মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
তিন.
মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ছোট্ট শহর আইরন মাউন্টেন। শীতকাল ছাড়া অন্য সবসময়ই প্রচুর সবুজে ভরে থাকে প্রায় কুড়ি বর্গ কিলোমিটারের এই শহরটি। সামান্য পাহাড়ী উঁচু নীচু ভূমিতে শীতে যে পুরো আস্তরণে বরফ জমে, তা এত উপভোগ্য হয়ে ওঠে যে আশেপাশের শহরের স্কি প্রেমীরা ছুটে আসে এখানে স্কী করার জন্য। স্কী করতে করতে উঁচু-নীচু পথে ছুটে বেড়ানো আর বরফের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে বরফের ঠান্ডা-স্পর্শ শরীরে মেখে নেয়াই ছিলো তাদের পরম আনন্দ।
খনিজ বিশেষজ্ঞ বাবা রবার্ট হেনরী ফাহার্টি প্রায় লক্ষ্য করতেন, তিন বছরের শিশু রবার্ট যোশেফ ফাহার্টি কি গভীর বিস্ময়ের সাথে বরফের উপর সকলের স্কী নিয়ে ছুটোছুটি লক্ষ্য করে। একটু বড় হলে সেও হয়ে যায় দূরন্ত এক স্কী-বালক। স্কী নিয়ে ছুটে বেড়াতো সে ঘন্টার পর ঘন্টা। তবে সব কিছুর মধ্যেই বাবা দেখতেন, তার পুত্র একেবারে শান্ত আর মগ্ন থাকে নতুন কিছুর সন্ধানে। রবার্ট হেনরী ফাহার্টি উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে যখন আয়ারল্যান্ড থেকে আইরন মাউন্টেন শহরে এসে বসতি গড়েছিলেন, তখন তাঁর মধ্যেও ছিল অজানাকে জানার গভীর আগ্রহ আর সেই সাথে নিজের ভাগ্যকে এক লহমায় পরিবর্তন করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। সেই সময় দিকে দিকে অনেকেই খনিজ দ্রব্যের সন্ধানে বের হয়ে খুবই দ্রæত বিত্তশালীতে পরিণত হতে থাকে। হেনরী ফাহার্টিও প্রচুর বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। আইরন মাউন্টেন শহরেই তার পরিচয় হয়েছিলো জার্মান বংশোদ্ভুত সুন্দরী সুজান ককনারের সাথে। সেই পরিচয় থেকেই এক সময় দু’জন হয়ে উঠে শুধু দু’জনার।
১৮৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রæয়ারী আইরন মাউন্টেন শহরেই জন্ম হয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জনক রবার্ট যোশেফ ফাহার্টির। খনিজ বিশেষজ্ঞ পিতা হেনরী এবং মাতা গৃহিণী সুজান তাদের পুত্রকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একটু ভিন্নভাবে। ফলে বালক অবস্থা থেকেই তার মধ্যে যে ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য তারা লক্ষ্য করেন তা অবদমিত না করে একধনের প্রশ্রয়ই দিয়েছেন বলা চলে। যার ফলে কৈশোর থেকেই রবার্ট ফাহার্টি তাঁর বাবার সাথে খনিজ সন্ধানে বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে জীবন কাটাতেন। বাবার সাথেই তিনি উত্তর আমেরিকার হাডসন উপসাগর, বাফিন দ্বীপ এবং সুমেরু অঞ্চলে বেশকিছু অভিযানে যোগ দেন। এইসব অভিযানে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে গিয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা সুষ্ঠুভাবে শেষ করা হয়নি। ফাহার্টি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ দেরীতে মিশিগান কলেজে খনিজ বিদ্যায় ভর্তি হন, কিন্তু স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার আগেই তাকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়। বহিস্কারের কারণ ছিল একটানা কলেজে অনুপস্থিতি। তবে এই অনুপস্থিতির কারণ ছিল খনির সন্ধানে অভিযানে বের হওয়া।
