অনলাইন ডেস্ক : মহামারি করোনা বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে এর ভয়াবহতা। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম ভ্যাকসিন। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য এখন প্রতিষেধক ভ্যাকসিন তৈরি করা। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে এক ধরণের প্রতিযোগীতা। কে আগে আবিস্কার করবে। আবার কে সম্পর্ক তৈরি করে ওই দেশ থেকে আগে নিতে পারবে এ নিয়ে চলছে নানা তৎপরতা। এর আগে অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে এই ধরণের প্রতিযোগীতা দেখা যায়নি।

ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সামনে সুযোগ ছিল সবার আগে টিকা পাবার। চীন বাংলাদেশকে সে সুযোগও দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ গ্রহণ না করলেও এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভ্যাকসিন দৌঁড়ে এগিয়ে গেছে এক সময়ে পিছিয়ে থাকা ভারত, পাকিস্তান, আরব আমিরাত।

অথচ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে দেশের মানুষ সবাই ধারণা করেছিল ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকবে। কিন্তু এ আশায় গুড়েবালি। কারণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভ্যাকসিন দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। এদিকে অনেক ধনী দেশ অবশ্য বলছে, টিকা আবিস্কার করলে তারা সবাইকে দিবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে চীন, আমেরিকা, রাশিয়াসহ উন্নত দেশগুলো ভ্যাকসিন আবিস্কার করলে তাদের সবারই চেষ্টা থাকবে আগে নিজ দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া। কারণ ওই সব দেশগুলো তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আগে নিজ দেশে সবার জন্য ভ্যাকসিন দেয়ার চেষ্টা করবে। যেমন- আমেরিকার নির্বাচন সামনে। তাই ট্রাম্প প্রশাসন চাইবে নির্বাচনের আগে সকল নাগরিকের জন্য ভ্যাকসিন দিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হওয়ার। একইভাবে রাশিয়া ও ধনী দেশগুলো প্রথম নিজ দেশের জন্য। পরবর্তীতে অন্যান্য দেশকে দিলেও বাংলাদেশসহ অন্যান্য নির্ভরশীল দেশগুলো সেই ভ্যাকসিন কি পরিমাণে পাবে এই নিয়ে সন্দেহ দেখিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বলেন, ভ্যাকসিন আগে পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু অবগত। যে ভ্যাকসিন আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে সেটাই আমরা পাবো। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায়।

সূত্র মতে, করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া তথা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন দৌঁড়ে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কয়েকমাস আগেই টিকা আবিস্কার হলে সেটা যাতে আগে বাংলাদেশ পায় সে বিষয়েও কথা বলে রাখেন চীনের সঙ্গে। চীনের প্রতিনিধিরাও বলে গেছেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে গত ১৯ জুলাই চীনের সিনোভ্যাকের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি)।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থা-আইসিডিডিআর-বি’র তত্ত্বাবধানে এই পরীক্ষা হওয়ার কথা। অথচ ভারত তখনও করোনা চিকিৎসা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আর করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র প্রতিষেধক ভ্যাকসিন নিয়ে দ্রুত অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতায় সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। একইভাবে গণস্বাস্থের র‌্যাপিড কিটের ব্যবহারও থেমে গিয়েছিল। আর তাই চীনের টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালও হয়ে পড়ে বিলম্বিত। এ সময়ের মধ্যেই ভারত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির টিকা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়; দেশে সিনোভ্যাকের ট্রায়াল হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পেত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে কেন চীনের টিকার ট্রায়াল করা হয়নি সেটা নিয়ে সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, হাতের নাগালে থেকেও ট্রায়াল না করে বাংলাদেশকে এখন নির্ভর করতে হবে ভারত বা অন্য কোন দেশের ওপর। আর বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা ভারত ইতোমধ্যে তিনটি প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করছে। দুটি তাদের নিজেদের তৈরি এবং আরেকটি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিনের পেটেন্ট নিয়ে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে এবং এই ভ্যাকসিনটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, তার দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। তবে ভারত তাদের উৎপাদিত টিকা বাংলাদেশকে দেবে কি না সেটা দেশটির নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। আর অক্সফোর্ডে ভ্যাকসিন বাংলাদেশ কোন উপায়ে পাবে সেটা ভারতের সাথে ভ্যাকসিন প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির ওপর নির্ভর করবে।

অথচ বাংলাদেশ চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে না পারলেও ঠিকই আরব আমিরাত ও পাকিস্তান সিনোভ্যাকের ট্রায়াল করাচ্ছে। যদিও ভ্যাকসিন আগে পাওয়াই এখন সরকারের মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, টিকা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চাইলেই পাওয়া যাবে।

এদিকে চীনের টিকা বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ক্যানসিনো বায়োলজিকসকে তাদের করোনা টিকা ‘অ্যাড৫-এনকোভে’র জন্য পেটেন্ট অনুমোদন দিয়েছে বেইজিং। গত ১৬ আগস্ট চীনের পিপলস ডেইলি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই প্রথম চীনের পক্ষ থেকে কোনো কোভিড-১৯ টিকার পেটেন্ট অনুমোদন দেয়া হলো। যদিও ইতোমধ্যে রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে রীতিমতো ‘চমক’ দেখাচ্ছে। টিকা উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন টিকার অনুমোদন দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কবে নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিয়ে কোন ভ্যাকসিন বাজারে আসতে পারে সেটাও বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে কোন টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হলে কী লাভ হবে, সে বিষয়ে সরকারের ভ্যাকসিন বিষয়ক কমিটির সদস্য ডা. শামসুল হক বলেন, কোন দেশে ভ্যাকসিন পরীক্ষার পর যদি এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায় তাহলে যে দেশে পরীক্ষা চালানো হয়েছে, সেখানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সহজ হয়ে যায়। আবার যারা এই ভ্যাকসিন উৎপাদক তারা যেসব দেশে পরীক্ষা চালায় তাদেরকে সাধারণত অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, তাই ট্রায়াল না করে বাংলাদেশ পিছিয়ে গেল বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এর পেছনে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বরেন, চীন যদি চায় তাদের ভ্যাকসিনটি কোন দেশকে নিতে হবে। তাহলে চীন ওই দেশের ওপর চাপ দেবে। বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীন পদ্মা সেতু বা তিস্তা সেতুর অর্থায়নের শর্ত তুলে চাপ দেবে। এই ঘোষণা দেয়ার দুই দিনের মাথায় শ্রিংলা ঢাকায় হাজির হয়েছেন।

তাই চীনের টিকা পরীক্ষা না করার পেছনে যে রাজনীতি নেই, ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই এটা উড়িয়ে দেয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে বাংলাদেশ যদি টিকা উৎপাদনকারী সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে ভালো দেন-দরবার করতে পারে, তাহলে লাভবান হবে। ভুক্তভোগী হবে না বলে উল্লেখ করেন ডা. বে-নজির আহমেদ।

তবে বাংলাদেশের মতো বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে যে পরিমাণ অর্থ অগ্রিম করা প্রয়োজন, সেটা দেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ডা. বে-নজির আহমেদ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বাস্থ্য অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, এখানে দু’টি বিষয়। একটি হচ্ছে আবিষ্কার এবং কারো সঙ্গে সহযোগী হওয়া। অন্যটি ম্যানুফেকচারিং। এসব বিষয়ে সম্পৃক্ত হলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। আমরা একটির সঙ্গেও নেই। যারা ভ্যাকসিন তৈরি করলো তারা দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করবে। তিনি জানান, বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য ক্রয়াদেশ বা অর্ডার দিয়ে রেখেছে।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশ চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশীদার হলে সুবিধা পেতো। তখন অগ্রাধিকার থাকতো। কিন্তু এটা এখন অনিশ্চিত। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশ ভ্যাকসিন দৌড়ে অবশ্যই পিছিয়ে আছে।