অনলাইন ডেস্ক : ছেলে এবং বর্তমান রাজা ফিলিপের উদ্দেশ্যে ছোটো একটি চিঠি লিখে গত ৩ আগস্ট উধাও হয়ে যান স্পেনের ৮১ বছরের সাবেক রাজা হুয়ান কার্লোস।

ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, অতীতে আমার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অধ্যায়ের জেরে জনমনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তাতে মনে করছি দেশ ছেড়ে যাওয়া এখন আমার জন্য সঙ্গত; যাতে আমার ছেলে শান্তিতে কাজ করার সুযোগ পায়।

রাজা ফিলিপে তার বাবার দেশত্যাগের খবর এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেওয়ার পর থেকে গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ব মিডিয়ায় জল্পনা-কল্পনা চলছিল হুয়ান কার্লোস কোথায় গেছেন?

কিছু মিডিয়ায় খবর বের হয়- সাবেক এই রাজা ডমিনিকান রিপাবলিকের একটি বিলাসবহুল অবকাশ কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছেন। কিছু মিডিয়ায় রিপোর্টে বলা হয় তিনি পর্তুগালে চলে গেছেন; যে দেশে তিনি নিজের তারুণ্য ও যৌবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন।

স্পেনের শীষং গণমাধ্যম এনআইইউএস তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করেছে, রাজা কার্লোস সোমবার ব্যক্তিগত একটি বিমানে করে আবুধাবিতে গিয়ে নামেন এবং সেখানেই আছেন। প্রমাণ হিসেবে তারা ছবিও ছাপিয়েছে।

ওই পত্রিকাটি দাবি করেছে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ব্যক্তিগত একটি বিমান স্পেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ভিগোতে এসে নামে। তারপর সেখানে থেকে সাবেক রাজা এবং তার ব্যক্তিগত কয়েকজন সহযোগী আবুধাবিতে উড়ে আসেন।

আবুধাবির আল বাতিন বিমানবন্দর থেকে তাকে হেলিকপ্টারে করে সরকারি মালিকানাধীন বিলাসবহুল এমিরেটস প্যালেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই হোটেলের একটি পুরো ফ্লোরে সহযোগীদের নিয়ে রয়েছেন পলাতক এই সাবেক রাজা।

হুয়ান কার্লোসের সঙ্গে আবুধাবির ক্ষমতাধর যুবরাজ যায়েদ বিন আল নাহিয়ানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। গত শনিবার থেকে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আবুধাবির সরকার, এমিরেটস প্যালেস হোটেল কর্তৃপক্ষ এবং স্পেনের রাজপ্রাসাদের সাথে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলেও – কেউই কোনো কথা বলছে না।

কেন তিনি পালিয়ে গেলেন?

নির্বাসিত স্প্যানিশ রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসোর নাতি হুয়ান কার্লোসের জন্ম ইটালির রোমে। তিনি প্রথম স্বদেশে যাওয়ার সুযোগ পান ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে। তখন তার বয়স ছিল ১০ বছর।

১৯৭৫ সাল থেকে টানা প্রায় ৪০ বছর রাজসিংহাসনে থাকার পর ২০১৪ সালে তিনি রাজমুকুট তুলে দেন ছেলে ফিলিপের হাতে। ২০১২ সালে মেয়ে ক্রিস্টিনার স্বামীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়া ছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক মন্দার ভেতর বিপুল অর্থ ব্যয় করে আফ্রিকায় হাতি শিকারে যাওয়ার ইস্যু নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায় তিনি সরে দাঁড়ান।

তারপর এ বছর জুনে তার নিজের বিরুদ্ধেই বিশাল এক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনার ভেতর দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ সম্পর্কিত একটি প্রকল্পের সূত্রে তিনি সাবেক সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার ঘুষ নিয়েছেন বলে একটি রিপোর্ট সুইজারল্যান্ডের লা ট্রিবিউন পত্রিকায় বের হয়।

এরপর জুন মাসে স্পেনের সুপ্রিম কোর্ট ওই অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত শুরুর অনুমোদন দেয়। সুইজারল্যান্ড সরকারও এ নিয়ে একটি তদন্ত শুরু করেছে।

সাবেক এই রাজা প্রথম থেকেই কোনো দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে গেলেও, সোমবার তিনি গোপনে দেশ ছেড়ে চলে যান। সৌদি সরকারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছাড়াও সুইজারল্যান্ডে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার সম্পর্কিত একটি অভিযোগের তদন্তের সাথেও হুয়ান কার্লোসের নাম জড়িয়েছে।

স্পেনে প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে?

দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলার ভেতর এভাবে সাবেক রাজা কার্লোসের দেশত্যাগের পর স্পেনে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রয়োজন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠেছে।

কাতালোনিয়া প্রদেশের পার্লামেন্টে শুক্রবার রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। সেসময় কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম তোরা সংসদে বলেন, স্প্যানিশ বা কাতালান – কারোরই এ ধরনের একটি কেলেঙ্কারি সহ্য করা উচিৎ নয়। রাজতন্ত্র বাতিল করে স্পেনকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ হচ্ছে।

স্পেনে শেষবার রাজতন্ত্র বাতিল করা হয় ১৯৩১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে। গৃহযুদ্ধ শেষের পর ১৯৩৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক একনায়ক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো।

এরপর যুবরাজ হুয়ান কার্লোস বেশ কিছু কার্যত বন্দি অবস্থায় থাকলেও কালে কালে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ফ্রাঙ্কো হুয়ান কার্লোসকে তার উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করেন।

১৯৭৫ সালে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর দুদিনের মাথায় হুয়ান কার্লোস ক্ষমতা নিলেও, তিনি ফ্রাঙ্কোর নীতির বিপরীতে গিয়ে স্পেনকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যান এবং ঘোষণা দেন স্পেন হবে শুধুই সাংবিধানিক একটি রাজতন্ত্র।

তবে ১৯৮২ সালে সোশ্যালিস্টরা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর রাজা কার্লোসের রাজনৈতিক প্রভাব একেবারেই হ্রাস পায়। তারপরও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং তাকে দেখা হতো স্পেনের ঐক্যের একটি প্রতীক হিসেবে।

অবশ্য গণতন্ত্র-পন্থী হেসেবে তার যে সুনাম এবং জনপ্রিয়তা ছিল, কালে কালে তা দুর্নীতি এবং ভুল রাজনৈতিক বিবৃতির কারণে ক্ষুণ্ন হতে থাকে।

পর্যবেক্ষকরা এখন বলতে শুরু করেছেন, দুর্নীতির তদন্তের মধ্যে এভাবে দেশ থেকে পালানোর ঘটনায় এখন বিশ্বের অবশিষ্ট রাজতন্ত্রগুলোর অন্যতম স্পেনের রাজতন্ত্র অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা