ডঃ বাহারুল হক : বড় হয়ে বুঝেছি আমার মা কম বয়সে বেশি রোগে ভুগেছেন। তবে কখনোই তেমন সাংঘাতিক কিছু না। আমার শিশুকালে আমি দেখতাম সব সময় ঘরে ডাক্তার উপস্থিত। মা-র জন্য তাদের আগমন। শিশু বয়সের ঘটনা; আমার কিন্তু সব মনে আছে। ঘুরে ফিরে তিন চিকিৎসক আসতেন। একজন হলেন আমিন ডাক্তার (বড় হয়ে জেনেছি তার নাম ডাঃ আমিনুল হক, তিনি এলোপ্যাথি), আরেকজন রজক ডাক্তার (বড় হয়ে জেনেছি তার নাম ডাঃ আবদুর রাজ্জাক, তিনি হোমিওপ্যাথি), অন্যজন তালুপোড়া কবিরাজ (তিনি আয়ুর্বেদি চিকিৎসা দিতেন; মাথায় বড় টাক ছিল বলে তিনি তালুপোড়া কবিরাজ হিসেবে পরিচিত)। কবিরাজের নামটা মনে করতে পারছি না। তিনি আমাদের ছোটবেলায় ভারতে চলে গেছেন। এ তিনজনের বাহিরেও আছেন একজন। তিনি হলেন কালা খন্দকার (বড় হয়ে জেনেছি তার নাম আবু তৈয়ব খন্দকার)। তিনি কুচকুচে কালো ছিলেন বলে কালা খন্দকার নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি খন্দকারী চিকিৎসা দিতেন। বড় হয়ে একদিন আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম- আচ্ছা আব্বা, মা-র জন্য এত রকমের চিকিৎসক কেন ডাকতেন? আব্বা হেসে বললেন- “অমা, কাকে ডাকবো সেটাতো তোমার মা-র ইচ্ছা। তোমার মা যাকে ডাকতে বলতো আমি তাকেই ডাকতাম। না ডাকলে তোমার মা অসন্তুষ্ট হতো। তাই যখন যাকে চাইতো তাকে এনে হাজির করতাম”। আমার আব্বা ছিলেন সে রকম একজন স্বামী যিনি স্ত্রীর সন্তুষ্টির দিকে সর্বদা খেয়াল রাখতেন? কোন দিন দেখি নাই মা-র কোন কথায় বা কাজে আব্বাকে বেজার হতে বা মা-র প্রতি সামান্যতম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে। আমার মা সত্যি একজন ভাগ্যবতী মহিলা ছিলেন।

মানব সভ্যতা বিকাশে প্রাকৃতিক উপাদান সমুহের মধ্যে নদীর অবদান সব চেয়ে বেশি। মানুষ প্রাকৃতিক ভাবে নদী অন্তঃপ্রাণ। কানাডার মানুষ ও তাই। নদীর প্রতি কানাডিয়ানদের প্রীতিও খুব প্রবল। সে জন্যই টরন্টোর অন্যতম প্রখ্যাত সরকারি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে নদীর নামে-হাম্বার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এন্ড এডভান্সড লার্নিং যা হাম্বার কলেজ বলে সবার কাছে পরিচিত। আর কানাডার রাজধানীর নামকরণ করা হয়েছে নদীর নামে, অটোয়া। অটোয়া নদীর তীরে রাজধানী রুপে গড়ে তোলা হয়েছে অনিন্দ সুন্দর নগরী অটোয়া।

ভ্যানকুভার, কানাডার সবচেয়ে পশ্চিমের প্রদেশ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বৃহত্তম শহর। ভ্যানকুভার জন্ম হয়ে সময়ের আবর্তে বিকশিত হচ্ছে যে নদীকে কেন্দ্র করে সে নদীর নাম ফ্রেজার নদী, কানাডার বৃহত্তম নদী গুলোর একটি। আমরা দেখেছি নদীর নামে শহরের নাম, জনপদের নাম। এই প্রথম দেখলাম মানুষের নামে নদীর নাম। বিখ্যাত কানাডিয়ান এক্সপ্লোরার সাইমন ফ্রেজারের নামে এই নদীর নাম, ফ্রেজার নদী। ফ্রেজার নদীর উপর একটি মস্ত বড় দৃস্টিনন্দন ব্রীজ আছে যেটি ফ্রেজার ব্রীজ নামে পরিচিত। এবার ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য দেই। নদীর নাম ফ্রেজার বলে ব্রীজের নাম ফ্রেজার ব্রীজ হয়নি। এই ব্রীজের নামকরন করা হয়েছে ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের সে সময়ের জনপ্রিয় সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রী আলেক্স ফ্রেজারের সন্মানে। ফ্রেজার নদীর উপর ফ্রেজার ব্রীজ। কী চম্ৎকার! এক ফ্রেজার নদী হয়ে বইছে আরেক ফ্রেজার ব্রীজ হয়ে সেই নদীর উপর হাসছে।

এক্কেবারে ছোট্ট বেলার ঘটনা। বিড়াল ছানার মত সারাক্ষণ থাকতাম মায়ের পিছু পিছু। একদিন মা রান্না করছেন, আমি মায়ের গলা জড়িয়ে মায়ের পিঠে। হঠাত কড়াই থেকে তেল ছিটকে এক ফোটা পড়লো আমার হাতে। হাতে ফোস্কা উঠে গেল। ফোস্কার ভেতর পানি ঢলঢল করছে। ফোস্কা গালতে চায় মা। কিন্ত আমি হাতই ধরতে দিচ্ছিনা কাউকে। এমন অবস্থায় সকাল বেলায় আব্বাকে দেখি জামা গায়ে দিচ্ছেন। বুঝলাম আব্বা কোথাও যাবেন। আমাকে রেখে কি আর যেতে পারবেন? না। আব্বার হাত ধরে আমিও আব্বার সাথে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কাকুর বাড়ি। কাকিমাতো আমাকে দেখে কি খুশী! দুহাত বাড়িয়ে একেবারে বুকে তুলে নিলেন । মুখে, মাথায়, পিঠে হাত বুলান। তারপর আমার কচি হাত দুটো নাড়া চাড়া করতে গেলেই কাকিমার চোখে পড়লো আমার হাতের ফোস্কা। আমাকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে কাকিমা কোন দিকে যেন গেলেন। ফিরে এলেন একটা খেঝুর কাঁটা আর একটা মলমের কৌটা হাতে। এবার কোলে আমাকে বসালেন এবং কাঁটা দিয়ে চট করে আমার ফোস্কাটা ফুটো করে সব পানি বের করে ফেললেন। তারপর আঁচল দিয়ে মুছে ভাল করে মলম লাগিয়ে দিলেন। শুধু কি তাই? এরপর হাতে গুজে দিলেন দুটো বড় নারিকেলের লাডডু। সে মজাদার লাডডু খেতে খেতে আব্বার হাত ধরে বাড়ি ফেরা। ফোস্কা ভাল হয়ে গেছে কিন্ত আমার হাতে সে ফোস্কার চিহ্ন এখনও আছে, সেই মমতাময়ী কাকিমার গভীর মমতার চিহ্ন। ১৯৬৫ সনে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে এই কাকিমার পরিবারও অনেকের সাথে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন। আর কোনদিন দেখা হয়নি।

একদা এক রাজা ছিল। রাজার রানী খুব অসুস্থ। রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি রানীর অসুখের খবর প্রজাদের জানাবেন এবং রানীর জন্য প্রার্থনা করতে বলবেন। রানীর কী হয়েছে সে প্রকৃত খবর নিতে হবে রাজ কবিরাজ থেকে। খাস ঘরে গেল খবরবাহক। কবিরাজ বললেন- “রানীর কাকের মত কালো বিষ্ঠা হচ্ছে”। বাহক নেক্সট বাহককে নির্ভুলভাবে কথাটা বললো। নেক্সট বাহক নেক্সট বাহককে আর নির্ভুল ভাবে বলতে পারলো না। সে বললো- “রানীর কাকের মত কালো হচ্ছে”। সে বাহকের খবর রাজপ্রাসাদের চতুর্দিকের প্রজারা জানলো। সে প্রজাদের থেকে আরো দুরের প্রজারা জানলো। এ মুখ থেকে সে মুখ তারপর আরেক মুখ এভাবে শেষ পর্যন্ত সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লো খবর- “আমাদের রানীর কাক হচ্ছে”। বাচ্চা হবে এমন প্রসূতি মাকে মানুষ জানে অসুস্থ মহিলা। তাই প্রজারা ভেবেছিল রানীর অসুখ আর কিছু না; রানী আসলে মা হবে এবং তাই হলো- রানী মানুষের পরিবর্তে কাক প্রসব করেছে। “রানীর কাক হচ্ছে”? আসলে এক কথা মুখে মুখে নানা কথা হয়। আসল কথা বিকৃত হয়ে শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় একটা আকথা বা কুকথা। এই এখানে যেমন হলো: প্রকৃত খবর- “রানীর কাকের মত কালো বিষ্ঠা হচ্ছে”। বিকৃত খবর- “রানীর কাক হচ্ছে”।

