মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

গ্রিফিথ পরিচালিত ‘ইনটলারেন্স’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য (১৯১৬)।

দুই.
কনকনে শীতের সাথে সাথে পেনসেলভ্যানিয়ায় প্রচুর বরফ পড়েছিল সেবার। তখন ১৯৪৭-এর ডিসেম্বর মাস। বেশ কয়েক বছর পর ওমন প্রকৃতি স্তব্ধ করা শীতে পেনসেলভ্যানিয়ার মানুষ সব কুকড়িয়ে গিয়েছিল। ও ধরনের শীত শেষ বারের মত পড়েছিল ১৯৩৮ সালে। তারপরের বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর সম্ভবত বারুদের উত্তাপে ভূ-মণ্ডলের সমস্ত ঠান্ডা পানি-কনা জমাট বাধার পূর্বেই গরমের দিকে মোড় নিয়েছিল। যদিও পেনসেলভ্যানিয়ায় সরাসরি বারুদ উপছে পড়েনি। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য সব জায়গায় ছয় বছর ধরে যতবেশী বারুদ বিস্ফোরিত হয়েছিল আর কোটি কোটি মানুষের কান্নার শব্দ পৃথিবীর বাযুমন্ডলে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার আঁচ অপ্রত্যভাবে হলেও পেনসেলভ্যানিয়ায় এসে লেগেছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার তখন দু’বছর হয়ে গেছে। সাত বছরের যুদ্ধ আর পাঁচ কোটি মানুষের করুণ মৃত্যুতে দাম্ভিক মানবসভ্যতা যেভাবে নুয়ে পড়েছিল, সেই সুযোগেই হয়তো শীতল শীত জাঁকিয়ে বসেছিল সারা আমেরিকায়।

যুদ্ধবিদ্ধস্ত অসহায় পৃথিবীর মতই দীর্ঘ দুই দশক দাপটের সাথে চলচ্চিত্র বিশ্বকে শাসন করা চলচ্চিত্র পরিচালক গ্রিফিথও মানুষের কপটতা ও দম্ভের সুবিধায় কান্ত হয়ে পড়েছিলেন। যে গ্রিফিথের কাঁধে ভর দিয়ে কয়েক দশক হলিউডের সিনেমা মুঘলরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে, তারা তখন পেছন ফিরে তাকিয়েছে তাঁর দিক থেকে। ফলে বিশ্ব চলচ্চিত্রের স্বাপ্নিক সংশপ্তক জীবনের স্বপ্ন দেখা ভুলে শুধু ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকতেন তাঁর চারপাশে।

ইউনাইটেড আর্টিস্ট-এর চার সদস্য (বাম থেকে) ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, পিকফোর্ড, চার্লি চ্যাপলিন এবং গ্রিফিথ (১৯১৯)।

শেষ জীবনের এই অপ্রত্যাশিত বেদনায় কান্ত গ্রিফিথ তারপরও নিজের মত করে বাঁচার জন্যই তাঁর অতি পরিচিত সব জায়গা ছেড়ে চলে এসেছিলেন পেনসেলভ্যানিয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন হোটেলটিতে। হয়তোবা জীবনের শেষ দিনগুলো একান্ত নিজের মত কাটাবেন বলে। প্রিয়তমা স্ত্রী ইভলিনও ছেড়ে গেছেন তাঁকে। বড় বেশি স্তব্ধ হয়ে যান তিনি জীবনের সব অকল্পনীয় পরিবর্তনে। নিজের নির্মিত প্রায় পাঁচশ চলচ্চিত্রের কাহিনীগুলোর সাথে নিজের জীবনের কাহিনী মেলালে আরো বেশি অবিশ্বাস্য ঠেকতো তাঁর কাছে।

