মনজুরুল হক, টোকিও: জাপানজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শিল্পকলার কয়েক শ জাদুঘর। এগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী একটি হচ্ছে রাজধানী টোকিওর পাশে সাইতামা জেলার ছোট এক শহরে অবস্থিত একটি সংগ্রহশালা। হিরোশিমা প্যানেলের মারুকি গ্যালারি নামের সেই জাদুঘরে ছবি আছে সাকল্যে ১৪টি। দুজন শিল্পী, ব্যক্তিগত জীবনে যাঁরা ছিলেন স্বামী-স্ত্রী, মিলিতভাবে সেই ছবিগুলো এঁকেছেন এবং অনাগত প্রজন্মের জন্য সেগুলো দেখার সুযোগ করে দিতে ছোট সেই ভবনটিকে জাদুঘর হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন।

৫৩ বছর আগে, ১৯৬৭ সালে সাইতামা জেলার হিগাশি-মাৎসুইয়ামা শহরে প্রতিষ্ঠিত সেই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে শিল্পী দম্পতি ইরি ও তোশি মারুকির আঁকা ১৫টি প্যানেলের মধ্যে ১৪টি, হিরোশিমা প্যানেল নামে যেগুলো পরিচিত। হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানুষের দুর্দশার প্রতিফলন তুলে ধরার বাসনা নিয়ে ৩০ বছর ধরে সেসব ছবি তারা এঁকেছেন। প্রতিটি প্যানেলের উচ্চতা হচ্ছে ১ দশমিক ৮ মিটার এবং প্রস্থে এগুলো ৭ দশমিক ২ মিটার। এই আকার বলে দেয়, এগুলো হচ্ছে বিশাল কাজ। ১৫টি ছবি তাঁরা আঁকলেও সিরিজের শেষ ছবি ‘নাগাসাকি’ সংরক্ষিত আছে নাগাসাকি শহরের আণবিক বোমা জাদুঘরে।

সব কয়টি ছবি হচ্ছে জাপানের ঐতিহ্যবাহী অঙ্কনপদ্ধতি ও পশ্চিমের ছবি আঁকা প্রক্রিয়ার মিশ্রণ। আণবিক বোমা হামলার ঠিক পরপর হিরোশিমা শহরে গিয়ে প্রত্যক্ষ করা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ এই শিল্পী পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আণবিক বোমার ধ্বংসের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এ কারণে তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছিল যে তাঁরা মনে করেছিলেন মানবতার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া নৃশংস সেই অপরাধ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার মধ্যে দিয়ে শান্তির অন্বেষায় অবদান তাঁরা রাখতে পারবেন।

স্বামী ইরি মারুকির জন্ম হিরোশিমার অল্প দূরে অবস্থিত এক খামারপল্লিতে, ১৯০১ সালে। শিল্পী হিসেবে শুরুতে তিনি ছিলেন আভান-গার্দ শিল্পীদের দলভুক্ত এবং ইঙ্ক ওয়াশ প্রক্রিয়ায় তুলির টানা কাজের জন্য যথেষ্ট সুনাম তাঁর হয়েছিল। ১৯৪১ সালে তেলরঙের শিল্পী তোশিকো আকামাৎসুকে তিনি বিয়ে করেন। টোকিও মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেলচিত্রে পাস করা তোশিকোর পারিবারিক নিবাস ছিল উত্তরের জেলা হোক্কাইডো। হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার পর স্বামীর সঙ্গে তিনিও গিয়েছিলেন স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানার জন্য। ফিরে আসার পর দুজনেই তাঁরা আণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের ছবি আঁকায় নিজেদের পুরোপুরি নিবেদিত করেন।

হিরোশিমা প্যানেলের ১৫টি ছবির সূচনার প্যানেলের নাম হচ্ছে ‘ভূত’। সাদা-কালোয় আঁকা সেই ছবি দর্শকদের নিয়ে যায় ভয়ংকর এক জগতে, আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ, যেখানে ভূতের মতন চেহারা নিয়ে হেঁটে আসছে। কারও দেহ থেকে ঝুলছে খসে পড়া ত্বক, কেউ আবার লুটিয়ে পড়েছে অন্যদের পায়ের নিচে। এ রকম প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে দর্শকদের বিষয়ের ভেতরে নিয়ে গেছেন দুই শিল্পী, দর্শকদের চোখের সামনে এরপর যেখানে একে একে উন্মোচিত হচ্ছে ভয়াবহতার অন্যান্য দিক। প্রথম ছবির সাদা-কালোর বিপরীতে ‘আগুন’ শিরোনামের দ্বিতীয় প্যানেলটি আঁকা হয়েছে উজ্জ্বল লাল রঙে। আগুন সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষ, বাড়িঘর সবকিছু।

প্রতিটি প্যানেলকে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলতে শিরোনামের বাইরে তাঁরা আরও যোগ করছেন সংক্ষিপ্ত কাব্যিক বর্ণনা। ‘কাক’ শিরোনামের ১৪ নম্বর প্যানেলে তুলে ধরা হয়েছে বোমা হামলায় নিহত কোরীয়দের। মৃত জাপানিদের সৎকার দ্রুত হয়ে গেলেও কোরীয়দের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই। ছবিতে তাই দেখা যায় কালো কাক ঠুকরে খাচ্ছে এদের চোখ, দেহের অন্য অংশ। আর যে বর্ণনা দুই শিল্পী এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন, তা হচ্ছে এ রকম:

‘আগুন’ শিরোনামের দ্বিতীয় এই প্যানেলটি আঁকা হয়েছে উজ্জ্বল লাল রঙে। আগুন সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষ, বাড়িঘর সবকিছু। ছবি: সংগৃহীত
‘আগুন’ শিরোনামের দ্বিতীয় এই প্যানেলটি আঁকা হয়েছে উজ্জ্বল লাল রঙে। আগুন সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষ, বাড়িঘর সবকিছু। ছবি: সংগৃহীত
‘জাপানি ও কোরীয়রা দেখতে একই রকম। নিষ্ঠুরভাবে পুড়ে যাওয়া চেহারা মানুষ কীভাবে একে অন্যের থেকে আলাদা করে দেখতে পারে? বোমা হামলার পর শেষ যেসব মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়া হয়, সেগুলো হচ্ছে কোরীয়দের। অনেক জাপানি বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও কোরীয়দের মধ্যে অল্প কয়েকজনই কেবল রক্ষা পেয়েছেন। এ নিয়ে আমরা কিছুই করতে পারিনি। কাক উড়ে এসেছিল। অনেক, অনেক কাক। কাক উড়ে এসেছিল এবং ঠুকরে খাচ্ছিল কোরীয়দের চোখ, চোখের মণি।

এমনকি মৃত্যুতেও কোরীয়দের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করেছে জাপানিরা, বৈষম্য এমনকি মৃতদেহের বিরুদ্ধেও, যদিও বোমায় ক্ষতিগ্রস্তদের উভয় দলই হচ্ছে এশিয়ার মানুষ।
অপরূপ চিমা আর চগোরি উড়ে যায় কোরিয়ায়, নিজেদের মাতৃভূমির আকাশে। এই ছবি আমরা বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করছি তাঁদের উদ্দেশে। প্রার্থনা করছি আমরা।’

এই বর্ণনাই বলে দেয় কতটা মানবিক ছিলেন তাঁরা, মানুষের প্রতি কতটা গভীর ভালবাসা ছিল তাঁদের। ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে একবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তাঁরা, তবে পুরস্কার তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে ৯৪ বছর বয়সে ইরি প্রাণ ত্যাগ করেন এবং তোশি মারা যান এর পাঁচ বছর পর ৮৭ বছর বয়সে। তবে যে ঐতিহ্য তাঁরা রেখে গেছেন, মানবতার শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত হিসেবে তা টিকে আছে সাইতামার সেই ছোট্ট জাদুঘরে।

প্রবেশমূল্যের অর্থে চলা জাদুঘরটি এখন সংরক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ার মুখে। ফলে ছবিগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এর পরিচালকেরা। দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে কিছুদিন আগে ক্রাউড ফান্ডিং বা জনতার কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের আবেদন তাঁরা জানিয়েছিলেন। সুখের বিষয়, প্রচুর সাড়া এতে পাওয়া গেছে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, ইরি আর তোশি মারুকির অমর সেই সৃষ্টি ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে এবং শান্তির প্রয়োজনীয়তার বার্তা ভবিষ্যতেও আমাদের শুনিয়ে যাবে।