অনলাইন ডেস্ক : ‘করোনামুক্ত’ সনদ ছাড়াই এখন কেউ বিদেশে যেতে পারছেন না। ২৩শে জুলাই থেকেই এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিদেশগামীরা এই ক’দিনে সনদ নিয়েই বিদেশে গেছেন। শুরুতে সব ধরনের প্রস্তুতির কথা বলা হলেও এখন প্রতিদিনই নানা দুর্ভোগে পড়ছেন বিদেশগামীরা। সময়মতো রিপোর্ট না পাওয়া, নমুনা দেয়া ও রিপোর্ট সংগ্রহে নানামুখী ভোগান্তির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। সর্বশেষ করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেয়ার জন্য চট্টগ্রামে রোববার রাতভর সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাধিক বিদেশযাত্রীদের। সময়মতো রিপোর্ট না পাওয়ায় তাদের কেউ কেউ নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন। এদিকে ঢাকার ল্যাবে পরীক্ষার দুই রকম রিপোর্ট পাওয়ায় রোববার বিদেশে যেতে পারেননি সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের মেয়ে ঐশী খান।
শুরুতে তার করোনা সার্টিফিকেট জাল বলে খবর আসলেও গতকাল সংশ্লিষ্ট ল্যাব তাদের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসায় বিদেশে যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে। সামনে আরো অনেক বেশি যাত্রী পরীক্ষার জন্য যাবেন। এই অবস্থা ব্যবস্থাপনার উন্নতি না হলে ভোগান্তি দিন দিন আরো বাড়বে।
সিলেটে ভোগান্তি: করোনা সার্টিফিকেট হাতে পেতে নানা ভোগান্তিতে সিলেটের প্রবাসীরা। করোনা সার্টিফিকেটের জন্য তাদের তিনদিনই উপস্থিত থাকতে হচ্ছে সিলেটের সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। এতে করে সিলেট শহর কিংবা আশেপাশের উপজেলার প্রবাসীরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের প্রবাসীরা পড়েছেন দুর্ভোগে। নির্ধারিত সময়ের আগে প্রবাসীদের কাউকে আসতে হচ্ছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, মধ্যনগর কিংবা হবিগঞ্জের বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ থেকে। টানা তিনদিন আসা-যাওয়া এবং রিপোর্ট করাতে অনেক প্রবাসীই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সিলেট বিভাগে থাকা প্রবাসীদের জন্য সার্টিফিকেট দিচ্ছে সিলেটের সিভিল সার্জন কার্যালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়ার পরপরই সিলেটের সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশন, নমুনা সংগ্রহ ও রিপোর্ট প্রদানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এ সম্পর্কে জেলা সিভিল সার্জন বিদেশগামী প্রবাসীদের ফ্লাইট শিডিউলের উপর ভিত্তি করেই রিপোর্ট রেজিস্ট্রেশন, নমুনা গ্রহণ ও রিপোর্ট প্রদানের দিনক্ষণ ধার্য করে দিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, একজন প্রবাসী ফ্লাইটের ঠিক আগের দিন হাতে পান করোনা সার্টিফিকেট। কিন্তু তার আগে প্রথম দিন তাকে সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে এসে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এই রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায়ও ভোগান্তি রয়েছে। নির্ধারিত যেসব বুথ করে দেয়া হয়েছে সেসব বুথে প্রবাসীদের ভিড় লেগেই থাকে। নগরের উপশহরের ক্রীড়া কমপ্লেক্সে প্রবাসীরা প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ করার পর বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার অনেকেই অবস্থান করেন হোটেলে। দ্বিতীয় দিন সিলেটের সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এসে তারা নমুনা দেন। কিন্তু নমুনা দেয়া নিয়েও প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নমুনা সংগ্রহে স্বাস্থ্যকর্মীরা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন না। সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডল জানিয়েছেন, সিলেটে চার দিনে ৫০০ নমুনা ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। প্রবাসীরা যাতে সঠিক সময়ে সঠিক রিপোর্ট পান সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এখন কেবল শুরু করা হয়েছে। প্রবাসীরা যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এদিকে সিলেটে নমুনা পরীক্ষায় অনেক প্রবাসীর করোনা পজেটিভ হচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিলেটে এরই মধ্যে একশ’র মতো প্রবাসী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের রিপোর্ট পজেটিভ আসছে তাদের সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে না। তাদের আইসোলেশনে থাকার নিয়মাবলী জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সেটিও দেয়া হচ্ছে।