পেনসেলভ্যানিয়ার সেই নীরব হোটেলটির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ গ্রিফিথ যখন শান্ত ও আরো নীরব স্টেশনটির দিকে তাকাতেন, তখনই চমকে উঠতেন প্রকৃতির পরম মোহনীয় সৌন্দর্য দেখে। কি পরম প্রেমময় শান্ত পরিবেশ! ঘরে ঢুকেই পুরানো ওভারকোট, প্রিয় টুপি আর শখের ছড়িটা নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে বরফের পথ পেরিয়ে অতি পরিচিত রেল স্টেশনটির প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াতেন। মোলায়েম আলোয় স্টেশনটা অপরূপ মনে হতো তার কাছে। হয়তোবা দু’একজন যাত্রী প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে ঝিমুতো, অথবা ছোট্ট-শান্ত-নীবর স্টেশনটা ঘিরে থাকতো আরো বেশী নীরবতা আর অন্ধকার। কিন্তু এই জায়গাটা অদ্ভুতভাবে ভালো লেগে গিয়েছিল তাঁর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই জায়গায় কখনো হলিউডের ঝকমকে চোখ ঝলসানো সব জীবন থাকবে না, এখানে থাকবে শুধু জীবন, যে জীবন একান্তই শুধু মানুষের পরম জীবনের আর জীবনকে সত্যি করে নীরব চোখে দেখে নেবার। এই শান্ত, সুন্দর প্রকৃতির রূপ দেখে তাঁর সত্যিই মনে হয়েছিলা, পরম বিশ্রামের স্থান পেয়ে গেছেন তিনি।

চলচ্চিত্র পরিচালক ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ

চলচ্চিত্রের বিবর্তনের ইতিহাসে যাঁর অবদান সবচেয়ে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয় এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনী চিত্রের যাত্রা যাঁর হাত ধরে, সেই মহান চলচ্চিত্রকার ডিভিড লিউলিন ওয়ার্ক গ্রিফিথ ১৮৭৫ সালের ২২শে জানুয়ারী উত্তর আমেরিকার কেন্টাকী প্রদেশের ওল্ডহাম কাউন্টির ক্রেস্টউডে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন সেনা কর্মকর্তা, পদবী ছিল কর্ণেল। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাবা ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৈনিক হলেও তিনি ডাক্তারী, কৃষিকাজ ও রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। মা ছিলেন অত্যন্ত রণশীল এক মহিলা। ধর্মীয়ভাবে তিনি এত বেশি গোঁড়া ছিলেন যে, পুত্র নামকরা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেও পুত্রের একটিও ছবি তিনি দেখেন নি। তবে সাত সন্তানের এই পরিবারটি খুব সুন্দরভাবে চলছিলো। কিন্তু গ্রিফিথের বয়স যখন দশ, তখনই দূর্যোগ নেমে আসে পরিবারটিতে। হঠাৎ করেই গ্রিফিথের বাবা মারা গেলেন। কিছুটা বেহিসেবি বাবা পরিবারের সদস্যদের জন্য কোন সম্পদ রেখে যাননি, বরং কিছুটা দেনার ভার চাপিয়ে তিনি চলে গেলেন। সাত সন্তান নিয়ে গ্রিফিথের মা পড়লেন নিদারুণ অর্থ কষ্টে। পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্যই গ্রিফিথের অন্যান্য ভাইদের সাথে তাকেও নামতে হল উপার্জনের পথে। প্রথম পদপে হিসাবে স্কুল ছুটির পর তিনি একটি পত্রিকা ফেরি করার কাজ নেন। আরেকটু বেশি উপার্জনের আশায় বছর খানেক পর লেখাপড়া বাদ দিয়ে একটি কোম্পানীর গুদামে লিফম্যানের কাজ নিতে বাধ্য হন। তারপর ষোল বছর বয়সে এক বইয়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ। তবে বইয়ের দোকানে কাজ করার পর তাঁর জীবনে একটি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। প্রাতিষ্ঠানিক শিা থেকে বঞ্চিত হলেও বইয়ের দোকানে বই বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ায় বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি। ফলে নিজের অন্তদৃর্ষ্টি খুলে যায় এবং বইয়ের দোকানে বই কিনতে আসা বিভিন্নজনের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠতে থাকে। এদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন অভিনেতা যাদের সহায়তায় আঠার বছর বয়সে এক থিয়েটার কোম্পানীতে ছোট একটি চাকরি পেয়ে গেলেন আর পেলেন থিয়েটারে অভিনয়ের সুযোগ।

