হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

এক সময়ের প্রমত্তা মেঘনা নদী ভৈরব বাজার পয়েন্টে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। মাত্র এক দুই দশক আগেও এমনটি কেউ ভাবতেও পারতেন না। দেশবিভাগ পূর্ব ও বিভাগোত্তর সময়ে ভৈরবের কমলপুরের সুযোগ্য সন্তান মলয় কৃষ্ণ ধর-এর লেখা ‘ট্রেন টু ইন্ডিয়া: মেমোরিজ অব অ্যানাদার বেঙ্গল’ (পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত) অনুবাদের সময় ও ‘ভৈরব পুরাণ: শেকড়ের সন্ধানে’ অঞ্চলভিত্তিক বইটি লেখার প্রাক্কালে, আমি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বেশ কয়েকবার ভৈরবে গিয়েছি।

সেই সময়টাতেই আমি দেখেছি মেঘনার অবনতি। অনেকে তখন বলেছিলেনও যে, নদী রক্ষায় দ্রæত পদক্ষেপ না নিলে একটা বৃহৎ ইকোসিস্টেম ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। সেইসময় আমি কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ভৈরব নদীর দূষণ নিয়ে লেখার ফুরসত আমার ছিল না। আমি দুইটি বড় কাজে হাত দিয়েছিলাম।
অবশ্যি আমি ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে কয়েকটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম সম্ভবত ২০১৭ সালে।
ট্রেন টু ইন্ডিয়া ও ভৈরব পুরাণ প্রকাশিত হয় বইমেলা ২০১৮ ও ২০১৯ এ। দুটি গ্রন্থই ব্যাপক সাড়া ফেলে। ট্রেন টু ইন্ডিয়ার রিভিউ প্রকাশিত হয় অ্যামাজনের ‘গুডরিডস’ সাইটে। ট্রেন টু ইন্ডিয়া অনেকটা সময় ধরে বেস্টসেলিং-এর তালিকায় ছিল।

মেঘনা নদী প্রসঙ্গে আমার মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে অনেক স্মৃতি সঞ্চিত হয়ে আছে। সন্ধ্যায় বা রাতে এপারে নদীর পাথুরে কিনারায় বসে ওই পাড়ের আশুগঞ্জ সার কারখানার বিচিত্র বর্ণিল আলোক ছটা দেখতাম। মেঘনার পানিতে সেসবের বর্ণিল প্রতিফলন মনে বিচিত্র ভাবনার জন্ম দিত। আমার সঙ্গী হতো প্রয়াত বন্ধু আলম।

দূষিত মেঘনা নদী। ছবি: সংগৃহীত

সেইসময় মেঘনা নদী মেঘনাই ছিল। টলটলে জল, মিষ্টি ও সোঁদা গন্ধ, বাতাসে ভেসে বেড়াত পালের নৌকা। আমি আশির দশকের শেষের দিক ও নব্বই দশকের প্রারম্ভিক সময়ের কথা বলছি। ‘নদী দূষণ’ শব্দটাই যে অচেনা ছিল তখন। সেসময় বিভিন্ন কাজে আমি ঘনঘন ভৈরব যেতাম।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাগ পূর্ব সময়ে মেঘনা নদী ছিল ¯্রােতস্বিনী, করালগ্রাসী আর দুই কূল প্লাবিত করার মতো ঢল নামত। ট্রেন টু ইন্ডিয়া বইটিতে কৃষ্ণের বর্ণনায় মেঘনায় ঝড়ের তাÐব ছিল প্রলয়ংকরী।
বর্তমানে এই নদীর দূষণ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। সূত্রমতে, প্রতিদিন অন্তত ৫০টি পয়েন্ট দিয়ে ড্রেনের মাধ্যমে ভৈরব বাজারের ময়লা-আর্বজনা ও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীটিতে। হাওর জনপদের পাঁচ জেলার অন্তত ২০টি উপজেলার শতশত নৌকা প্রতিদিন মালামাল নিতে ভৈরবে যায়। সচেতনতার অভাবে এসব নৌকাও নদীর যত্রতত্র পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনা ফেলে যাচ্ছে।
এছাড়া ময়লার স্তূপ জমে নদীর পার পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। তীব্র দুর্গন্ধের কারণে এসব স্থানে চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালতের জব্দ করা বিভিন্ন মালামালও মেঘনায় ফেলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
যে নদীকে ঘিরে ভৈরব বন্দর গড়ে উঠেছে, সেই নদীরই আজ নাভিশ^াস উঠেছে।

