হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

অনেক কাল আগের কথা। তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি ঢা.বি’র ইংরেজি বিভাগে। ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্য পাতার দায়িত্বে ছিলেন কবি আল মুজাহিদী। তখন আমার গল্প লেখার প্রারম্ভিক সময়। মুজাহিদী ভাই প্রায়ই বিকেলে হাঁটতে বেরুতেন। হাঁটতে হাঁটতে কখনও বা আমাদের বিক্রমপুর হাউসে আমার নিভৃত কোঠায় আসতেন।

তিনি গোপিবাগ থার্ড লেনে থাকতেন। লম্বা, স্বাস্থ্যবান মুজাহিদী ভাই ঢোলা পাজামা আর পাঞ্জাবি পরতেন। কখনও পাঞ্জাবির ওপর কটি পরতেন। তাঁকে জবরদস্ত দেখাত সেই পোশাক আর অবয়বে। আমার কোঠায় এলে আলোচনা হতো সাহিত্য বিষয়ে। আমি গান করতাম, সেই বিষয়ে। আমার গানও তিনি শুনতেন।

একদিন তিনি এলেন। একটু বিড়ম্বিত বা চিন্তিত। আমি চা পরিবেশন করলাম। তিনি জানালেন যে, আসছে সংখ্যাকে তিনি কবি শেলির ২০০তম জন্মবার্ষিকী দিয়ে সাজাতে চান। আমি আগ্রহে তাকালাম তাঁর দিকে। শেলির কবিতা আমি পড়েছিলাম। আমাদের পাঠ্য ছিল ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক যুগের পাঁচ কবি, যাঁদের অন্যতম শেলি। অন্যরা হলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল কোলরিজ, জন কীটস ও লর্ড বায়রন।

মুজাহিদী ভাই বললেন, তিনি কোনো লেখা পাচ্ছেন না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি লিখতে পারবে? আর অন্তত একটা কবিতার অনুবাদ। আমার মনে পড়ল, আমি তৎকালিন দি বাংলাদেশ অবজারভারের ইয়ং অবজারভারে ইংরেজিতে নিবন্ধ লিখতাম। প্রকাশ করতেন সেই পাতার দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ কবি টমাস অ্যানসেল।

বললাম, পারব। বলার সাথে সাথে কোন্ কবিতাটা বাংলায় অনুবাদ করব সেটাও ঠিক করে ফেললাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি কিছু ভাবছ?
বললাম, না। তবে গুরুদায়িত্ব।
সে তো বটেই। আজ রাতেই লিখতে বসে পড়ো।
মুজাহিদী ভাই চলে যাবার পর সামান্য হেসে নিলাম। মনে মনে ঠিক করেছিলাম শেলির সবচেয়ে ছোটো কবিতাটাই অনুবাদ করব। কবিতাটা হলো ‘ওজিমেনদিয়াস অব ইজিপ্ট।’ ঢা.বি’র ইংরেজি বিভাগে পড়ার আগে এসব কবি বা কবিদের নামও বোধহয় শুনিনি।

শেলির Ode To The West Wind কবিতার একটা চরণ আওড়ালাম:
“If winter comes, can spring be far behind?”

বসে গেলাম লিখতে। তখন আমি লিখতাম নিউজপ্রিন্ট পেপারের প্যাডে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে। আব্বা সেসব প্যাড আনতেন পত্রিকা অফিস থেকে প্রবন্ধ লিখতে বা বাসায় বসে অফিসের লেখার কাজ এগিয়ে নিতে। কখনও বা বাইন্ডিং খাতায় ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতাম। রাতারাতি অনুবাদ করে ফেললাম ওজিমেনদিয়াস!

পরদিন থেকে লেখা শুরু করলাম কবি শেলি সম্পর্কে। তিনদিনের মাথায় আমার লেখা শেষ হলো। একটু রিভিশন দিয়ে পরদিন ইত্তেফাকে গিয়ে মুজাহিদী ভাইয়ের হাতে লেখা ধরিয়ে দিলাম।

আমার ধারণা ছিল আরও কেউ হয়তো লেখা দেবেন। সেজন্য বুক দুরু দুরু করছিল। আমার লেখা যদি মানসম্মত না হয়? যদি বাদ পড়ে? সাধারণত আমার লেখা নিয়ে মুজাহিদী ভাই লেখা প্রকাশ করার আগে কিছু বলতেন না। অন্য বিষয়ে আলাপ করতেন।

অবশ্যি আমি তাঁর চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলাম। আমার ওপর আস্থা না থাকলে আমাকে দিয়ে তিনি এত খাটাখাটি করাতেন না। এই বিশ্বাসও আমার ছিল।

পরের সংখ্যা প্রকাশিত হলো। আমি তো অবাক! পুরো পাতা জুড়ে আমার লেখা। অবশ্যি অন্য এক লেখকের লেখার খানিকটা সেখানে স্থান পেল। ব্যালেন্স করা আরকি। যে অন্যজনের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটার বেশির ভাগই জাম্প করানো হয়েছে অন্য পাতায়।

পরবর্তীতে মুজাহিদী ভাই ও আমার সমসাময়িক দুয়েকজন গল্পকার বলেছিলেন যে, অনুবাদটা নাকি চমৎকার হয়েছে।
আমি তো খুশিতে আত্মহারা। পুরো সাহিত্য পাতায় আমার লেখায় সয়লাব! তারপরে ৩০০ টাকা সম্মানী তো পাবই।

সেই সময়টা আর এই সময়টা। আকাশ আর পাতাল। দয়া করে এটা কেউ মনে করবেন না যে, আমি সাহিত্য সম্পাদকের চেনা ও প্রতিবেশী হওয়ায়, আর আমার আব্বার প্রতি তাঁর সমীহ ভাবের জন্য তিনি ইত্তেফাকে আমার গল্প-সমালোচনা-সাহিত্য প্রবন্ধ প্রকাশ করতেন। বিষয়টি মোটেও তা নয়। আমি তাঁর অফিস কক্ষে প্রায়ই যেতাম। গল্প দিতাম। তিনি সেইসব গল্প কীভাবে আরও উন্নত করা যায়- সেসব বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। এভাবে একদিন আমার গল্প প্রকাশিত হলো।

সেই তারুণ্যের কথা মনে করে অবাক হয়ে যাই, কতটা পরিশ্রমী ও নিবেদিত ছিলাম। সাধনা কী বিষয়, সেটাও তখন শিখেছিলাম। গান চর্চা করতাম, সাহিত্য আড্ডা দিতাম, পত্রিকা থেকে পত্রিকান্তরে যেতাম। রাত জেগে লিখতাম। কখনও বা মাঝরাতেই হারমোনিয়ামে সুরের চর্চা করতাম। আজ যেন অনেকটাই ক্লান্ত আমি। জীবনের বেশিরভাগ পথ পাড়ি দিয়ে এখনও আমি নতুন বসন্তের অপেক্ষায় থাকি।

জীবনটা হয়তো এমনি। কোনো না কোনো সময় ক্লান্তি বা উদাসীনতা এসে যাবে। হয়তো হারিয়ে যাবে সৃষ্টিশীলতা। সেই হারাবার ভয়ে এখনও কিছু কিছু কাজ করে যাচ্ছি। গাইছি, লিখছি।

একসময় থামবে কোলাহল।