৩৪ বছর পর্যন্ত গ্রিফিথ সম্পূর্ণভাবে নাটকে অভিনয়ের কাজ করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক লেখাতেও তিনি হাত দিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি লিখলেন এ ফুল এ্যান্ড এ গার্ল নামে একটি নাটক। নাটকটি বাল্টিমোর এবং ওয়াশিংটনের একটি মঞ্চে অভিনীত হল, কিন্তু নাট্যকার হিাসাবে তিনি কোন সফলতা দেখাতে পারলেন না। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি সিনেমার জন্য একটি গল্প লেখেন। উল্লেখ্য, সেই সময়ে সিনেমার দৈর্ঘ্য হত সাধারণত ১০ থেকে ১২ মিনিটের। সিনেমার জন্য গ্রিফিথের লেখা প্রথম গল্পটার নাম লা টোসকা। গল্পটি লিখে তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত পরিচালক এডুউইন পোর্টারের কাছে পাঠান। পোর্টার গ্রিফিথের গল্পটি গ্রহণ করলেন না তবে তাঁকে তাঁর ছবি রেসকিউড ফ্রম এ্যান ঈগল’স নেস্ট ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। সিনেমা জগতের সূত্র ধরেই গ্রিফিথের পরিচয় হল বায়োগ্রাফ কোম্পানীর হেনরী মারভিনের সাথে। গ্রিফিথ মারভিনকে তার কিছু গল্প দেখান এবং জানিয়ে দেন গল্পগুলি দিয়ে কিছু ছবি তৈরি করা যেতে পারে। মারভিন গ্রিফিথের গল্পগুলোতে অভিভূত হয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর বেশ কিছু গল্প কিনে নেন। মারভিনের সাথে গ্রিফিথের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে তিনি গ্রিফিথকে দিয়ে বেশ কিছু ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯০৮ সালে বায়োগ্রাফ কোম্পানীর প্রযোজনায় গ্রিফিথের পরিচালনায় প্রথম ছবি তৈরি হল দি অ্যাডভেঞ্চারস্ অফ ডলি। তারপর ১৯১২ সালের মধ্যে বায়োগ্রাফ কোম্পানীর হয়ে গ্রিফিথ প্রায় সাড়ে চারশোটির মত ছবি পরিচালনা করলেন। উল্লেখ্য, এই সব ছবিগুলোর প্রায় সবকটিরই দৈর্ঘ্য ছিল এক রীলের মত।

মাত্র কয়েক বছরে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে গ্রিফিথ খুবই জনপ্রিয় এক ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। ১৯১৩ সালে তিনি নিজেই স্বাধীনভাবে একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করলেন এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি যেই ছবির জন্য সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত, সেই ছবিটি অর্থাৎ ‘বার্থ অফ এ নেশন’ তৈরী করলেন। এটা বলা প্রয়োজন যে, এই ছবিটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আর পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটিই হচ্ছে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। প্রায় পৌনে তিন ঘন্টার এই ছবির জন্যই তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের গুরু হিসেবে সম্মানীত হয়ে আসছেন।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি এই ছবিটির প্রথম নাম রাখা হয়েছিল ক্যানস্ম্যান। পরে এটির নাম রাখা হয় বার্থ অফ এ নেশন। ছবিটি প্রথম মুক্তি পায় ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বিশাল বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করা এই ছবিটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল সেই সময়ের এক ল দশ হাজার ডলার। কিন্তু আয় করে দুই কোটি ডলার।