১৯০০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ফাহার্টি উত্তর কানাডায় কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন। অভিযানগুলির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সোনার খনির সন্ধান। এর মধ্যে ১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে দুইটি অভিযান বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাফিন দ্বীপ থেকে বেলচের দ্বীপপুঞ্জের দিকে অভিযান চলছিলো। এই অভিযানের রেকর্ড রাখা এবং এস্কিমোদের জীবন তুলে ধরার জন্য ফাহার্টির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো মুভি ক্যামেরা। সেই দুটি অভিযানে প্রায় সত্তর হাজার ফিট ছবি শ্যুট করেছিলেন তিনি। কানাডার টরন্টো শহরে ছবিগুলি ডার্করুমে পরিস্ফুটনের কাজ করার সময় অসাবধানবশত হাতের সিগারেটটা ফিল্মের ওপরে পড়ে যাওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে সব ফিল্মে আগুন ধরে সবকিছুই ধবংস হয়ে যায়। নিদারুণ কষ্ট, সময় ও অর্থ-ব্যয়ে যে কাজটি তিনি করেছিলেন, তা এভাবে ভস্ম হয়ে যাবে তা কখনো কল্পনা করেননি।
অনেক দুঃখ-কষ্ট ও হতাশার পরও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের আনন্দ তিনি ততদিন পেয়ে গেছেন। ফলে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন, আগামীতে কিভাবে চলচ্চিত্রের এমন সব বিষয় তুলে আনা যায় যেগুলোর দিকে অন্য কারো ক্যামেরা তাক্ করে না। বার বার তাঁর মনে মনে হতো দূর্গম পাহাড়, জঙ্গল অথবা বরফের মধ্যে বাস করে যে সব বিভিন্ন ধরনের মানুষ যাদেরকে তিনি দেখেছেন, সেগুলোকে তুলে আনতে হবে তাঁর ক্যামেরায় আর বর্তমানের দাম্ভিক সভ্যতার মানুষদের দেখাতে হবে সেইসব মানুষদের জীবনচিত্র, যেগুলোর মধ্য রয়েছে জীবনধারণের পরম মূল্যবোধ আর বিরূপ প্রকৃতির মধ্যে বসবাসের জন্য প্রকৃতি থেকে নেয়া জ্ঞান।
১৯২০ সালের জুন মাসে কানাডার রেভিলন ফার কোম্পানীর পৃষ্টপোষকতায় উত্তর মেরু অঞ্চলে এক অভিযানে অংশ নেন ফাহার্টি। সব অভিযানেরই মূল উদ্দেশ্য সোনা বা তেলের খনির সন্ধান। তবে এতদিনে তিনি সোনা বা তেলের খনির সন্ধানের আগ্রহ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছেন। বরং তাঁর মাথায় ভীড় জমিয়েছে কিভাবে উত্তর মেরুর বাসিন্দাদের জীবনচিত্র তুলে আনা যায়। বিষয়টি কোম্পানীর কর্তৃপক্ষের জানাতেই তিনি এই চিত্র ধারণ করার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশ্বাস পান। অতপর নতুন স্বপ্ন নিয়ে অন্যান্যদের সাথে রওনা হয়ে ১৯২২ সালের মার্চ মাসে তিনি এই অভিযান দলের সাথে রওনা হন। এই অভিযানেই ফাহার্টি তাঁর জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র ‘নানুক অফ দ্য নর্থ’ নির্মাণ করেন। ছবিটি বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্রের মর্যাদা পায় এবং তিনি পরবর্তীতে বিশ্ব চলচ্চিত্রে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে সম্মানীত হন।
১৮৯৫ সালে লুই লুমিয়ের এবং অগস্ত লুমিয়ের এর হাত ধরে যে চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু হয়, সেই চলচ্চিত্রগুলি সবই ছিল প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। তাদের সেইসব চলচ্চিত্রের প্রতিটির আয়তন ছিল কমবেশী এক মিনিটের। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের পরে আরো অনেকেই স্বল্পদৈর্ঘ্যরে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন, কিন্তু ১৯২২ সালে ফাহার্টির নির্মিত ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ অসাধারণ মমতার সাথে উত্তর মেরু অঞ্চলের অদিবাসী এস্কিমোদের জীবনকে অসাধারণ সততার সাথে পর্দায় তুলে আনলেন। এই ছবির মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ দেখতে পেল বরফে ঢাকা উত্তর মেরুর এস্কিমোরা কি কঠোর পরিশ্রমে নির্মম ও প্রতিক‚ল পরিবেশের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে। কত সুন্দরভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বরফ দিয়ে ঘর বানিয়ে সেই ঘরে বসবাস করছে, মাছ ধরছে, শিকার করছে আবার কত বেশি মমতাভরে নিজেরা ঘর সংসার করছে। এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র নানুক নামের এক শিকারী। নানুক এবং তার লোকজন ফাহার্টিকে এস্কিমোর জীবন তুলে ধরার জন্য সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন আর ফাহার্টি বরফের মানুষদের জীবনবোধ এবং জীবনচিত্র তুলে ধরার জন্য নানুককে প্রধানতম চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে দুঃখের বিষয় যার চরিত্রকে অবলম্বন করে বিশ্বের প্রথম সার্থক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তোলা হয় সেই নানুকের ভাগ্যে নিজেকে পর্দায় দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এই ছবিটি তোলার দু’বছর পর তিনি মারা যান। আর এত অল্প সময়ের মধ্যে মারা না গেলেও সেই উত্তর মেরুর বরফের ঘর ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার কোন প্রেক্ষাগৃহে হয়তোবা তার এই চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ ঘটার মত বা ভাগ্য বা পরিস্থিতি ছিল না।
‘নানুক অব দ্য নর্থ’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্যেই রবার্ট ফাহার্টিকে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বা ডক্যুমেন্টারী ফিল্মের জনক বলা হয়, যদিও ডক্যুমেন্টারী শব্দটা আরো কয়েক বছর পরে প্রথমবারের মত ব্যবহৃত হয়। ১৯২৬ সালে ফাহার্টির আরেকটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘মোয়ানো’ নির্মিত হওয়ার পর চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র লেখক জন গ্রিয়ারসন ১৯২৬ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারির ‘নিউইয়র্ক সান’ পত্রিকায় লিখিত তাঁর প্রবন্ধে প্রথম ‘ডক্যুমেন্টারী’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সেই সময় জন গ্রিয়ারসন ‘মুভিগোয়ার’ (Moviegoer) ছদ্মনামে পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা লিখতেন।
‘নানুক অব দ্য নর্থ’ দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং হলিউডের বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা তাদের অর্থ-লগ্নি করার জন্য রবার্ট ফাহার্টির কাছে এসে ভীড় জমাতে শুরু করে। বিখ্যাত প্যারামাউন্ট কোম্পানী ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ এর মত আরেকটি ছবি নির্মাণের জন্য আর্থিকভাবে তাঁকে সহায়তা করে। সেই অর্থে রবার্ট ফাহার্টি তাঁর দলবল নিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রের সামোয়া দ্বীপের দিকে পাড়ি জমান তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘মোয়ানা : এ রোমান্স অব দ্য গোল্ডেন এজ’ তৈরির উদ্দেশ্যে। ১৯২৩ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছবিটি নির্মাণ করেন এবং ১৯২৬ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ এ যেখানে কঠোর, রুক্ষ প্রকৃতিকে দেখছে দর্শক, সেখানে মোয়ানা’তে দেখা গেল অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মোয়ানা দ্বীপ। অপূর্ব অনুপম ভিস্যুয়াল সৌন্দর্য এবং ছন্দময় লালিত্য দর্শকদের মনে ‘নানুক অব দ্য নর্থ’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত প্রভাব ফেলল। ‘নানুক অব দ্য নর্থ’-এর মত দর্শকরা ‘মোয়ানা’ ছবিটি দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে ভীড় জমালো না। ফলে প্যারামউন্ট কোম্পানি গভীরভাবে হতাশ হয়ে পড়লো। সামোয়া দ্বীপের অপূর্ব সৌন্দর্য্য ও মানুষের জীবন নিয়ে গীতি কবিতায় রসসিক্ত একটি স্নিগ্ধ ছবি ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় প্যারামউন্ট কোম্পানি রবার্ট ফাহার্টির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।
তবে ‘মোয়ানা’ ছবি তুলতে গিয়ে ফাহার্টি চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী প্রথার প্রচলন করলেন। এতদিন পর্যন্ত সমস্ত চলচ্চিত্রই শ্যুট হতো ‘অর্থোক্রোমাটিক ফিল্ম’ দিয়ে। এই ধরনের ফিল্মে লাল এবং ঘন কমলালেবুর রঙের কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। সূর্যাস্তের মৃদু আলোতেও এর কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। রবার্ট ফাহার্টিই সব প্রথমে ‘অর্থোক্রোমাটিক ফিল্ম’ এর পরিবর্তে ‘প্যানক্রোমাটিক ফিল্ম’ এর ব্যবহার করলেন ‘মোয়ানা’ ছবিতে।
‘প্যানাক্রোমাটিক ফিল্মে সমস্ত রঙেরই সঠিক প্রতিক্রিয়া হয় এবং খুব মৃদু আলোতেও চমৎকার স্বাভাবিক ছবি ওঠে। ‘মোয়ানা’ ছবিতে প্যানাক্রোমাটিক ফিল্মের সফল ব্যবহার সমস্ত বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে এবং এর পর থেকে পৃথিবীর প্রায় সব চলচ্চিত্রই প্যানাক্রোমাটিক ফিল্মে নির্মিত হতে থাকে।
১৯২৫ এবং ১৯২৭ সালে ফাহার্টি ‘দ্য পটারী মেকার’ এবং ‘দ্য টুয়েন্টি-ফোর ডলার আইল্যান্ড’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
পরবর্তীতে মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার কোম্পানি ফাহার্টিকে নতুন ছবি করার আমন্ত্রণ জানায়। তাহিতি দ্বীপের মানুষের জীবনের ওপর একটি ছবি নির্মিত হবে জেনে ফাহার্টি সানন্দে রাজি হয়ে যান। ছবির নামও ঠিক হয়ে যায়: ‘হোয়াইট স্যাডোস অব দ্য সাউথ সীস্’। ছবির কাজ নিজের মত করতে গিয়ে কোম্পানির সাথে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। কোম্পানি চাইছিলো ছবিটিতে তাহিতি দ্বীপের জীবন উঠে আসবে। কিন্তু এর সাথে থাকবে হলিউডের দর্শকপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপস্থিতি। অর্থাৎ ছবিটির মধ্যে মেট্রো গোল্ডউইন কোম্পানি মূলত বাণিজ্যিক সুবিধা চাইছিলো নগ্নভাবে। ফাহার্টি প্রযোজকদের রূপরেখা অনুযায়ী ছবি করতে চাইলেন না, ফলে ছবিটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩১ সালে রবার্ট ফাহার্টি আমেরিকা থেকে ইউরোপ পাড়ি জমালেন। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ জন গ্রিয়ারসনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মেছে। গ্রিয়ারসন নিজেই ফাহার্টির কাজের একজন মুগ্ধ দর্শক। গ্রিয়ারসন ফাহার্টিকে ইংল্যান্ডে আমন্ত্রণ জানালেন। উদ্দেশ্য ছিল ফাহার্টির সঙ্গ পাওয়া এবং সেই সাথে ফাহার্টির কাছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বিষয়ক জ্ঞান নেয়। সেই সময় গ্রিয়ারসনের সহযোগিতায় এবং ইংল্যান্ডের এম্পায়ার মার্কেটিং বোর্ডের হয়ে তিনি নির্মাণ করলেন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্রিটেন’। এ ছবিতে ফাহার্টি তুলে আনলেন ইংল্যান্ডের কারখানার কর্মীদের জীবন। তবে মেশিনের চেয়ে শ্রমিকদের নিষ্ঠা যে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সুন্দর করার জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন তা তিনি দেখালেন। সেই সাথে তিনি এটাও উপস্থাপন করলেন সু² ও সৌন্দর্যময় বস্তু তৈরিতে নিবেদিত প্রাণ শ্রমিকের কোন বিকল্প নেই। ছবিটিতে মূলত: ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব হওয়ার পূর্বের দক্ষ ও সচারু কারিগরী শিল্পীদের জয়গান গাওয়া হয়েছে।
ইংল্যান্ডে থেকে ফাহার্টি আয়ারল্যান্ডে গেলেন ১৯৩৩ সালে। প্রায় আশি বছর পূর্বে সমুদ্র পারের এই দেশ থেকে নতুন জীবনের সন্ধানে তাঁর পিতা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের আইরন মাউন্টেন শহরে। পূর্ব পুরুষের দেশে এসে শিকড়কে খুঁজলেন ফাহার্টি। দেখলেন সমুদ্রের সঙ্গে এখানকার মানুষের আপোষহীন সংগ্রাম। পিতৃপুরুষের মাতৃভূমি আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে হাজির হয়েছিলেন আরণ দ্বীপে। রু, উষ্ণ আরণ দ্বীপে এসে দেখলেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের টিকে থাকা। এখানকার মৎস্যজীবি মানুষ কি অপার সাহসে সমুদ্রের সাথে লড়াই করে টিকে আছে, তিমি শিকার করে তেল সংগ্রহ করছে। এখানকার এমনই এক বৃদ্ধ মৎস্য শিকারী দৈনন্দিন জীবন নিয়ে তৈরি হলো ছিয়াত্তর মিনিটের অপূর্ব কাব্যিক দৃশ্য সম্বলিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ম্যান অব আরণ’।
ইউরোপ ভ্রমণ এবং ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্রিটেন’ এবং ‘ম্যান অব আরণ’ নির্মাণের পর রবার্ট ফাহার্টি ১৯৩৭ সালে ভারতবর্ষে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পরিবেশে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করবেন। জোলটান কোরডার সাথে তিনি এখানে কাজ শুরু করলেন ‘এলিফ্যান্ট বয়’ নামের একটি ছবিতে। তবে এই ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে ফাহার্টি পূর্বের নির্মিত ছবিগুলির বৈশিষ্ট্য থেকে একটু সরে আসলেন। তথ্য নিষ্ঠ ও আপোষ-বিরোধী প্রামাণ্যচিত্র তৈরির যে প্রথা তিনি নিজেই গড়ে তুলেছিলেন, ‘এলিফেন্ট বয়’-এ দেখা গেল সেই ঐতিহ্য থেকে তিনি সরে এসেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রযোজনায় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে ফাহার্টি তৈরি করলেন ‘দ্য ল্যান্ড’ প্রামাণ্যচিত্র। ভূমি ক্ষয়কে কিভাবে রোধ করা যায় এবং কৃষিকাজে কিভাবে অধিকতর পরিমাণে যন্ত্রের ব্যবহার করা যায় সেটা দেখানোই ছিল এই দলিল চিত্রটির উদ্দেশ্য। যেখানে ‘নানুক অব দ্য নর্থ’, ‘মোয়ানা’, এবং ‘ম্যান অব আরণ’, চলচ্চিত্র অতীত সংস্কৃতির সাথে সেই বিশেষ সংস্কৃতির মানুষদের প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ‘দ্য ল্যান্ড’ এ সেই চল্লিশের দশকের আমেরিকাবাসী কৃষিতে যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং এর থেকে উত্তরণের সমূহ সম্ভাবনা পথ দেখানো হয়েছে। আবার ফাহার্টির পূর্বের ছবিগুলোতে যেখানে একজন প্রধান চরিত্রের পুরো বিষয় উপস্থিত হয়েছে। সেখানে ‘দ্য ল্যান্ড’ ছবিতে এসেছে যুথবদ্ধ কৃষি নির্ভর জনগণ।