২ সালে প্রকাশিত জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘জলছবির রঙ’ থেকে এই অংশটি পড়ে শোনানো হয় – “চুঁচড়োর নানা প্রান্তে ছোট-বড় যত জলসা হবে খবর পেলেই সেখানে গিয়ে সবান্ধবে একেবারে সামনের দিকে বসা চাই। একটু পরের দিকে অর্থাৎ ১৯৫২-র শুরুর সময়ে, কলেজে ফোর্থ ইয়ারে পড়ি, হিসেবে রীতিমত প্রতিষ্ঠিত ‘হিরো’, তখন নিজেই জলসাতে গান করি, তাই সেই সময়ে জলসা শোনার ব্যাপারে উদ্যোক্তারাই ব্যবস্থা করে দিতেন। আমাদের বাড়ির কাছে যতদূর মনে পড়ছে আখনবাজারেই একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে এলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। রেডিও-তে তাঁর গান নিয়মিত শুনেছি, চোখে দেখা সেই প্রথম। আগে অনেক শিল্পী গাইলেন, তারপর একেবারে শেষদিকে অখিলবন্ধুর নাম ঘোষণা করা হল। প্রথম গানেই আমি প্রায় পাগল। গানটি ছিল – ‘মায়ামৃগ সম, তুমি কি গো দূরে রবে সাথি গো।’ গানটির একটি লাইন ‘অশ্রুমুকুলে মালাখানি মোর গাঁথি গো’, এই ‘গাঁথি গো’ বলার সময় সুরের দুটো পর্দা পাশাপাশি এমন সহজ-সুন্দরভাবে বলতে লাগলেন, আমি একেবারে অবাক। এমনভাবেও গানের এক্সপ্রেশন হয়? নিজের মুগ্ধতা নিজের মনের কাছেই গচ্ছিত রাখলাম, তখন কার কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাইব?” (নির্মল নাথ এর বইতেও এই লেখাটি আছে)। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গেই আরেকটা চমৎকার সম্মিলন ঘটে গিয়েছিল। অখিলবন্ধুর মৃত্যুর কিছুদিন আগে কোলকাতা দূরদর্শনে রেকর্ড করা তাঁর যে সাক্ষাৎকার, সেটি নিয়েছিলেন স্বয়ং জটিলেশ্বর এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়, যাঁর সুরে অখিলবন্ধু গান গেয়েছেন অনেক। সেই অনুষ্ঠানটা শুরুই হয়েছিল এই গান দিয়ে। অখিলবন্ধু এই গানটি প্রথম যখন রেকর্ড করেন তখন তাঁর বয়স কম, গলায় জোয়ারি ছিল। কিন্তু দূরদর্শনের রেকর্ডিং যখন হচ্ছে তখন অখিলবন্ধু জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন। আর কিছুদিন পরেই তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। গলার ক্ষমতা হয়ত একটু কমে এসেছে তখন কিন্তু তিনি একজন প্রকৃত শিল্পীর মতো ভাব দিয়ে গলার অক্ষমতাকে পেরিয়ে গিয়েছিলেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। ভাব কীভাবে শিল্পীর প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে সেটি অখিলবন্ধুর এই গাওয়া না দেখলে বোঝা যায় না। সেটা তাঁর আগেও ছিল কিন্তু বয়সের সময় সেটা যেন আরো গভীর, আরো নিবিড় হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, দূরদর্শনের এই অনুষ্ঠানটি থেকে রেকর্ড করেছিলেন শব্দ প্রকৌশলী শ্রী অভিমন্যু দেব। অভিমন্যু দেব একসময় এইচএমভির সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ছিলেন।
পরবর্তীকালে তিনি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপনা করেছেন। পাঠশালার এই আসরের জন্য রেকর্ডিং থেকে নিজে প্রয়োজনীয় ভিডিওক্লিপ তৈরি করে দিয়ে তিনি পরোক্ষে এই আসরেও যোগ দিয়েছেন।
