অনলাইন ডেস্ক : টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কয়েক জেলার লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে ফেনী, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজারসহ বেশ কয়েকটি জেলার বাসিন্দারা। বিভিন্ন জেলায় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
দুই দিন ধরে ঢাকার তুলনায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলজুড়ে বৃষ্টি ছিল বেশি। আগামীকাল বৃহস্পতিবারও তা অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় যে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে।
সিলেটে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে
সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টের নদ-নদীর পানি বেড়েছে। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটে বৃষ্টিপাত কমে এলেও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। সিলেটের বৃষ্টিপাতের ওপর এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করে না। মূলত ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, চলতি সময়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট প্লাবিত হয়েছে। আজ বুধবার সকাল ১০টার পর ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পানির তোড়ে গাজীর বাজার এলাকায় একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী অবস্থায় আছে ৩০০ পরিবার।
বন্যার কারণে সাজেকে আটকা ২ শতাধিক পর্যটক
টানা চারদিনের বৃষ্টিতে চেঙ্গী ও মাইনী নদী পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে এ মৌসুমে চতুর্থবারের মতো বন্যা দেখা দিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলায়।
জেলার ৫০টি গ্রাম ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। বাঘাইহাট এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ায় সাজেকে আটকা পড়েছে দুই শতাধিক পর্যটক। খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা এবং মেরুং ইউনিয়নের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেডকোয়ার্টার এলাকা প্লাবিত হওয়ায় রাঙ্গামাটির লংগদুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ির পৌরসভার প্রশাসক নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘বন্যাদুর্গতদের জন্য ১২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২ হাজার ৫৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।’
কুমিল্লায় ৪ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে
টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে কুমিল্লার গোমতী নদীতে পানি বেড়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় চার হাজার হেক্টর এলাকার ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বুধবার সকাল পর্যন্ত নদীটির পানি বিপৎসীমার নিচে অবস্থান করলেও দ্রুতই দুকূল ছাপিয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
গোমতীপাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গত ১০ বছরের মধ্যে নদীটিতে এত পানি দেখেননি তারা। পানি বাড়ায় চরাঞ্চলের সহস্রাধিক পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লায় গোমতীর চরে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আইয়ুব মাহমুদ জানান, সেখানে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি সরে না যাওয়া পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভা ডেকেছেন।
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে নতুন করে ছাগলনাইয়া উপজেলার অনেক এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি মাঠ এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে বলে স্থানীয়রা বলছেন। পরশুরামে বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা যায়। ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কয়েকটি ডিঙি নৌকায় লোকজনকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলেও বেশির ভাগ মানুষ এখনো পানিবন্দী। দুর্গতদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরাও কাজ করছেন। বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ইতিমধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চল ও আশপাশ এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে দেশের বেশির ভাগ এলাকা ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়া বইছে। সেই সঙ্গে মৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এতে সব মিলিয়ে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার কারণে উপকূলসহ দেশের নদীবন্দরগুলোতেও ঝোড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, মৌসুমি বায়ু শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া সুস্পষ্ট লঘুচাপটি দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থান করছে। যে কারণে আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বৃষ্টি বাড়তে পারে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বৃষ্টি আরও বেশি হতে পারে। আগামী এক সপ্তাহ বৃষ্টি চলতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ময়মনসিংহ, সিলেট ও দেশের উপকূলীয় এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকাগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে না যেতে বলা হয়েছে।
চলতি বছরে পাঁচ দফা বন্যার কবলে দেশ
চলতি বছর পাঁচ দফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। কেন হঠাৎ এত বেশি বন্যা, প্রশ্নটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। অপরিকল্পিত বাঁধ, নদীর নাব্যতা সংকট, খাল হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বন্যা সৃষ্টি হয়। নদী, খাল যে পরিমাণ পানি বহন করতে পারত, সেটা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বৃষ্টিপাত হলেই বন্যার কবলে পড়ছে মানুষ।
হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি কি স্বাভাবিক ঘটনা নাকি অন্য কোন কারণে নদনদীর পানি বাড়ছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের বর্ষা মৌসুম। এই সময় বাংলাদেশে স্বাভাবিক বন্যা হয়। আমাদের বৃষ্টির ৭০ শতাংশই এই সময় হয়। শুধু আমাদের নয়, উজানে থাকা ভারতের একটা অংশেও এই সময়ে ভারী বৃষ্টি হয়। ফলে এই সময় আমাদের এখানে বন্যার বিষয়টি নির্ভর করে ওদের ওখানে কী পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে তার উপর। আমাদের তিস্তায় কিন্তু দ্রুত পানি চলে আসে, আবার দ্রুত কমে যায়। এখন ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার উপর আছে। এর প্রধান কারণ জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫২ ভাগ বৃষ্টি কম হয়েছে। ওই সময় চট্টগ্রামে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। এক মাসের বৃষ্টি ৫-৬ দিনে হয়ে গেছে। প্রতি বছরই এখানে বর্ষায় যে পানি আসে সেখানে কিছু না কিছু বন্যা হয়। এই মুহূর্তে বড় বন্যার আশঙ্কা কম। তবে মৌসুমী বায়ু সক্রিয় আছে। ১৯৯৮ বা ১৯৮৮ সালেও কিন্তু সেপ্টেম্বরে বন্যা হয়েছে। ফলে আমাদের প্রস্তুতি রাখতেই হবে। যাতে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়।