গ্রিফিথ পরিচালিত ‘আব্রাহাম লিঙ্কন’ চলচ্চিত্রের পোস্টার (১৯৩১)।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি বার্থ অফ এ নেশন ছবির কোন লিখিত চিত্রনাট্য বা স্যুটিং স্ক্রিপ্ট ছিল না। সমস্ত কিছুই ছিল গ্রিফিথের মাথায়। ছবির শুরুতে পরিচালক এই ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে বলেন, যুদ্ধ সম্পর্কে যদি মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণার জন্ম হয়, তবেই বুঝব আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। সেই সাথে ছবিটির মূল বিষয়বস্তু যে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে এবং এর মূল কারণ দাস প্রথা টিকিয়ে রাখা না এর বিলোপ সাধন করা, সে ইঙ্গিত তিনি প্রথমেই দিয়ে দেন। সেটার মুল কারণ জানাতে গ্রিফিথ পর্দার মাধ্যমে প্রথমেই জানিয়ে দেন, আফ্রিকানদের আমেরিকায় আনার মধ্য দিয়েই অনৈক্যের বীজ রোপিত হয়। বার্থ অফ এ নেশন ছবিটির শুরু হয় প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য অস্টিন স্টোনম্যানের বাসভবন থেকে। অস্টিনের মেয়ে এলসি এবং তার দুই সন্তানের গল্প নিয়ে এগুতে থাকে ছবির কাহিনী। গৃহযুদ্ধের সময় অস্টিনের দুই সন্তানই যুুদ্ধে যায় এবং ছোট ছেলে যুদ্ধেেত্র প্রাণ হারায়। বড় ছেলে ক্যামেরণ কর্ণেল পদে উন্নীত হন এবং যুদ্ধেেত্র মারাত্মক ভাবে আহত হন। যুদ্ধ শেষে সুস্থ হয়ে তিনি গৃহে ফিরে আসেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কাঠামোর মধ্যে কাহিনীর বাতাবরণ ঘিরে থাকলেও অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের কাহিনী দর্শকের নিয়ে যায় উনবিংশ শতাব্দীর ষাট এর দশকের আমেরিকায়। এক জোড়া প্রেমের কাহিনীর সাথে সাথে দণি আমেরিকার পরাজয় এবং সেখানকার একটি পরিবারের উপর এই পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া, আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যা, দেিণর বাসিন্দাদের অধঃপতন, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দাসদের উদ্ধত আচরণ, কু ক্লাকস ক্যানদের অভ্যুত্থান ইত্যাদি অনেক বিষয় এ ছবিতে ওঠে এসেছে। দণি আমেরিকার বাসিন্দাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ছবিটি তোলা হয়েছিল বলে ছবিটি মুক্তি পাবার পর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ, এমনকি যে যে সিনেমা হলে এই ছবিটি দেখানো হয়েছিল তার সামনে দাঙ্গার মত ঘটনা ঘটে। হয়তোবা গ্রিফিথের অজ্ঞাতসারেই এই ছবিতে কিছুটা নিগ্রো বিরোধী মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছিল। যার জন্য অবশ্য গ্রিফিথকে বহু সমালোচনা শুনতে হয়েছে।

ব্যবসায়িকভাবে বার্থ অফ এ নেশন অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে। এ ছবির চিত্রভাষায় গ্রিফিথ এমন কিছু কলাকৌশল ব্যবহার করলেন যা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব আর চলচ্চিত্র বিশ্ব নতুন এসব কলাকৌশল দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ে। বলা যেতে পারে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দশকের লুুমিয়ের ব্রাদার্সের এক শটের চলচ্চিত্র মাত্র কুড়ি বছরের মাথায় এসে এক পূর্ণতা পেল। চলচ্চিত্রে কোন এক কাহিনী এত বিশ্বাসযোগ্যভাবে যে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে, গ্রিফিথ সেটার পথ দেখালেন। তার ক্রস কাটিং অর্থাৎ নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য দুটি সমান্তরাল ঘটনাকে পাশাপাশি উপস্থাপনা করার রীতি, লং শট-এ বিরাট পরিধি নিয়ে বিস্তৃত দৃশ্য দেখাবার পরেই ডিটেল ফুটিয়ে তোলার জন্য কোজ আপ শটের ব্যবহার, সুনির্বাচিত ঘটনাবলী, দৃশ্য পর্যায়কে সম্পাদনা করার গতিময় ছন্দ ইত্যাদি বিষয়গুলো চলচ্চিত্রের কাহিনীকে দর্শকের সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে তৈরি করলো যা অন্যান্য চলচ্চিত্র পরিচালকদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে ক্ষেত্রে গ্রিফিথের যোগ্যতম উত্তরসূরীর নাম উচ্চারণ করতে গেলে সবার আগে চলে আসে সোভিয়েত রাশিয়ার সের্গেই আইজেনস্টাইন এর নাম। বার্থ অফ এ নেশন ছবির অভিনেতাদের মধ্যে পাঁচজনই পরবর্তীতে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এরিখ ফন স্ট্রোহাইম।

