অনলাইন ডেস্ক : এবার ঢাকায় ঢুকছে বন্যার পানি। রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোকে ডুবিয়ে ১৬ বছর পর বন্যার পানি প্রবেশ করল রাজধানীতে। ডুবে গেছে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বেরাইদ, সাঁতারকুল, গোড়ান, বনশ্রী, বাসাবো ও আফতাবনগরের নিচু এলাকা। এ ছাড়া ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও ডিএনডি বাঁধ এলাকায়ও বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে। রাজধানীর আশপাশের বালু, তুরাগ ও টঙ্গী খালের পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বালু নদের পানি উপচে ঢুকে পড়েছে উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বেশ কয়েকটি এলাকায়। বেরাইদের ফকিরখালীর প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ঢুকেছে বানের পানি। সুপেয় পানির সংকটে এই অঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার। এলাকাবাসী বলেন, ‘রাজধানীতে আমরা ১৯৯৮-এর পর এত পানি দেখিনি। ডেমড়া থেকে টঙ্গী বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আমাদের কষ্ট লাঘব হচ্ছে না।’ স্থায়ী বাসিন্দারা বললেন, ‘রাতে যখন ঘুমিয়ে থাকি, মাঝ রাতে বিছানা পানিতে ভিজে যায়। তখন বিছানার ওপরে উঠে বসে থাকতে হয়। ’৯৮ সালে যেরকম বন্যা দেখেছি, ঠিক তেমনি ২০২০ সালে এসে এই রকম বন্যা দেখছি।’

পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যে বন্যা, সেটা পানি নামার কারণে। নিম্নাঞ্চলে পানি নামছে, তাই প্লাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দিনে সারাদেশে বৃষ্টি হওয়ায় প্রায় সব নদীতে পানি বেড়েছে। আগামী এক সপ্তাহ এ অবস্থা থাকবে। যেসব পথে পানি বের হওয়ার কথা, তা বালু দিয়ে ভরাট করে জবরদখল করা হয়েছে। সুতরাং পানি বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ায় রাজধানীর পানি বের হতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, মূলত পূর্বাঞ্চল দিয়ে পানি ঢুকছে রাজধানীতে। শীতলক্ষ্যা নদী ও বালু নদের পানি প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে নন্দীপাড়া, জুরাইন, বাড্ডা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তিনি জানান, আগামী এক সপ্তাহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এরপর পানি নেমে যাবে। তবে ১৯৮৮ সালের মতো ভয়াবহ বন্যা এবার হবে না বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

তবে, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও পূর্বাঞ্চল এখনো অরক্ষিত। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে জলাভূমি ভরাট করে। ফলে নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করলেই ঢুকে পড়ে লোকালয়ে।

নগরীর পূর্বাঞ্চল অপেক্ষাকৃত নিচু হওয়ায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন ঐ এলাকায় পানির স্রোত অনেক বেশি। স্থানীয়রা বলছেন, দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ধেয়ে আসা বন্যার পানির কারণে রাজধানীসংলগ্ন নদীতে পানি বেড়েছে। মূলত বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহ বালু নদের পানি বিপত্সীমার ওপরে থাকবে। তাই এই এলাকা নতুন করে আরো প্লাবিত হবে বলে মনে করেন পানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যতদিন বালু নদের পাড়ে বাঁধ নির্মাণ না করা হবে, ততদিন এই এলাকার মানুষকে বন্যার পানিতে ভাসতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (সাবেক নাসিরাবাদ ইউনিয়ন) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ওয়ার্ডের ইদারকান্দি, ফকিরখালী, বালুর পাড়, বাবুর জায়গা, দাসেরকান্দি, জোড়ভিটা, ত্রিমোহনী, উত্তরপাড়া, নাসিরাবাদ উত্তরপাড়া, নাসিরাবাদ টেকপাড়া, ইমামবাগের কিছু অংশ, উত্তরগাঁও, শেখের জায়গা ও নাগদারপাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় এক থেকে দেড় হাত পানি বেড়েছে। এসব এলাকায় বসবাসরত মানুষের বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। এলাকার মানুষ এখন নৌকায় কিংবা পানির মধ্য দিয়ে যাতায়াত করছে।