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কয়েক বছর ফাহার্টি কোন ছবির কাজ করেননি। তাঁর জীবনের শেষ ছবি এবং যেটাকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হয় সেই ‘লুইজিয়ানা স্টোরি’ নির্মাণ করলেন ১৯৪৮ সালে। স্টান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির আর্থিক সহায়তায় তিনি ছবিটি তৈরি করলেন। একটি বালকের সাথে একদল তৈল অনুসন্ধানকারীর বন্ধুত্বের রোমান্টিক কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে এই চলচ্চিত্রটি। এ ছবির অনবদ্য স্টাইল দর্শকদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। প্রকৃতি ও মানুষকে এখানে এক সাথে মিলিয়ে দিয়ে একটি গীতিকাব্যধর্মী বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করা হয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। ছবিটির বিভিন্ন ইমেজ প্রায়ই অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী এবং মনে হয় এই ছবির এক একটি সিকোয়েন্স নিয়ে এক একটি আলাদা ছোট ছোট ছবি তৈরী হতে পারতো। এই ছবিতে ধারা বিবরণীর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে অপূর্ব সঙ্গীত। ফাহার্টির এই স্টাইল পরবর্তীকালের চলচ্চিত্রকাররা গভীরভাবে অনুসরণ করে আসছে।
গত শতাব্দীর কুড়ির দশকের শুরুতে রবার্ট ফাহার্টি যখন ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ নিয়ে কাজ করছিলেন, ঠিক সেই সময় সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছিলেন ঝিগা ভের্তভ। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের পূর্ণতার পিছনে ফাহার্টির সাথে ঝিগা ভের্তভের নামও অতি শ্রদ্ধার সাথে চলে আসে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর সৃষ্টি ভের্তভের ‘দ্য ম্যান উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ সোভিয়েত রাশিয়ার জন জীবন অতি সু²ভাবে তুলে ধরেছে। ফাহার্টি ও ভের্তভ দু’জনেই দু’জনের কাজ সম্পর্কে জানতেন, কিন্তু তাদের কখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি। বর্তমান সময়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ধারার সকলে প্রামাণ্যচিত্রের শুরুর সময়ে এর উন্নয়নের জন্য এই মহান দুই চলচ্চিত্রকারকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
চলচ্চিত্রের বিবর্তনের ধারায় ফাহার্টি যে নতুন রীতির প্রবর্তন করলেন চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ পল রোথা তার নাম দিয়েছেন ‘স্লাইট ন্যারেটিভ’ বা মৃদু আখ্যায়িকা। ফাহার্টি নিজেই বলেছেন, “মানুষের সঙ্গবদ্ধ জীবনযাত্রার মধ্য থেকে কাহিনী আপনিই বেরিয়ে আসবে, কোন মানুষের একক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা নয়।”
রবার্ট ফাহার্টির জীবন দর্শনের সাথে আমরা ফরাসী দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশোর জীবন দর্শনের মিল খুঁজে পাই। দুইজনেই বর্তমানের যন্ত্রচালিত তথাকথিত আধুনিক সভ্য মানুষদের সামনে তুলে ধরেন আদিম মানুষের সহজ সরল জীবনবোধ। দার্শনিক রুশোর মত ফাহার্টিও বার বার প্রকৃতির কাছে আমাদের যেতে বলেন। নিজেদের পরিশুদ্ধ করার জন্য মানুষের প্রকৃতির কাছে যাওয়া একান্ত অপরিহার্য। ‘ব্যাক টু ন্যাচার’ মন্ত্র হৃদয়ের গভীর থেকে বিশ্বাস করতেন বলেই হয়তো রবার্ট ফাহার্টি হালিউডের পুঁজিবাদ-নিয়ন্ত্রিত প্রযোজকদের কাছে নিজের অস্তিত্বকে বিকিয়ে দেননি; বরং সৎ এবং শিল্পস্বাধীন ব্যক্তিত্বকে সম্মানের জায়গায় রেখে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রত্যাশিত উন্নয়নে। চলবে