বার্থ অফ এ নেশন ছবির ফলে গ্রিফিথের প্রতি নিগ্রো বিরোধী যে মনোভাব নিয়ে অসন্তোষ শুর“ হয় সেটা তাঁকে খুবই বেশি মর্মাহত করেছিল। আসলে তিনি ছবির মাধ্যমে সেই সময়টাকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ের উপস্থপনার সুস্থতার জন্যই তিনি কাহিনীটি ওভাবে সাজিয়েছিলেন। তিনি কখনো কল্পনা করেন নি বিষয়টা এমনভাবে একশ্রেণীর মানুষের বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যাহোক এমন অসন্তোষ ও অসহিষ্ণুতার বিপে কথা বলার জন্য তিনি পরের বছরই নতুন ছবিতে হাত দিলেন। ছবির নামও রাখলেন ‘ইনটলারেন্স ‘। চার সময়ের চারটি কাহিনীকে তিনি একসূত্রে গাঁথলেন। প্রথম কাহিনী, ধর্ম উন্মত্ত ইহুদীদের হাতে যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা, দ্বিতীয়টি ছিল ষোড়শ শতাব্দীর ফ্রান্সের ক্যাথলিকদের দ্বারা হিউগেনটস্দের নির্মূল করার কাহিনী, তৃতীয়টি হচ্ছে খ্রীষ্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে পার্শিয়ানদের দ্বারা নেবুকাডনেজারের ব্যাবিলেনিয় সাম্রাজ্য ধ্বংসের কাহিনী এবং চতুর্থটি ছিল আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের বির“দ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রামের কাহিনী। এই চারটি কাহিনীর সংযোগস্থলে একটি করে চমৎকার রূপক দৃশ্য ছিল। তেমনি একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছিল একজন তরুণী মা একটা দোলনায় তার শিশুকে দোলাচ্ছে। দৃশ্যটির মধ্য দিয়ে গ্রিফিথ একটি আশাবাদী বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বার বার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছিলেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে হিংসা, যুদ্ধ, অন্যায়-শোষণ এবং অবিচার চিরস্থায়ী নয়। অন্যায়, অশান্তি, এবং যুদ্ধ বিগ্রহকে পরাজিত করে ন্যায়, শান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের চুড়ান্ত জয় হবেই। সেই সাথে তিনি মনে প্রাণে এটাও বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর এই হিংসা, দ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং সব নেতিবাচক পরিস্থিতি দূর করতে চলচ্চিত্র সবচেয়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে। কারণ শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই মানুষের সব ইতিবাচক এবং নেতিবাচক বিষয়গুলো অনেকটা হবুহু দর্শকদের সামনে তুলে ধরা যায়। আর নিঃসন্দেহে মানুষ নিজেদের অপ্রত্যাশিত কাজগুলি দেখে নিজেদের সংশোধন করে পুনরায় দুঃখ কষ্টের কারণ হতে পারে এমন সব কাজ করবে না। বিষয়টি গ্রিফিথ এতবেশী মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে ১৯২৪ সালে লেখা তার প্রবন্ধ ‘সিনেমা আফটার ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স ‘- এ তিনি অনেকটা আবেগের সাথেই বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রই পারবে আগামী একশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে অস্ত্রের ভয়াবহ তান্ডব দূর করতে।’

ইনটলারেন্স ছবির জন্য গ্রিফিথ বার্থ অফ এ নেশন-এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি খরচ করেছিলেন প্রায় বিশ ল ডলার। সাড়ে তিন ঘন্টার এই ছবির জন্য যে জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদোপম সব সেট তৈরি করা হয়েছিল, নির্বাক যুগে তা ছিল প্রায় অকল্পনীয়। ভাবতে অবাক লাগে, ইনটলারেন্স ছবির এক্সট্রা অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ষাট হাজার। ১৯১৬ সালের ৫ ই সেপ্টেম্বর ছবিটি নিউইয়র্কে মুক্তি পাওয়ার পর বিদগ্ধ দর্শক ও সমালোচক মহলে চাঞ্চল্য আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। অনেকেই বললেন, সাহিত্যে যেমন সেক্সপীয়ার এবং সঙ্গীতে বীটোফেন ঠিক তেমনি চলচ্চিত্রে হচ্ছেন গ্রিফিথ। কিন্তু আমেরিকার সাধারণ দর্শক ছবিটিকে সানন্দে গ্রহণ করলো না। ফলে আর্থিকভাবে গ্রিফিথ প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হলেন এবং ধার দেনায় জড়িয়ে পড়লেন।