নিচু এলাকাগুলোতে গত এক সপ্তাহ ধরে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে। এলাকার মানুষ খুবই কষ্টে আছে। কাজকর্ম কমে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় নৌকা দিয়ে পারাপার হতে হচ্ছে। এভাবে আর দু-এক দিন গেলে মানুষের ঘরে ঘরে পানি ঢুকে পড়বে। তখন মাচা বানিয়ে থাকতে হবে। অনেকেই এখন সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তিস্তার পানির একটা অংশ ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা হয়ে এদিকে চলে আসে। সেই পানির অর্ধেক অংশ ভৈরব আর অর্ধেক শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের অববাহিকায় চলে আসে। তাই এর আশপাশের এলাকাগুলো তলিয়ে যাচ্ছে।

নগরবিদরা বলছেন, ১৯৮৮ সালের পর টঙ্গী থেকে আবদুল্লাহপুর, মিরপুর থেকে গাবতলী, গাবতলী থেকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ হয়ে শ্যামলী, আদাবর, মিরপুর এলাকায় আর বন্যা হয়নি। তাই যতদিন বালু নদের পাড়ে বাঁধ নির্মাণ না করা হবে, ততদিন এই এলাকার মানুষকে বন্যার পানিতে ভাসতে হবে। আগামী এক সপ্তাহ বালু নদের পানি বিপত্সীমার ওপরে থাকবে। তাই এই এলাকার আরো কিছু জায়গা নতুন করে প্লাবিত হবে।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপোর সাবেক মহাপরিচালক নদী বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, পূর্বাঞ্চলে যতদিন বাঁধ নির্মাণ না হবে, ততদিন বন্যায় ভাসতে হবে রাজধানীবাসীকে। ১০ দিন ধরে পানিবন্দি ঢাকার পূর্বাঞ্চলের মানুষ। পানি বাড়ছে প্রতিদিনই, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ভোগ। বালু নদের পাড় দিয়ে বন্যা প্রতিরোধের একটা বাঁধ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ডেও প্রকল্প কয়েক যুগ ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই বন্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে পূর্বাঞ্চলে বাঁধ দিতেই হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা ওয়াসা পানি নিষ্কাশনের জন্য পাঁচটি স্থানে পাম্প স্থাপন করলেও তা পূর্বাংশের নিম্নাঞ্চলকে বন্যামুক্ত করতে পারবে না। গোড়ান, বনশ্রী, বাসাবো, আফতাবনগর, সাঁতারকুলসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষের বসবাস। এছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যবর্তী ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও ডিএনডি বাঁধ এলাকায়ও বন্যার পানি আসতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর মধ্যে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার পানি দ্রুত বাড়ছে। ঢাকা শহরের পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকার পয়োনিষ্কাশন লাইন বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে গিয়ে পড়েছে। আর পূর্বাংশের পয়োনিষ্কাশন লাইন পড়েছে বালু ও শীতলক্ষ্যায়। কিছু অংশের নিষ্কাশন নালা হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন লেকের মধ্যে পড়েছে। ফলে ঢাকার চারপাশের নদীর পানি বিপত্সীমার কাছাকাছি চলে গেলে রাজধানীর বড় অংশের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে। আর বিপত্সীমা অতিক্রম করলে খালগুলো দিয়ে পানি নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে।

দোহার-নবাবগঞ্জ (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, পদ্মার পানি বৃদ্ধির কারণে ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। দোহার-নবাবগঞ্জ-মানিকগঞ্জ রক্ষা বাঁধের নিম্নাঞ্চলে ৩৫টি গ্রামসহ আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নবাবগঞ্জের কালিগঙ্গা গিলে খাচ্ছে শোল্লা ও কৈলাইল ইউনিয়নের অসংখ্য বসতবাড়ি ও কৃষিজমি। নবাবগঞ্জ উপজেলার কাঁশিয়াখালীর ঢাকা রক্ষা বেড়িবাঁধটি হুমকিতে রয়েছে বলে জানান সেখানকার বাসিন্দারা।

কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় তৃতীয় পর্যায়ের বন্যায় চারটি ইউনিয়নে পানি ঢুকে সবজিখেত নষ্ট করে দিয়েছে। প্রায় ৩০০ বাড়ি ডুবে গেছে।