হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

”অষষ ঃযধঃ ংঢ়রৎরঃং ফবংরৎব, ংঢ়রৎরঃং ধঃঃধরহ.” কাহলিল জিবরানের ‘দি প্রফেট’-এর এই ছোট্ট বাণীটুকু আমার ভালো লাগে।
কিন্তু জানি না, কবে আমার আত্মার পরিতৃপ্তি হবে। হয়তো বিশাল অতৃপ্তি নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। আমার যাবতীয় অতৃপ্তি আমার লেখালেখিকে ঘিরে। একটা সময় ছিল, যখন নিজকে মেলে ধরতে চাইতাম কিন্তু পারিনি, আমার একটা অন্যরকম আমিত্বের জন্য। কারুর ওপর দোষ চাপিয়ে ধোয়া তুলসিপাতা হতে চাই না। কেননা, সব ব্যর্থতা আমারই।
আর এখন সেসব ভুল-ব্যর্থতার মাশুল গুনছি। অনেকটা দূরে সরে গেছি সংবেদনশীল একটা মন নিয়ে।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও মন চাঙা রাখার চেষ্টা করছি। বয়স তো কম হলো না। বুড়িয়ে যাচ্ছি। জীবনটাকে টেনে চলছি তো চলছিই; এর যেন শেষ নেই। মহাশূন্যের মতো অসীম।

এই অসীমতাকে ভেদ করে আর সসীম হতে চাই না। আমি জানি, আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অতিমানবীয় ইচ্ছেগুলোর বাস্তবায়ন ইহজীবনে সম্ভব নয়। জীবনানন্দের মতো ‘আবার আসিব ফিরে’ যদি কোনো দৈববলে সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো বা তা সম্ভব। অনেক অতৃপ্তি নিয়েই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। তবে আক্ষেপ, ফেলে আসা সময়টাকে কাজে লাগাইনি। এই ব্যর্থতার দায় শতভাগ আমার। তাই সময়ের কাছে করজোরে ক্ষমা চাইছি। সুন্দর সময়, কুৎসিত সময়, অলস সময় বা ব্যস্ত সময়-সবরকমের সময়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমি।
মূলত আশির দশকের শেষভাগে আমি প্রবেশ করি সিরিয়াস সাহিত্যজগতে। আমার কাছে এই সময়টা ছিল অনেকটা নির্মলতা ও হাস্যরসে পূর্ণ। স্বাধীনতারও সময় বটে; স্বাধীনভাবে ঘুরতাম। আড্ডা বা সাহিত্য আড্ডাও দিতাম। আমার চাকরিজীবনে কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন ছেড়ে পরবর্তী সময়ে পত্রিকায় যোগ দিই।

এইসময় আড্ডা ও সাহিত্য আন্দোলনে রীতিমতো গেঁথে গেলাম। আমরা কতিপয় গল্পকার ও কবি বন্ধু জাদুবাস্তবতা নিয়ে কাজ শুরু করি। কিছুটা সফলতাও আসে। এখন বুঝতে পারি যে, কেন সে সময়টা আমার ও আমার সমসাময়িক লেখক-কবিদের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। আমি নিজে কিছুদিন একটা পত্রিকা চালাতাম। তাছাড়া, প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক বা পাক্ষিকে লিখতে তেমন কোনো বাধা ছিল না। কথাটা এভাবে বলতে চাই–লেখা মানসম্মত হলে পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। কোনো তদ্বিরের প্রয়োজন হতো না।
একবার কোনো এক রোজার ঈদের আগে দৈনিক বাংলায় গেছি গল্প নিয়ে। ঢুকলাম সাহিত্য সম্পাদকের কক্ষে। সাল মনে নেই। তখন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী। তখন গল্প লিখতাম এ-ফোর সাইজের পেপারে। রেজোয়ান ভাই গল্পটা হাতে নিয়ে প্রথম, মাঝখানের ও শেষের কয়েক লাইন পড়লেন। তারপর তাতে ঈদসংখ্যা গল্প লিখে প্রেস সেকশনে পাঠিয়ে দিলেন।

দৈনিক বাংলার ঈদসংখ্যায় নিজের গল্পটা দেখে ভারী আহ্লাদিত হয়েছিলাম। এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, তখন ইত্তেফাকের মোড়ে জমজমাট নিউজপেপার স্টল ছিল। নব্বই ও শূন্য দশকজুড়ে মোহাম্মদপুর টাউন হল ও আসাদগেইটে পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের রমরমা ব্যবসা ছিল।
২০২৩ সালে আমাদের সময় পত্রিকায় ঈদসংখ্যায় গল্প প্রকাশিত হলো আমার। সুদৃশ্য একটা বিশাল ম্যাগাজিনের মতো। কিন্তু এটা পাই কোথায়? পূরবীতে সেই পত্রিকার স্টল নেই। অনেক স্থান ঘুরাঘুরি করে শেষে মিরপুর ১০ শাহ আলী মার্কেটের কাছে ব্রিজের গোড়ায় এক বৃদ্ধ লোককে পত্রিকা ও ম্যাগাজিন সাজিয়ে বসে থাকতে দেখলাম। তার কাছে ঈদসংখ্যা আমাদের সময় নেই। আমি বললাম, এনে দিতে। তাকে ম্যাগাজিনের দাম চারশ’ টাকা ও বাড়তি কিছু টাকা দিলাম যেন তিনি এটা অবশ্যই এনে রাখেন।
দুদিন পর গিয়ে সংখ্যাটা পেলাম। এবছর ২০২৪ সালেও ঈদসংখ্যায় আমার গল্প প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সুদৃশ্য বইটি আজও পাইনি। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অবস্থিত পত্রিকা অফিসে গিয়ে সেটা জোগাড় করতে হবে। জ্যাম ও দূরত্বের কথা ভেবে আজও যাওয়া হয়নি। সত্যিই কঠিন সময় পার করছি আমরা।

আগের সেইসব মানুষগুলো নেই, নেই সেইরকম পরিবেশ ও প্রাণখোলা হাসির শব্দ। নেই ধূমায়িত চা ও ধু¤্রভরা সিগারেটের গন্ধের আড্ডা ও কলরব।
সত্যিই বদলে গেছি আমরা।