ময়লা-আবর্জনা ও লক্ষকোটি পলিথিন নিক্ষেপ, অবৈধ দখলদারিত্ব, মানববর্জ্য আর বহু যুগ ধরে হাজারীবাগ ট্যানারির বিষাক্ত ক্রোমিয়াম বুড়িগঙ্গা নদীকে আজ মৃত নদীতে পরিণত করেছে।
ভৈরব ক্রমবর্ধমান একটি শহর। বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ছে দোকান ও আড়তের সংখ্যা। গড়ে উঠেছে কিশোরগঞ্জ জেলার বৃহত্তম জুতা তৈরির কারখানা ও দোকান। এসব আয়োজনের লক্ষ্যই বুঝি মেঘনাকে প্রবল দূষণের প্রান্তসীমায় নিয়ে যাওয়া। কেননা, এসব শিল্প-কলকারখানা অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠছে। দূষণের দায় সবার। এই দায় কেউ বহন করছেন না; কিন্তু দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে চলছেন। এটা বুমেরাং হয়ে তাদের স্কন্ধে আঘাত করবে, সেটা এখনই ভেবে নেয়া উচিৎ।
আমি ও ভৈরবের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, শিক্ষাবিদ ও মাদ্রাসা স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ- মো. রফিকুল ইসলামের বড়ছেলে মো. রাকিব সরফুদ্দিন (পেশায় আইনজীবী) মাত্র ক’দিন আগে একটা বিশেষ কাজে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলাম। ভৈরবে আমরা নাশতা সেরে কিশোরগঞ্জ রওনা দিয়েছিলাম। ভৈরবে ফিরতে ফিরতে সাঁঝ ঘনিয়ে আসে। আমার ইচ্ছে ছিল দূষণচিত্রের কিছু ছবি তোলা। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। সন্ধ্যায় গেলাম ভৈরব প্রেস ক্লাবে। সেখানে মেঘনা নদী দূষণের প্রসঙ্গটি উঠল। দূষণের আকার-প্রকার-ব্যপ্তি নিয়ে আলোচনা হলো।

ভৈরব বন্দর ও শহর এবং মেঘনা নদী-এই দু’টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি দূষিত হলে অন্যটিও দূষিত হয়ে উঠতে পারে। মেঘনা নদীর দূষণ কমাতে বা আরও যেন দূষিত না হয়, সেই বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে জনসচেতনতা সৃষ্টি। এর দুষণ কমাতে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর, ও প্রশাসনকে এখনই তৎপর হতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ভৈরবের ব্যবসায়ী, গণ্যমান্য ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ জনসচেতনতার কাজটি চালিয়ে গেলে দূষণ অনেকাংশেই কমে যাবে। আর বিবিধ নৌযানের মালিককে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে কালবিলম্ব না করে।
এ নদী একসময় এ অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ ছিল। কিন্তু ক্রমাগত ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানি ভয়াবহ রকমের দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে এই পানি এখন ব্যবহারের অযোগ্য। দূষিত পানির প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর।

এখানকার পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ধ্বংসের মুখে চলে গেছে মৎস্য সম্পদও। আগের মতো আর মাছ মিলছে না নদীতে। আবর্জনা জমার কারণে কমে যাচ্ছে নদীর ঢেউও। নদীর ওপর নির্ভরশীল এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ বিপন্ন।
এই বিপন্নতা কাটিয়ে উঠতে এখনই সময় সমন্বিত উদ্যোগের। তা না হলে অচিরেই মেঘনা নদীও পরিণত হবে বুড়িগঙ্গার মতো মৃত নদীতে।