অনলাইন ডেস্ক : দেশের বিভিন্ন নদনদীর পানি এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো থেকে পানি নামতে পারছে না। পানির চাপে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। গাইবান্ধায় গত রবিবার রাতে ভেঙে গেছে বাঙ্গালী নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। নাটোরের সিংড়ায় ভেঙেছে আত্রাই নদীর বাঁধ। সোমবার ফরিদপুর শহর রক্ষা বাঁধে ফের ধস নামে।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, এখনো জেলার বিভিন্ন নদনদীর পানি বিপত্সীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বোচাদহ গ্রামে বাঙ্গালী নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ গত রবিবার রাতে ভেঙে গেছে। ফলে উপজেলার বোচাদহ, বালুয়া, ছয়ঘরিয়া, শ্রীপতিপুর, কুমিড়াডাঙা, পুনতাইর, পাছপাড়া, গোপালপুর, জিরাই, সোনাইডাঙ্গা, হরিনাথপুর-বিশপুকুর, কাজিরচক, পচারিয়া, মাদারদহ, কাজীপাড়া, ফকিরপাড়া ও পানিয়া গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল এবং ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে।

সাদুল্লাপুরের কামারপাড়া, রসুলপুর, দামোদরপুর ও বনগ্রাম ইউনিয়ন এবং গাইবান্ধার কুপতলা, খোলাহাটি, ঘাগোয়া ও গিদারী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি ও সড়কগুলোতে হাঁটুপানি জমে আছে। জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, পলাশবাড়ী গোবিন্দগঞ্জ, সাদুল্লাপুর ও গাইবান্ধা সদরসহ সাত উপজেলায় ৩৮টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, সোমবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি জানান, রবিবার ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ৮৮ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি বিপত্সীমার ৭১ সেন্টিমিটার ও করতোয়া নদীর পানি বিপত্সীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

সিংড়ায় ভেঙে গেছে আত্রাই নদীর বাঁধ

সিংড়া (নাটোর) সংবাদদাতা জানান, নাটোরের সিংড়া উপজেলার মহেশচন্দ্রপুর কলকলি নামক স্থানে আত্রাই নদীর বাঁধ ভেঙে কলম-চানপুর বিলে পানি প্রবেশ করেছে। এতে করে কলম, কুমারপাড়া, বলিয়াবাড়ী, জগতপুর, নজরপুর, কলকলিপাড়াসহ ১০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে জানান কলম ইউপি চেয়ারম্যান মঈনুল হক চুনু। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান জানান, আমরা বাঁধটি রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। রবিবার আত্রাই নদীর পানি বিপত্সীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে উপজেলার সুকাশ ও হাতিয়ান্দহ ব্যতীত ১০টি ইউনিয়ন এবং সিংড়া পৌর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছে। সিংড়া পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। সিংড়া বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন। পৌর এলাকায় ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন সিংড়া পৌরসভার মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস।

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) সংবাদদাতা জানান, শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে গত কয়েক দিনের অতিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে আবারও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আমন বীজতলাসহ সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সোমেশ্বরী নদীর পানির তোড়ে ধানশাইল-কুচনীপাড়া সড়কের বাগেরভিটা ব্রিজ হুমকির মুখে পড়েছে। উপজেলার দাড়িয়ারপাড়, সারিকালিনগর, দড়িকালিনগর, ধানশাইল, বাগেরভিটা, কান্দুলী, কুচনীপাড়াসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের শত শত মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট পানির নিচে থাকায় যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।

ফরিদপুর শহর রক্ষা বাঁধে আবারো ধস

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, ফরিদপুর সদর উপজেলার আলিয়াবাদ ইউনিয়নের সাদীপুর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফের ভাঙন দেখা দিয়েছে। সোমবার বিকালে বাঁধের ৪৫ মিটার অংশ ধসে গেছে। এর আগে গত শনিবার বাঁধের ৮০ মিটার অংশ ধসে পানি ঢুকে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার জানান, পানির যে চাপ তাতে এই মুহুর্তে বাঁধ মেরামত করা সম্ভব নয়। পানির চাপ কমলে কাল থেকে বাধটি পুনরায় মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এদিকে বন্যায় জেলার ৭ উপজেলার ৫৪০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। সোমবার সন্ধ্যায় পদ্মা নদীর পানি ফরিদপুর অঞ্চলে বিপদসীমার ১১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র।

চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে গত কয়েকদিনে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় সব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার। অনেকেই গরু-ছাগলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বেড়িবাঁধ, হেলিপ্যাড ও আশ্রয়কেন্দ্রের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন কাঁচা-পাকা সড়ক।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহামুদ জানান, পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে সোমবার বিপত্সীমার ১১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চরাঞ্চলে স্যানিটেশন, গো-খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আলভীর হোসেন জানান, বন্যায় এ পর্যন্ত ৫৩০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সবকটি নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নতুন নতুন এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। জেলার চারটি উপজেলায় ৩২ হাজার ৮ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চাল, শুকনা খাবার, শিশুখাদ্য ও গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুর জেলার ৩৫টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার পাশাপাশি ৯৮২টি পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে পানি

শিবালয় (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, যমুনার পানি আরিচা পয়েন্টে গত সোমবার বিপত্সীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কয়েক স্থানে পানি উঠেছে। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের পাকা-কাঁচা রাস্তার প্রায় ৩০ শতাংশই পানির নিচে। রাস্তার ভাঙনরোধে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। দুর্গম চরাঞ্চল ও হাট-বাজারের নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। অনেকেই গবাদিপশু নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। তীব্র স্রোতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি-লঞ্চ চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় উভয় ঘাটে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, যমুনা ও ধলেশ্বরীর শাখা নদী বংশাই-লৌহজং নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মির্জাপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বন্যার পানি বাড়ায় কোরবানির পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেড় শতাধিক খামারি।

আনাইতারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ফতেপুর, লতিফপুর, মহেড়া, জামুর্কি, বহুরিয়া, ভাওড়া, ভাদগ্রাম, ওয়ার্শি, বানাইল এবং আনাইতারা ইউনিয়নের আঞ্চলিক সড়কগুলো তলিয়ে গেছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. হারুন অর রশিদ জানান, ২ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বন্যার পানি ঢুকেছে। কুমুদিনী হাসপাতাল ও শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে আগেই ঢুকেছে পানি।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মির্জাপুর উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জানিয়েছেন, উপজেলার ৪০০ কিলোমিটার পাকা-আধাপাকা সড়ক তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকার রাস্তার তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।