ফরিদ আহমদ
“তুই ধারে মাল বেচিস?” চোখ গরম করে তিনি বললেন।
“আজ্ঞে, তা অল্পস্বল্প করি বৈকি।” হাত কচলে খগেন বলে।
“লোকজন তো সব টাকা মেরে দেবে রে।” বদরাগী মানুষ তিনি। রাগ দমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনি। কাজ হচ্ছে না যদিও মোটেই।
“আজ্ঞে, মারবে না?”
“কেন, কেন মারবে না? মানুষেরা কি সব ঠাকুর দেবতা হয়ে গেছে নাকি আজকাল?” শ্লেষ ঝরে পড়ে তাঁর কন্ঠে।
তাঁর ছাত্র নিমতলায় কাঠের গোলা খুলেছে। শিক্ষক হিসাবে তাঁর একটা দায়িত্ব রয়েছে। ছাত্রের ব্যবসার খোঁজখবর নেওয়া উচিত। সেই দায়িত্ব পালন করতেই আজ কাঠের গোলায় এসেছিলেন তিনি। এসে যা দেখছেন, তাতে তাঁর পক্ষে মেজাজ ঠিক রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
কাঠের গোলায় তিনি এসে দেখেন ছাত্র তাঁর একটা ইংরেজি মাসিক পত্রিকা নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ছাত্র বিদ্যা শিক্ষা করছে, এটা দেখে দারুণ খুশি হবার কথা তাঁর। তার বদলে চরম বিরক্ত হলেন তিনি। রেগে গিয়ে বললেন, ‘ব্যবসা করতে এসেছিস, তো হাতে ইংরেজি পত্রিকা কেন রে উল্লুক?”
“আজ্ঞে, ইংরেজিটার একটু চর্চা রাখছি। আপনিতোই বলেছেন ইংরেজিটা ভালো করে শিখতে।”
“তা বলেছি। কিন্তু, সেটা এই ব্যবসায় বসে পড়ার জন্য বলি নাই। তোকে ইংরেজি বই পড়তে দেখলে খদ্দেররাতো সব চলে যাবে। পড়তেই যদি হয়, তবে রামায়ণ, মহাভারত পড়। এতে করে তোর ব্যবসার উন্নতি হবে। লোকে ভাববে তুই ধার্মিক মানুষ। তোর কাছে ব্যবসার জন্য বেশি বেশি আসবে তারা।’
বইয়ের ঝামেলা শেষ না হতেই তাঁর চোখে পড়ে গেলো সে ধারেও মাল বেঁচে। এটা দেখে মেজাজ তাঁর দ্বিগুণ খারাপ হলো। এই বৃষকে দিয়ে কিছুই হবে না।
“বল, লোকজন কি সব ভদ্রলোক হয়ে গেছে যে তুই ধারে মাল বেচিস?” গলা চড়তে থাকে তাঁর। দুই হাত প্রবলভাবে নড়তে থাকে। পারলে চড়ই বসিয়ে দিতেন তিনি ছাত্রের গালে। দামড়া বয়সে চড় খেলে অপমান হবে বলে চড়টা তিনি দিলেন বিশেষ বিবেচনায়।
“না, তা হয় নি। আমি ভদ্রলোক দেখে ধার দি। সবাইকে এই সুযোগ দেই না।
“ভদ্রলোক কি করে বুঝিস? গায়ে লেখা থাকে বুঝি?” দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ভেংচে ওঠেন তিনি।
“আজ্ঞে, চেহারা দেখেই ভদ্রলোক বুঝি।”
“তুই একটা মূর্খ! একেবারে গণ্ডমূর্খ। তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোর মতো একটা গাধাকে আমি বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছি বলেই নিজেই লজ্জিত আমি।” গর্জন করে উঠলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর এই গর্জন শুনে আঁতকে ওঠলো খগেন্দ্রনাথ। ভীত কণ্ঠে বললো,
“তাহলে কী করবো গুরুমশাই? লোকজন ধারে জিনিস চায় যে। দেবো না?”
“দিবি, অবশ্যই দিবি। তবে, ব্যবহার করে করে যখন দেখবি মানুষটি খাঁটি, আসল ভদ্রলোক। তখন ধার দিবি। তার আগে না। ছোটলোকদের জন্য এইসব সুবিধা দিতে নেই। দিলে, তোর ব্যবসায় লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে তারা।”