অনলাইন ডেস্ক : সিরিয়ার নতুন প্রশাসন সোমবার ঘোষণা দিয়েছে, তারা ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগতদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযান সমাপ্ত করেছে। এর আগে দেশটিতে ভয়াবহ সহিংসতায় এক হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস।

সংস্থাটি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে চলমান সংঘর্ষে নিহত ১,০৬৮ জনের অধিকাংশই আলাউইত সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের মধ্যে অনেককে নিরাপত্তা বাহিনী ও মিত্র গোষ্ঠীগুলো হত্যা করেছে। সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নিজেও এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

নতুন সরকারের প্রতিশ্রুতি
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হাসান আবদুল ঘানি জানিয়েছেন, লাতাকিয়া ও তারতুস প্রদেশে ‘নিরাপত্তা হুমকি ও পুরনো শাসনযন্ত্রের অবশিষ্টাংশ’ দমনে পরিচালিত সামরিক অভিযান সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা দেশটিকে নতুন করে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এক ভাষণে তিনি বলেন, সিরিয়া কোনো বিদেশি শক্তি বা দেশীয় গোষ্ঠীকে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে দেবে না। তিনি আরও বলেন, যারা নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।

সহিংসতার ভয়াবহতা
বৃহস্পতিবার সিরিয়ার নতুন নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আসাদপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হামলার পর থেকেই সংঘর্ষ শুরু হয়। সিরিয়ান অবজারভেটরির তথ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষে ২৩১ জন নিরাপত্তা কর্মী এবং ২৫০ জন আসাদপন্থী যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। তবে সিরিয়ার নতুন প্রশাসন হতাহতের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা জানায়নি।

আশঙ্কা ও আতঙ্কের পরিবেশ
লাতাকিয়া প্রদেশের জাবলেহ শহরের এক বাসিন্দা নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি-কে জানান, আমার পরিবার ও বন্ধুদের ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে মরদেহ সংগ্রহ করে গণকবরে দাফন করা হয়েছে। একইভাবে, লাতাকিয়ার ২২ বছর বয়সী এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফারাহ জানান, গত পাঁচ দিন ধরে আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও সন্ধ্যার পরপরই রাস্তা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। পুরো শহর যেন ভূতের নগরীতে পরিণত হয়।

এএফপি-এর এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, লাতাকিয়া থেকে জাবলেহ পর্যন্ত রাস্তাগুলো প্রায় ফাঁকা, শুধু সামরিক যান ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করছে। সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক গাড়ি রাস্তার পাশে পড়ে আছে।

সংখ্যালঘুদের আতঙ্ক
সহিংসতায় শুধু আলাউইত সম্প্রদায়ই নয়, খ্রিস্টানরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। রবিবার দামেস্কের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্ক জন এক্স বলেন, এই হামলায় বহু নিরীহ খ্রিস্টানও নিহত হয়েছে।
লাতাকিয়ার ৪২ বছর বয়সী খ্রিস্টান আইনজীবী মিশেল খুরি বলেন, আমরা সবাই বিপদের মুখে। এটা শুধু আলাউইতদের বিষয় নয়, বরং সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ আতঙ্কিত। আমাদের কেউ রক্ষা করতে আসবে না, আমাদের নিজেদেরই নিজেদের রক্ষা করতে হবে।

তদন্ত ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
নতুন সরকার একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই কমিটি সহিংসতায় নিহত বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা ও নিপীড়নের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্য উদঘাটনে আন্তর্জাতিক তদন্তকারীদের সিরিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় যেন তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

নতুন সরকারের কতটা নিয়ন্ত্রণে?
প্রেসিডেন্ট শারা বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS) এর নেতা ছিলেন। তিনি সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা তার শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সিরিয়া বিশেষজ্ঞ জোশুয়া ল্যান্ডিস বলেন, আলাউইত অধ্যুষিত উপকূলীয় শহরগুলোতে যেভাবে সশস্ত্র মিলিশিয়ারা তাণ্ডব চালিয়েছে, তা প্রমাণ করে যে নতুন সিরীয় বাহিনী পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি আরও বলেন, এই সহিংসতা প্রেসিডেন্ট শারার শাসন দৃঢ় করার চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

এদিকে ইরান সিরিয়ার সাম্প্রতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসব অভিযোগকে ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন। অন্যদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সিরিয়ার পুনর্গঠনে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, সিরিয়াকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তুরস্ক সব ধরনের সহযোগিতা করবে।