এবারে আলোচক একটি মজার ঘটনা বলেন। অখিলবন্ধুর সঙ্গে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গলায় গলায় বন্ধুত্ব ছিল, যেমনটা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। এবং চিন্ময় লাহিড়ির কাছে সতীনাথ ও অখিল দুজনেই গান শিখতেন। দুজনের গানের মধ্যে কেমন একটা মিলও ছিল। দুজনেই খুব নিবেদিতপ্রাণ, তন্ময় মানুষ ছিলেন। খুব উচ্চকিত ভাব দুজনের কারোর গলাতেই ছিল না, কারো গানেই ছিল না। সতীনাথের সঙ্গে অখিলবন্ধুর সখ্য তো ছিলই কিন্তু এই সখ্য কীরকম একটা অসামান্য গানের জন্ম দিয়েছিল সেই গল্প জটিলেশ্বরের ‘জলছবির রঙ’ থেকে পড়ে শোনান রাজীব। “সতীনাথদার অনেক গান রেকর্ড হওয়ার আগেই অখিলদা রেডিওতে গাইতেন। ওঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে গাওয়া – ‘এ জীবনে যেন আর কিছু ভাল লাগে না’ রেডিও-তে শুনে একটা অন্য ধরনের মজা লেগেছিল। মনে আছে মাঝ-খাম্বাজ নিয়ে সতীনাথদার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হল দুজনে দুটো গান করার, প্রাপ্তি হিসেবে বাংলা গানের শ্রোতারা পেয়ে গেলেন দুটি স্মরণীয় গান – ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ আর ‘তোমারে ভুলিতে ওগো’।” এই লেখাটি নির্মল নাথের ‘আধুনিক বাংলা গান: স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্ত’ বইতেও জটিলেশ্বরকে উদ্ধৃত করে লেখা আছে। উল্লেখ্য, ‘তোমারে ভুলিতে ওগো’ গেয়েছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। গানটি অসামান্য।
এ পর্যায়ে অখিলবন্ধুর গলায় ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ দূরদর্শনের ‘কথায় ও সুরে’ থেকে শুনিয়ে রাজীব বলেন, ভবেশ দাশের লেখায় অখিলবন্ধুর যে বর্ণনা পেয়েছি সেই বর্ণনার সঙ্গে অখিলবন্ধুর এই চেহারার খুব মিল আছে। দাঁত পড়ে গেছে, চোখ খুলে রাখতে পারেন না, বারবার গাইতে গাইতে চোখ খুলছেন আর বন্ধ করছেন, চোখে তাঁর অসুবিধে। এইরকম অবস্থা একজন শিল্পীর কিন্তু শিল্প তাঁর সঙ্গে তখনও রয়েছে, শিল্প তাঁকে পরিত্যাগ করেনি। এবং এই রেকর্ডিংগুলি বারবার শুনতে গেলে আমাদের ভীষণরকম আবেগের সম্মুখীন হতে হয়। বৃদ্ধ বয়সে অখিলবন্ধু যখন গান গেয়েছেন তখন যেন ভাব আরো বেশি গভীর হয়েছে। এই গানটির প্রসঙ্গে নির্মল নাথের বই থেকে এই অংশটি পড়ে শোনানো হয় –
“‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ গানটির প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন গানটি নিয়ে আরেকটি গল্প বলা যাক। গল্পটা বলেছিলেন ‘মেগাফোন’এর কমল ঘোষ। কমলবাবু মেগাফোন অফিসের যে ঘরে বসতেন, সেই ঘরে বসে অখিলবন্ধু গাইছেন – ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা আমি কাঁদি সাহারায়/ ওগো সুচরিতা বুঝিলে না আমি কত অসহায়!/ ঊষ্ণ মরুর অভিশাপ লয়ে ভেঙে গেছি আমি অবসাদে ক্ষয়ে/ কণ্ঠ আমার দীর্ঘনিঃশ্বাসে ভুল সুরে গান গায়।’ কমল ঘোষকে গানটা শোনাচ্ছেন কেমন হয়েছে জানতে। এই সময় সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন মেগাফোনেরই এক সুন্দরী মহিলা কর্মী। কাঠের সিঁড়িতে জুতোর আওয়াজে বাঁ দিকে তাকিয়ে অখিলবন্ধু ভদ্রমহিলাকে দেখে গান থামিয়ে কমল বাবুকে বললেন, ‘কে? দারুণ দেখতে তো!’ কমলবাবু বললেন, ‘আমাদের অফিসেরই কর্মী কমলিকা।’ তারপরেই মজা করে কমলবাবু বললেন, ‘….. আপনি এক কাজ করুন, ওই যেখানে গাইলেন না ‘ওগো সুচরিতা বুঝিলে না কেন’, কারও চরিত্র ‘সু’ কি ‘কু’ সে নিয়ে টানাটানি করার দরকার নেই, আপনি ওই সুচরিতার জায়গায় ‘কমলিকা’ করে দিন। ব্যাস্ হয়ে গেল ‘…. ওগো কমলিকা বুঝিলে না কেন/ আমি কত অসহায়।’ “আমরা হয়ত অনেকেই জানি না যে, এমন মজার একটা রোম্যান্টিক গল্প লুকিয়ে আছে এই গানের পেছনে।