তবে ইউরোপে বিশেষ করে বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্র জগতে ছবিটি নবজাগরণের প্রেরণাদাতার কাজ করল। আইজেনস্টাইন এই দীর্ঘ ছবির একটি প্রিন্ট নিয়ে কাটাকুটি করে সম্পাদনার নানা রকম পরীা নিরীা চালালেন। তাঁর বিখ্যাত মন্তাজ রীতির জন্মের পেছনে গ্রিফিথের ইনটলারেন্স-এর অবদান অনস্বীকার্য। শুধু চলচ্চিত্রকাররাই নয় স্বয়ং মহামতি লেনিন ইনটলারেন্স ছবিটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ১৯২২ সালে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে যখন একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দল আমেরিকায় গেল, লেনিন তাঁদের সাথে গ্রিফিথকে লেখা একটি চিঠি দিলেন। লেনিন সেই চিঠিতে ইনটলারেন্স এর মত ছবি তৈরির জন্য গ্রিফিথকে অভিনন্দন জানালেন এবং সেই সাথে তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন সোভিয়েত রাশিয়ায় এসে নতুন গণশিল্পের পে উপযোগী চলচ্চিত্র প্রযোজনা বিভাগের দায়িত্ব্ নিতে। গ্রিফিথ বিনয়ের সাথে লেনিনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেন।

১৯১৮ সালে গ্রিফিথ হার্টস অব দি ওয়ার্ল্ড নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করলেন। সম্পূর্ণ যুদ্ধেেত্র গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ছবিটির কাজ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁর ক্যামেরাম্যান বিলি বিটজার। ছবির বিষয় ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং জার্মানদের বর্বরতা। এর জন্য তিনি ১৯১৭ সালে ইউরোপে আসেন এবং ছবিটির শ্যুটিং-এর বেশিরভাগ কাজ করেন ফ্রান্সের বিভিন্ন রণাঙ্গনে।

সিনেমা মুঘল অর্থাৎ সিনেমার ব্যবসায়ী প্রযোজকদের হাত থেকে চলচ্চিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীর স্বার্থ রার্থে ১৯১৯ সালে গ্রিফিথ চার্লি চ্যাপলিন, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস এবং পিকফোর্ডকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনাইটেড আর্টিস্ট নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা। ঐ বছরই এই নতুন সংস্থা থেকে গ্রিফিথ তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় ছবি পরিচালনা করলেন। টমাস বার্কের কয়েকটি ছোট গল্প অবলম্বন করে তিনি বানালেন ব্রোকেন ব্রুমস ছবিটি। ছবিটির কাহিনীতে দেখা যায় একজন শান্তির বাণী প্রচারক চীনা লন্ডনে এল তার মতবাদ প্রচার করার জন্য। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না। ফলে সে একটি আফিমের দোকান খুলে বসল। ধীরে ধীরে লুসি নামে এক মেয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠল। লুসির বাবা যখন জানতে পারল তার কন্যা এক চীনার সাথে প্রেম করছে তখন তাকে এমন নির্দয়ভাবে পিটালো যে লুসির মুত্যু ঘটল। চীনা যুবক বিষয়টি মানতে পারল না এবং তখন সে তার শান্তির বাণী ভুলে গিয়ে লুসির বাবাকে গুলি করে মেরে নিজেও আত্মহত্যা করল। গ্রিফিথ এই কাহিনীটি এত চমৎকার সৌন্দর্য্যরে সাথে পর্দায় তুলে আনলেন যে দর্শকরা বেদনায় লীন হয়ে গেল। ফলে ছবিটি বেশ ব্যবসা করল। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত গ্রিফিথ ইউনাইটেড আর্টিস্টের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ধার দেনায় বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার ফলে যেসব মিডিয়া মুঘলদের বির“দ্ধে দাঁড়ানোর জন্য চারজন মিলে ইউনাইটেড আর্টিস্টের মত সংগঠন করেছিলেন। সেইসব ব্যক্তিদের প্রযোজনায় আবার ছবি নির্মাণ করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি প্রযোজকদের অন্যায় রকমের হস্তপে মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার ধার দেনা পরিশোধ করার জন্য তাদের অধীনে কাজ করার কোন বিকল্প পথও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলে চরম মানসিক অশান্তিতে তাঁকে সময় কাটাতে হচ্ছিল। সেই সময় তিনি মদ্যপানের মাত্রা প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে দেন।

