হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
পুরোনো জঙ্গুলে বাড়িতে, তা-ও আবার ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ির চারশত বছরেরও অধিক সময়ের আগের কোঠাগুলোতে যদি রহস্যেরই গন্ধ না পাই, কিংবা অ্যাডভেঞ্চার-তাড়িত না হই তবে শরীরমন চাঙা হবে কী করে?
আমরা জঙ্গলবাড়িতে পৌঁছালাম রাতে; দিনে তেমন রহস্য খুঁজে পাওয়া যায় নাÑএরকম কোনো অজুহাতে নয়। আসলে নিয়তিই আমাদেরকে জঙ্গলবাড়িতে নিয়ে এলো রাতের বেলায়। আমরা দুইজনের একটা ছোট্ট দল। আড়াইজনের দল বলা যেতে পারে। ড্রাইভার ছিল গাড়িতে বসা। আর গাড়িটা কাছাকাছিই ছিল।
রাতের বেলা কেউ হয়তো কোনো ঐতিহাসিক বা প্রতœতাত্তি¡ক স্থান দেখতে যায় না; আমি গিয়েছিলাম। সঙ্গী ছিল রাকিব। শীতের সময়, তাই দিন ছোটো; তবুও বেলা থাকতেই রওনা দিয়েছিলাম কিন্তু ভৈরব থেকে করিমগঞ্জ যাবার মহাসড়কের কয়েকটি স্থান বিপজ্জনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত থাকায় আমাদের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে এক পর্যায়ে।
আরও আগে রওনা দেয়া যেত কিন্তু ভৈরবে আমরা অনেকটাই দেরি করে ফেলেছিলাম। মন্দ কাজে নয়; ‘ভৈরব পুরাণ’এর কাঁচামাল যুগাতেই অবস্থান করেছিলাম। কটিয়াদির কাছাকাছি এসে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম ভৈরবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টে শেষ পর্যন্ত জঙ্গলবাড়ির দিকেই চলতে লাগলাম। এখানে বলে রাখি যে, আমার কয়েকবার ভৈরব সফর ছিল ২০১৯ সালে প্রকাশিত আমার অঞ্চলভিত্তিক গ্রন্থের (‘ভৈরব পুরাণ: শেকড়ের সন্ধানে’) কাঁচামাল যোগাতে।
আমরা যেখানে থামলাম জায়গাটার নাম দেওয়ানগঞ্জ বাজার। মাঝারি আকারের বাজারÑকাঁচাবাজার, দোকানপাট-রেস্তরাঁ ও চায়ের দোকান; বাণিজ্যিক ও নানা পণ্যসামগ্রীর ছোটো মার্কেটও বলা যেতে পারে।
এলাকা ও বাজার বিদ্যুৎবাতির আলোয় ঝলমল করছিল। বাজারের ভেতরে ‘ঈশা খাঁ সমাজকল্যাণ সমিতি’র সাইনবোর্ড ও এর ভেতরের চেয়ার-টেবিল পাতা অফিসঘর আমাকে কৌতূহলী করে তুলল।
জঙ্গলবাড়ি দুর্গ কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ঈশা খাঁর স্মৃতিবাহী স্থাপনা। মসনদ-ই-আলা বীর ঈশা খাঁ ছিলেন বাংলার বারো ভূঁইয়াদের প্রধান। ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি প্রকৃতপক্ষে ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানি ছিল। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্তি¡ক স্থাপনা। কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলাধীন কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি গ্রামে নরসুন্দা নদীর তীরে দুর্গটির অবস্থান।
উল্লেখ্য যে, ১৫৯৭ সালে তিনি পাকুন্দিয়ার এগারোসিন্দুরে মুঘল স¤্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিংহকে পরাজিত করেন।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে মুঘল সা¤্রাজ্যবাদ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার্থে ঈশা খাঁর সফল সংগ্রাম তাঁকে বাংলার অবিসংবাদিত পুরোধা ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তিনি তাঁর সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদীর জমিদারীকে সাফল্যের সঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন।
এই রাজ্য বৃহত্তর ঢাকার বেশ কিছু অংশ, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং ত্রিপুরা জেলার এক ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে গঠিত হয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুর এবং কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ি ও এগারোসিন্দুর ছিল তাঁর শক্তিশালী ঘাঁটি।
…বাজার থেকে জঙ্গলবাড়ি যাবার রাস্তাটুকুর করুণ দশা। পায়ে হেঁটে অতিকষ্টে অতিক্রম করতে হয়। সম্প্রতি রাস্তাটায় ইট ফেলা হয়েছে। ‘সম্ভবত রাস্তা পাকা হবে’- স্থানীয়রা জানালেন, গত তিনবছর ধরে রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তর ২০০৯ সাল থেকে ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়িকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করলেও, এর সংরক্ষণের দায়িত্বে¡ থাকলেও এতটা বছর যাবত কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঢাকা এবং কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে ও দেশের অন্যান্য স্থান থেকে প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে প্রতিদিন। অথচ প্রশাসন বা প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তর এলাকার উন্নয়নে, অবকাঠামো নির্মাণে ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নের বিষয়ে বা পুরাকীর্তির যথাযথ সংরক্ষণের তেমন কোনো পদক্ষেপ এখনও নেয়নি (২০১৮-২০১৯)।
গন্তব্যস্থলে যাবার পথে হাতের ডানে একটি ছোটো ডাকঘর দেখতে পেলাম। সম্ভবত প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তরের কাজে ডাকবিভাগ এটা চালু করেছে। জানলাম ডাকঘরটি চালু রয়েছে এবং স্থানীয়রা এর সেবা গ্রহণ করছেন।