ফ্লাইট শিডিউলের কথা বিবেচনা করে ১৪ দিন পর তাদের আবার করোনা পরীক্ষার পর সার্টিফিকেট দেয়া হবে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল জানিয়েছেন, ‘যেসব প্রবাসীর ফলাফল পজেটিভ আসছে তাদের অনেকেরই উপসর্গ নেই। এরপরও তাদের আইসোলেশন ও চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। তারা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’ সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রবাসীদের বসার জন্য মাত্র কয়েকটি চেয়ার বাইরে রাখা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমনেচ্ছুক প্রবাসীরা সকাল ৯টা থেকে জটলা বেঁধে বসে আছেন। অনেকেই আছেন দাঁড়িয়ে। নেই কোনো সামাজিক দূরত্ব। একজন চেয়ার থেকে উঠে গেলে আরেকজন এসে হাত দিয়ে মুছে বসছেন চেয়ারে। আর অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই টিকিটের জন্য গিয়ে ভিড় করছেন কাউন্টারে। কার আগে কে টিকিট নেবেন রয়েছে সেই প্রতিযোগিতাও। দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে মাইকের মাধ্যমে বার বার অনুরোধ করে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের কথা। তবু নেই স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার বিন্দুমাত্র প্রয়াস। বেলা ১১টার পর থেকে রিপোর্ট নিতে আসতে থাকেন আগের দিন নমুনা দিয়ে আসা বিদেশযাত্রী ও তাদের স্বজনরা। সাড়ে ১১টার পর শুরু হয় রিপোর্ট দেয়া। রিপোর্ট নিতে আসাদের সিরিয়াল অনুযায়ী ডাকা হলে একজন করে গিয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করার কথা থাকলেও সেখানে এক সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ জন গিয়ে ভিড় করেন। প্রবাসীরা জানিয়েছেন, রেজিস্ট্রেশন, নমুনা দিতে এসে অনেকেই সংক্রমণ হতে পারেন। বিষয়টিকে আরো সহজ করার দাবি তাদের। সিলেট বিভাগের বিদেশযাত্রীদের করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার একমাত্র স্থান হচ্ছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাব।
চট্টগ্রামে রিপোর্টের জন্য রাতভর অপেক্ষা: সোমবার ভোর তখন সাড়ে তিনটা। হঠাৎ বেজে উঠে মুঠোফোন। রিসিভ করতেই বলে উঠেন, আমি আবুল বাশার বলছি, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল থেকে। কি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সকাল ৮টার ফ্লাইটের যাত্রী আমি। যাবো দুবাইয়ে। কিন্তু করোনা বা কোভিড-১৯ সনদ না পাওয়ায় আমি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে অবস্থান করছি এখনো। তার পাশ থেকে একই মুঠোফোনে শফিউল আলম নামে আরেকজন বলে উঠেন, আমি আমিরাত প্রবাসী। আমিও বসে আছি সনদের জন্য। শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে সকাল ৬টার ফ্লাইটের যাত্রী আমি। তিনি বলেন, শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে কমপক্ষে আড়াইশ’ বিদেশগামী হাসপাতালের সামনে রাতভর অবস্থান করছে। নাওয়া-খাওয়া নেই, চোখে ঘুম নেই। সে কি অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। আমাদের জন্য যদি বিন্দুমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে মনে করেন তাহলে একটু এসে দেখে যান।
তার পাশ থেকে জরিপ আলী নামে ওমান প্রবাসী একজন বলেন, আমি সকাল ৬টার ফ্লাইটের যাত্রী। এখানে যারা আছেন সবার কারো ৬টায়, কারো ৮টায়, কারো ৯টায় ফ্লাইট। কিন্তু এখনো করোনার সনদ মেলেনি কারোরই। অথচ ফ্লাইট ছাড়ার অন্তত ৬ ঘণ্টা আগে করোনার (কোভিড-১৯) সনদ পাওয়ার কথা। সে হিসেবে আমাদের হাতে আছে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা, সঙ্গে টেনশন। ফ্লাইট যদি মিস হয়, তাহলে অনেক টাকা গচ্চা যাবে, সঙ্গে টিকিটের টাকাও মার যাবে।
বিদেশগামীরা বলেন, বিমানের টিকিট নিশ্চিত করে ৩৫০০ টাকায় দু’দিন আগে পরীক্ষার জন্য নমুনা দেই। তখনও ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। যার রিপোর্টের সনদ রোববার বিকালে দেয়ার কথা। কিন্তু রাত ১২টায়ও রিপোর্ট না পেয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে অবস্থান নেয় বিদেশগামীরা। বলা হচ্ছে-সার্ভারের সমস্যা।
বিদেশগামীদের মতে, প্রায় ২৫০ জন বিদেশগামী সিভিল সার্জন অফিসের সামনে রাতভর অবস্থান করেন। এরমধ্যে অনেকের করোনা পজেটিভ পাচ্ছে, যারা আশেপাশেই দাঁড়ানো। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। তাদের এ সমস্যার কারণে অনেক প্রবাসীর বিদেশ যাত্রাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। রাতভর অপেক্ষা করে অনেকে সকালে রিপোর্ট হাতে পান। কয়েকজন দেরিতে রিপোর্ট পাওয়ায় নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পারেননি।
ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, সার্ভার ডাউনের কারণে রোববারের রিপোর্ট দিতে বিলম্ব হয়েছে। এতে বিদেশগামীরা কষ্ট পেয়েছেন। ওইদিন ২৮১ জন বিদেশগামীর করোনা সনদ দিতে হয়েছে। এতে আমাদেরও কষ্ট হয়েছে। উনারা ঘুমাননি, আমরা ঘুমিয়েছি তা নয়। তবুও এ জন্য আমি দুঃখিত। এরপরও সবাইকে আমরা রাতের শেষের দিকে করোনা সনদ দিতে পেরেছি। আশা করি বিমানে উঠতে কারো অসুবিধা হয়নি।
গত সোমবার থেকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা শুরু হয়। মঙ্গলবার থেকে বিআইটিআইডি প্রবাসীদের করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু করে। চট্টগ্রামে শনিবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে ৬৬৩ জন বিদেশযাত্রীর নমুনা সংগ্রহ করেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এ পর্যন্ত ১১ জন প্রবাসীর করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বিদেশগামী প্রায় সব ফ্লাইটই ছাড়ছে ঢাকা থেকে। ফলে যাত্রী যদি চট্টগ্রাম, সিলেট বা অন্যান্য জেলার বাসিন্দা হয় তার ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। এ ধরনের যাত্রীকে নিজ শহর থেকে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে নিয়েই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়।