ইব্রাহীম চৌধুরী, নিউইয়র্ক : নিউইয়র্কের রকল্যান্ডে বসবাসরত কবি আলেয়া চৌধুরী মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ৩ আগস্ট রাতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাঁকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন কবির পারিবারিক স্বজন শাহরিয়ার সালাম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। তিনি ওই অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন। তাঁর পরিবারের কেউ আমেরিকায় নেই।

শাহরিয়ার সালাম বলেন, দেশ থেকে আলেয়া চৌধুরীর ভাই তাঁকে ফোন করে পাচ্ছিলেন না। প্রান্তিক শহর রকল্যান্ডে তাঁর কাছাকাছি থাকেন একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান শামসুল আলম। শামসুল আলমের পরিবারের সঙ্গে কবি আলেয়া চৌধুরীর যোগাযোগ ছিল। দেশ থেকে উদ্বিগ্ন ভাইয়ের ফোন পেয়ে ৩ আগস্ট সন্ধ্যার পর শামসুল আলম কবি আলেয়া চৌধুরীর অ্যাপার্টমেন্টে কমপ্লেক্সে যান। কোন অ্যাপার্টমেন্টে আলেয়া চৌধুরী থাকতেন, তা জানতেন না শামসুল আলম। এ কারণে কমপ্লেক্সের তত্ত্বাবধায়কের সাহায্য নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের তালা ভেঙে দেখা যায়, বাথরুমে আলেয়া চৌধুরীর মৃতদেহ পড়ে আছে। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।

আলেয়া চৌধুরীর আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আইনজীবী তাঁর শেষকৃত্যের (সমাধির) আয়োজন করছেন বলে জানান। মৃত্যুর সঠিক সময় মেডিকেল পরীক্ষার আগে জানা যাচ্ছে না।

আলেয়া চৌধুরী অবিবাহিত ছিলেন। নিউইয়র্কে একাই থাকতেন। তাঁর দেশে এক ভাই আছেন। নিউইয়র্কে আলেয়া চৌধুরী সংগ্রামী নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে গ্রাম্য পঞ্চায়েতের অমানবিক বিচারে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসেন। ঢাকায় এসে আলেয়া চৌধুরী হকারের কাজ নেন। খবরের কাগজ বিলি করে জীবীকা নির্বাহ শুরু করে চাঞ্চল্যকর খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি। ‘মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেশাগত গাড়িচালক হওয়ার প্রচেষ্টা’ দৈনিক বাংলার লোক-লোকালয় পাতায় সাংবাদিক হেদায়েত হোসাইনের কলাম তাঁর পরিচিতি বাড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে সেলাই মেশিন দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা না নিয়ে নারীদের গাড়িচালক পেশায় স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস করার প্রস্তাব রেখেছিলেন।

আলেয়া চৌধুরীর জন্ম ১৯৬১ সালে কুমিল্লার উত্তর চর্থা গ্রামে। মা আম্বিয়া খাতুন, বাবা সুলতান আলম চৌধুরী। অভাবের কারণে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। একজন স্বশিক্ষিত নারী তাঁর মেধা, মনোবল ও প্রতিভাকে সঙ্গী করে জীবনের কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়েছেন। ঢাকার আজিমপুর এতিমখানার পাশে অবস্থিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা অফিসের খেলাঘরে তিনি প্রথম স্বরচিত কবিতা পড়েন। এরপর ১৯৭০ সালে বেগম পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘জীবনের স্টেশনে’ পদ্মা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ইরান ও জার্মানি ভ্রমণ করেন। অবশেষে ২০ বছর বয়সে মাছ ধরার নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মার্কিন মুল্লুকে থিতু হন। সাম্রাজ্যবাদ, জঙ্গিবাদ এবং শান্তির সপক্ষে ঘৃণা প্রকাশ করে তাঁর কবিতাকে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেন।

১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কে সমস্যাজর্জরিত শিশুদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ‘প্রবলেম চাইল্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে আলেয়া চৌধুরী উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অস্তিত্বের সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ নিউইয়র্কের স্টার ম্যাগাজিন ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’ শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশ করে। ১৯৯৪ সালে দিনা হোসেন ‘আলেয়া: আ বাংলাদেশি পোয়েট ইন আমেরিকা’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। দিনা হোসেন এই তথ্যচিত্রের কারণে কলকাতা থেকে ‘কলাকৃতি’ পুরস্কার পান। তথ্যচিত্রটি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, জাভেথ সেন্টার, ম্যানহাটন, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়াসহ চীন ও বাংলাদেশে এটি প্রদর্শিত হয়। ২০১৬ সালে একটি নারীবিষয়ক পত্রিকা আলেয়া চৌধুরীর কর্মজীবনের সাফল্যকে স্বীকৃতি দান করেন।

বাংলাদেশ ও নিউইয়র্কে অবস্থানকালে কবির ১১টি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণকালে কবির তিনটি বই যথাক্রমে—‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, ‘মাদার’ ও ‘গড কিসড ইট’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইংরেজিতে ‘The Man: Father of Bangladesh’ বইটি আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির সম্পাদনায় ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।

২০১১ সালে নাইন-ইলেভেন ও বিশ্বের অমানবিক ঘটনার ওপর তিনি ‘পোয়েমস অ্যাবাউট ট্রুথ’ শিরোনামে একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন, যেটি রকল্যান্ড সিটি হলে গৃহীত হয় এবং কবিতার আসরে তিনি আমেরিকান কবিদের সঙ্গে কবিতা পাঠ করেন।