২০০৫ সালের ১২ জুন এখানকার দরবারগৃহটি ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্রাকারে। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে.এম. রুহুল আমীন, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কামরুজ্জামান খান, কাদিরজঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবিএম সিরাজুল ইসলাম ও দেওয়ান আমিন দাদ খাঁ এই উদ্যোগ নেন।
…আমি আর রাকিব শীতার্ত রাতের অন্ধকারে ঘুরেফিরে সব দেখলাম। মাঝ আকাশে অর্ধেকটা চাঁদ ছিল; তার আলোয় বিশাল পুকুরটা দেখলাম। অন্ধকারেই আমরা ছবি তুললাম দরবার গৃহের, মূল ভবনের এবং মসজিদের। চারিদিকে গহীন জঙ্গল। রাতচরা পাখির ডাক ভেসে আসছিল। দরবার গৃহে বিচরণের সময় আমার ডান কানে কিছু একটা ঝাপ্টা মেরে গেল। প্রথমে চমকে উঠলাম- ভয় পাওয়ার আগেই বুঝতে পারলাম এটা ‘না-পাখি, না-পশু’ প্রজাতি। উড়ে চলে গেল- একটা বাদুড়। আমাজন জঙ্গল হলে ভেবে নিতে পারতাম, আর শিউরে উঠতাম ভ্যাম্পায়ার-আতঙ্কে।
আমরা মূল ভবন পেরিয়ে একটা বিশাল উঠোনে এলাম- এখানে বাড়িঘর উঠিয়ে লোকজন বাস করছে।
…ঈশা খাঁ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্গে যাতায়াত করতেন। ১৫৯৯ সালে মহেশ্বরী পরগনার অন্তর্গত বক্তারপুর দুর্গে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রায় সত্তর বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর গ্রামে ঈশা খাঁ সমাহিত হন।
ভাটিরাজ্যের অধিপতি মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর দ্বিতীয় সর্বশেষ জঙ্গলবাড়ির এই বাড়িটিতে বসবাস করতেন ঈশা খাঁর ১৪তম বংশধর দেওয়ান ফতেহ আলী দাদ খাঁ। ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বর্তমানে তাঁর ছেলে দেওয়ান মামুন দাদ খাঁ পরিবার-পরিজন নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের রথতলা এলাকায় বসবাস করেন।
…আমরা চায়ের দোকানে বসলাম। সেখানে কয়েকজন স্থানীয় অধিবাসীদের একজন জানালেন সামনের চারটি বাঁধাই করা বিশাল কবর ব্রিটিশ সাহেবদের। আসলে মসজিদের পাশে বাঁধানো কবরগুলো ঈশা খাঁর বংশধরদেরই কবর। ব্রিটিশ সাহেবদের কবর হওয়ার কথা নয়। আমার সঠিক জানা ছিল না এই কবরগুলো কাদের। তাই তর্কে যাইনি।
ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত ‘ঈশা খাঁ সমাজ কল্যাণ সমিতি’র একজনের সাথে কথা বললাম। তিনি জানালেন, তাদের এই সংস্থাটি সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনকৃত ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে প্রতিবছর সামান্য অনুদান তারা পান। এই অনুদান এবং সদস্যদের চাঁদা থেকে তারা দুস্থ ও দরিদ্রদের সাহায্য করেন। অনেক সময় দরিদ্র পরিবারের বিয়ের খরচের দায়িত্ব বহন করেন।
যার সাথে কথা বলেছি তার নাম মো. মনির উদ্দিন শিপন। তিনি রাস্তার দুর্দশার জন্য মূলত ঠিকাদারদের দায়ী করেন। আমাদের সফরের সময়ের আগের তিনবছর বিশেষভাবে রাস্তার এই বেহাল অবস্থায় অনেকেই ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। অনেক পর্যটক এবং দর্শনার্থী অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তর এই পুরাকীর্তির স্থানটিকে তাদের অধীনে নেবার ফলে কোনো ইতিবাচক কিছু দেখা গেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এ যাবত তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।
তিনি আরও জানান যে, দুর্গের চারপাশের যে পরিখা ছিল কালের গর্ভে সেসব পরিখা ভরাট হয়ে গেলেও এখনও টিকে আছে একমাত্র পুকুরটি।
তিনি বলেন, জঙ্গলবাড়ি দুর্গের কিছু স্মারক কিশোরগঞ্জের পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব নয় বলেই আমার মনে হয়েছিল, যেহেতু এটি প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের অধীনে চলে গেছে এখানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা অবশ্য করণীয় একটি বিষয় প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের।
স্থানীয় অধিবাসীগণ এবং বিজ্ঞজনেরা আশাবাদী যে, এই ঐতিহাসিক স্থান অচিরেই একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। আশা পোষণ করি, এই ঐতিহাসিক স্থানটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন ও পুরাকীর্তি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। প্রশাসন, প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তর এবং সর্বোপরি সরকারের উঁচুমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থানটিকে প্রত্নপল্লী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আগমনে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করবে এই প্রত্নপল্লী। আশা করতে দোষ কী যে, কোনো একসময় হয়তো এটি ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্তি লাভ করবে।
যাইহোক, আমাদের যতটুকু জানার তা জানা হয়ে গেল। এর বেশি জানতে চাওয়াটা গবেষণার বিষয় হয়ে যেত। আমরা গবেষণা করার জন্য যাইনি। গিয়েছি বীর ঈশা খাঁর স্মৃতি সম্পর্কে আমার গ্রন্থের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে। সে উদ্দেশ্য পূরণ হলো অনেকটা অ্যাডভেঞ্চার স্টাইলে- রাতের অন্ধকারে এবং ভৌতিক পরিবেশে।