নরওয়ের রেস্তোঁরায়/ কফি হাউজে ‘সাসপেন্সন’ একটা অতি পরিচিত শব্দ। এখানে ক্রেতা যারা আসেন তাদের কেউ কেউ কিছু কেনার পর কিছু সাসপেন্সন রেখে যান। যেমন, দেখা গেল- একজন আসলেন, কফি খাবেন। ক্যাশ কাউন্টারে দাম দিতে গিয়ে তিনি বললেন- একটা কফি একটা সাসপেন্সন। কেউ বলেন- পাঁচটা কফি দুটা সাসপেন্সন। কেউ বলেন – ছয়টা লাঞ্চ দুটা সাসপেন্সন। এখন প্রশ্ন হলো- সাসপেন্সন কী? অচেনা অজানা কারো জন্য আগেই খাবারের মুল্য পরিশোধ করে যাওয়াকে বলে সাসপেন্সন। পরে হত দরিদ্র মুল্য পরিশোধে অক্ষম কেউ যদি এসে বলে – কোন সাসপেন্সন লাঞ্চ আছে? ক্যাশ কাউন্টার থেকে বিনয়ের সাথে বলা হবে- হাঁ আছে । আপনি বসুন। লোকটা বিনে পয়সায় খেয়ে গেলো। তার খাওয়ার দামতো আগেই একজন দিয়ে গেছে সাসপেন্সন নামে। এভাবে যতক্ষণ খোলা থাকে ততক্ষণ চলে এই সাসপেন্সন। কেউ সাসপেন্সন দিচ্ছে কেউ নিচ্ছে। কিছু মানুষ নিজেদের পকেট থেকে, নিজেদের অর্জিত রোজগার থেকে, কিছু অজানা মানুষের খাওয়ার জন্যে পেমেন্ট করছেন। আর কিছু গরীব, দুঃস্থ মানুষ বিনা পেমেন্টে নিশ্চিন্তে খাওয়া দাওয়া করছেন। কেউ জানেনা কারুর পরিচয়। না দাতা জানে গ্রহীতার পরিচয়, না গ্রহীতা জানে দাতার পরিচয়। প্রয়োজন নেই পরিচয় জানার, প্রয়োজন নেই নিজের নাম জাহির করার, কিন্ত প্রয়োজন আছে কিছু অভুক্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেবার। নরওয়ে মানবিকতার এই চরম শিখরে পৌঁছেছে। এবার আমার অভিজ্ঞতা বলি। আমি নরওয়ের উত্তরাঞ্চলে ট্রন্ডেম নামের এক শহরে ছিলাম কিছু দিন। কাজের চাপে মাথার চুলে রঙ করা বন্ধ। একদিন বাসা থেকে বের হলাম। সেদিন সেভ করাও হয়নি। রাস্তায় বাতাসে চুল গেছে আউলা ঝাউলা হয়ে। ঢুকলাম এক কফি হাইজে। কফির দাম দিতে গেলে ক্যাশ কাউন্টারের মেয়েটা বিনয়ের সাথে বললো- না, দাম দিতে হবেনা। আমি বললাম- কেন? মেয়েটা হেসে আবারো বললো- না, তোমার থেকে দাম নেবোনা। তখন আমি বললাম- না, তুমি দাম রাখো। তুমি যা ভাবছ আমি তা নই। আমি দাম দিতে সক্ষম। যে দাম দিতে পারবেনা তাকে দিও। আরেক দিন আরেক জাগায় গেলাম। মেলা হচ্ছে সেখানে। ঢাকার ফুটপাথের উপর যে রকম ছোট ছোট টি-স্টল পাওয়া যায় সে রকম কিছু দোকান পেলাম সেখানে। কলা সহ কিছু খাদ্য সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে সে সব দোকানে। আমি একটার সামনে গিয়ে কলা চাইলে মালিক মেয়েটা একটা কলা দিল। আমি দাম দিতে গেলে সে দাম নিতে চায়না। আমি খুব বিরক্ত হয়ে বললাম- দেখ আমি ভিখারী নই। আমার কাছে টাকা আছে। তুমি দাম নাও। এক রকম জোর করেই তাকে দাম দিলাম। অবশ্য, মেয়েটা সাসপেন্সনে ছিল কিনা তা জিজ্ঞাসা করিনি।