নির্মল নাথ এর বই ‘আধুনিক বাংলা গান: স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্ত’ সম্পর্কে আলোচক বলেন, বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান, কারণ এই বইতে শুধু অখিলবন্ধু না, বহু শিল্পী সম্পর্কে কিছু অন্তরঙ্গ কথা লেখক বলার চেষ্টা করেছেন, অনেক অনেক শিল্পী সম্পর্কে লিখেছেন।
এ পর্যায়ে সুমন চৌধুরী পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধুর সুরে কেদার রাগে অখিলবন্ধুর ‘আজি চাঁদিনী রাতি গো’ গানটি গেয়ে শোনান। এরপর সুমন চৌধুরী তাঁর সবশেষ গান ‘এমনি দিনে মা যে আমার’ পরিবেশন করেন। গানটি ১৯৬১ সালের, মধু গুপ্তর কথায় অখিলবন্ধুর সুরে। সুমন চৌধুরীর গানের পর, অখিলবন্ধুর মায়ের মৃত্যুর পর অখিলবন্ধুর তৈরি এই গানটি যে একইসঙ্গে কী অসামান্য উচ্চতায় এবং গভীরতায় পৌঁছেছে সেটি বোঝানোর জন্য প্রথমে অখিলবন্ধুর কন্ঠে মূল রেকর্ড থেকে বাজিয়ে শোনানো হয় এবং এই গান পরিণত অখিলবন্ধুর কোন্ ভাবের পরিচয় বহন করছে সেটি বোঝানোর জন্য দূরদর্শনের ‘কথায় ও সুরে’ থেকেও দেখানো হয়। দূরদর্শনে ১৯৮৭ সালে এই রেকর্ডিংটি হয়।
১৯৫৯ সালে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় অখিলবন্ধু ঘোষের সুরে অখিলবন্ধুর কণ্ঠে ‘কবে আছি কবে নেই’ গানটি এ পর্যায়ে পুরোটা বাজিয়ে শোনানো হয়। রাজীব বলেন, অখিলবন্ধুকে যোগ্য সম্মান দেখানো হবে যদি তাঁর গানগুলো আমরা বারবার শুনি এবং গানের মধ্যে যে অদ্ভুত একটা নিবেদনের ভঙ্গি আছে, অদ্ভুত একটা নিয়ন্ত্রিত আবেগের প্রকাশ আছে সেই প্রকাশটি যেন আমরা শেখার চেষ্টা করি। অখিলবন্ধুর ভীষণরকম তৈরি গলা ছিল, গলায় দারুণ মডিউলেশন ছিল, অসম্ভব তান করতে পারতেন। কিন্তু এসব তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কথা না, এটি অনেকেরই থাকে। অখিলবন্ধুর মধ্যে ছিল সেই ক্ষমতার শিল্পিত ব্যবহার। এই শিল্পিত সংযম তাঁর গানের সবথেকে বড়ো প্রাপ্তি। অখিলবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁকে আবার গানের মধ্য দিয়ে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন যেই কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়), তিনিও অখিলবন্ধুর জন্মশতবর্ষের শুরুতে একটা মূল্যবান মনোলোগে অখিলবন্ধুর এই শিল্পিত সংযম ও পরিমিতির কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। রাজীব বলেন, এই মনোলোগটা বারবার শোনা জরুরি। কবীর সুমন অখিলবন্ধুর মূল্যায়ন সবথেকে নিখুঁতভাবে করেছেন। আর কেউ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। হয়ত অনেকে ভেতরে করেছেন কিন্তু সবার সামনে এইভাবে উপস্থাপন সুমন ছাড়া আর কেউ করেননি।
সবশেষে আলোচক রাজীব চক্রবর্তী বলেন, এখন তো আন্তর্জালের যুগ। আমরা সবাই আন্তর্জালবাসী। যে কারণে আজ এই দেশ কালের ব্যবধান পার করে আমরা এতজন মিলে এক জায়গায় হয়েছি অখিলবন্ধু ঘোষের মতো একজন শিল্পীকে সম্মান জানাতে। আমরা চাইব অখিলবন্ধুর গান, তাঁর গানের তথ্য, তাঁর জীবনের তথ্য নিয়ে একটা আন্তর্জালভিত্তিক মহাফেজখানা তৈরি হোক, একটা ওয়েবসাইট তৈরি হোক। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে এ কাজটা অসম্ভব না। সেইটেই আজ আমাদের চাওয়া হোক।
অখিলবন্ধু ঘোষের জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক রাজীব চক্রবর্তীর গভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা, সুমন চৌধুরীর গান ও স্যামসন সরকারের তবলাবাদন দর্শক-শ্রোতারা ভীষণ উপভোগ করেছেন এবং মন্তব্য করে সক্রিয় থেকেছেন আসরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।