যুদ্ধোত্তর জার্মানীর দারিদ্র্য এবং অনাহার নিয়ে ১৯২৪ সালে গ্রিফিথ তৈরি করলেন ইজ নট লাইফ ওয়ান্ডারফুল? ছবিটি। এটি গ্রিফিথের জীবনের অন্যতম বিখ্যাত ছবি। এরপর ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি আরো সাতটি নির্বাক ছবি তৈরি করলেন।

১৯২৭ সালে সবাক চলচ্চিত্রের আবির্ভাব হল। গ্রিফিথ বিষয়টিতে নিজেকে স্বা”ছন্দ্যে মানিয়ে নিতে পারলেন। তারপরও ১৯৩০ এবং ১৯৩১ সালে তিনি ইতিহাস ও সামাজিক কাহিনী নির্ভর ছবি আব্রাহাম লিঙ্কন এবং স্ট্রাগল নির্মাণ করলেন। আব্রাহাম লিঙ্কন ছবিটি নিউ ইয়র্ক টাইমস্ এর মত অনুযায়ী বছরের দশটি ছবির তালিকায় স্থান পায়। কিন্তু ব্যবসা সফল হতে ব্যর্থ হয়। মূলত ১৯৩১ সালেই গ্রিফিথের স্রষ্টা জীবনের অবসান ঘটে। এর পরে তিনি আরো সতেরো বেঁচেছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনের এই শেষ অধ্যায়টি বড় করুণ ও নিষ্ফলভাবে কেটেছে।

গ্রিফিথের হাত ধরে চলচ্চিত্র এমন এক জায়গায় ওঠে এসেছিল যে সেটা কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করতে গিয়ে পৃথিবীর আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সোভিয়েত রাশিয়ার সের্গেই আইজেনস্টাইন তাঁকে তাঁর গুরুর আসনে বসিয়েছেন। তিনি বারবার স্বীকার করেছেন, চলচ্চিত্র বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আহরণে তিনি গ্রিফিথের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। গ্রির্ফিথের আগে কোজ আপ, প্যানিং, ফেডআউট, লং শট ইত্যাদির প্রচলন হয়েছিল সত্য, কিন্তু গ্রিফিথের সংস্পর্শে এসে এগুলো উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। ক্রস কাটিং বা প্যারালাল আ্যাকশন, ফ্যাশ ব্যাক, ল্যাপ ডিসলভ অর্থাৎ ফেড আউট এবং ফেড ইনকে এড়িয়ে গিয়ে একটি শটের শেষভাগের সঙ্গে অপর আর একটি শটের গোড়ার দিকটা জুড়ে দেওয়া, হাই এন্ড লো অ্যাঙ্গেল শট, নাইট এন্ড মিস্ট ফটোগ্রাফী, ব্যাক লাইটিং, সফট ফোকাস ইত্যাদি সবই বলতে গেলে গ্রিফিথের আবিষ্কার। কড়া রোদকে এড়িয়ে গিয়ে রিফেকটার লাগিয়ে কিভাবে নরম আলোয় মুখের ছবি তোলা যায় তাও তিনিই প্রথম মাথা খাঁটিয়ে বের করলেন। বলা যেতে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের মূল বাঁক ঘুরিয়েছেন ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ।

১৯৩১ সালে তিনি আর একটি ছবি পরিচালনার কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিš‘ এই কাজের জন্য তিনি প্রযোজক খুঁজে পেলেন না। কোন প্রযোজকই এগিয়ে আসলেন না গ্রিফিথের দিকে। বিষয়টি অবশ্যই অদ্ভূত শোনায়, যে মানুষের হাত দিয়ে প্রায় পাঁচশটি ছবি তৈরি হয়েছিল এবং প্রযোজকরা লাখ লাখ ডলার উপার্জন করেছেন, এবং যার হাত ধরে বিশ্ব চলচ্চিত্র শিল্প উৎকর্ষতা লাভ করল, সেই মানুষটার শেষ জীবন চরম দূর্দশার মধ্য দিয়ে কাটলো। যে গ্রিফিথ চলচ্চিত্র বানিয়েছেন আর স্বপ্ন দেখেছেন এই চলচ্চিত্রই পারবে পৃথিবী থেকে সমস্ত ঝঞ্ঝা, বিুব্ধতা ও অস্ত্রের ঝন্ঝনানি দূর করে একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্ম দেবে, সেই স্বপ্ন দেখা গ্রিফিথের নিজের শেষ জীবনটা হয়ে গেল চরম বেদনাময় ক্যানভাস।
খ্যাতি আর বিত্তের ঝলসানিতে যে গ্রিফিথ তিন দশক ধরে চলচ্চিত্র বিশ্ব জয় করেছিলেন, সেই গ্রিফিথ শেষ জীবনে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন অপ্রত্যাশিত সব কষ্টগুলো থেকে । জাঁকজমক আর হৈ চৈ এর মধ্যে আনন্দ পাওয়া গ্রিফিথ বড় বেশি অভিমানী হয়ে মৃত্যুর এক বছর পূর্বে পেনসেলভ্যানিয়া রেল স্টেশনটির কাছের হোটেলটিতে ওঠে আসলেন। একা নিঃসঙ্গভাবে সময় কাটতেন তিনি। মাঝে মধ্যে হোটেলের ব্যালকনিতে বসে নীরবে চেয়ে থাকতেন অনেক দূরের পাইন বা বার্চ গাছের সারিগুলোর দিকে। হয়তোবা স্টেশন থেকে দূরের আরো বেশি নিঃসঙ্গ প্রান্তরের উপর পুরো আস্তরণে জমাট বাঁধা সাদা তুষারের দিকে চেয়ে থাকতেন। অনেক সময় কোন এক খেয়ালে হোটেল থেকে বেরিয়ে রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন বহুদূর। হয়তো বা ভাবতেন আর হোটেলে ফিরবেন না। কিš‘ কেনো যেন সন্ধ্যায় ফিরে এসে প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে ট্রেনের আসা যাওয়া আর ট্রেন থেকে মানুষের ওঠা নামা দেখতেন।

তখন আমেরিকার মানুষ এক নামে তাঁকে চিনতো। এমনকি পেনসেলভ্যানিয়ার স্টেশনের আশে পাশের কুলি, মজুর, বৃদ্ধ, তরুণ, ভিখারি সবাই তাঁকে চিনতো। প্রথম প্রথম তারা সবাই গ্রিফিথের সাথে কথা বলতে চাইত কিন্তু গ্রিফিথ কারো সাথে কথা বলতেন না। ফলে কেউ তাঁকে আর বিরক্ত করত না। সবাই তাকে নীরবে আগলে রাখতো। কেউবা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো বার্থ অফ এ নেশন এবং ইনটলারেন্স এর স্রষ্টার দিকে। সেই সময় হোটেলের লেটার বক্সে তাঁর কাছে প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসতো কিন্তু তিনি সেগুলো ছুঁয়েও দেখতেন না। তিনি নিজের সাথে নিজে কথা বলতেন আর প্রচুর মদ্যপান করতেন। সেই সাথে পরম বিশ্রামের স্থান পেনসেলভ্যানিয়ার প্রকৃতির মাঝে নিষ্পাপ শিশুর মত হেঁটে বেড়াতেন।
১৯৪৮ সালের ২৩ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ার টেম্পল হাসপাতালে ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে পাওয়া যায় তাঁর প্রিয় ছড়িটি যেটা তাঁর সাথে সব সময় থাকতো আর বার্থ অফ নেশন তৈরির সময় তিনি যে মস্ত ছড়ানো টুপিটা পড়তেন সেইটি। আর পাওয়া যায় একটি নাট্যকাব্যের পান্ডুলিপি যেটা লেখা শুরু করেছিলেন চল্লিশ বছর আগে কিš‘ কোনদিনই শেষ করে ওঠতে পারেন নি। (চলবে)