অনলাইন ডেস্ক : রাজধানী ঢাকা বছরের পর বছর সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তবুও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না। এবার জলাবদ্ধতায় আরও বেশি দুর্ভোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত দু’দিনও রাজধানীতে একই দৃশ্য। গত সোমবার ৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই তলিয়ে গেছে অনেক এলাকা। গতকাল মঙ্গলবারও সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। রাজপথ ডুবেছে। প্রধান সড়কগুলোয় পানির ঢেউ খেলে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছেন নাগরিকরা। নগরজীবনে নেমে এসেছে তীব্র ভোগান্তি। শুধু এই বর্ষা মৌসুম নয়, সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা মহানগরে জলজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সবাইকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রথমত, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব একটি স্বতন্ত্র সংস্থাকে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। যার আলোকে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্ত করা যাবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে খালগুলো পুনরুদ্ধার করে খনন করে প্রতিটি খালের পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
আরও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা : গত সোমবার তিন ঘণ্টায় মাত্র ৬৩ মিলিমিটার ও গতকাল মঙ্গলবার থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিপাতেই রাজপথ তলিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো কেন- সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, এবার জলাবদ্ধতার মাত্রা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ মেট্রোরেলসহ একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বিভিন্ন এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা এখন বেহাল। অন্যদিকে পানি নিস্কাশনের প্রধান মাধ্যম ড্রেনের দায়দায়িত্ব নিয়ে রশি টানাটানি চলছে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে। ওয়াসা অনেক আগে থেকেই বলছে, ড্রেন দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। ফলে তারা ড্রেন ও বক্স-কালভার্ট পরিস্কার করার উদ্যোগই নেয়নি। খালের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই কাহিনি। কিন্তু সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াসার ম্যান্ডেটের মধ্যেই ড্রেনের মালিকানা দেওয়া আছে। ওয়াসা বার বার অনুরোধ করছে ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দিতে। কিন্তু এর দায়িত্ব নিতে অনীহা জানিয়েছে সিটি করপোরেশন। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনের ক্ষেত্রে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে।
রাজধানীর জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ‘সিপ’-এর দুর্যোগ সহনশীল ঢাকা কর্মসূচি প্রকল্পের সমন্বয়ক সাইফুন নাহার সমকালকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতার মতো বড় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসার যেভাবে যৌথ প্রকল্প নেওয়া দরকার, তেমনটি এখনও হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী।
নেপথ্য কারণ : ওয়াসার অভিযোগ, সিটি করপোরেশন উন্মুক্ত ড্রেনগুলো পরিস্কার রাখে না। আবার সিটি করপোরেশন জানাচ্ছে, ওয়াসা বক্স-কালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ পরিস্কার করে না। পরিস্কারের নামে প্রকৌশলী ও ঠিকাদার টাকা-পয়সা লুটেপুটে খান। পাল্টাপাল্টি এই অভিযোগ নিয়ে কয়েক বছর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপেরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ও ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের মধ্যে অনেক বাগ্বিতণ্ডাও হয়েছিল। এ ঘটনায় তৎকালীন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসরিন আক্তারকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার আইন পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়ন করা। সেই কমিটি দীর্ঘদিনেও কোনো সুপারিশ জমা দিতে পারেনি। এদিকে ওয়াসা স্টর্ম স্যুয়ারেজ ও বক্স-কালভার্ট পরিস্কার থেকে বিরত রয়েছে। ডিএনসিসির বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম এ অবস্থা দেখে কয়েকটি খাল নিজস্ব অর্থায়নে খনন করে কয়েকটি এলাকার জলাবদ্ধতা নিস্কাশনের চেষ্টা করেছেন।
আইনেও জটিলতা : ১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসা পানি নিস্কাশনের জন্য বড় ড্রেন নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও খাল দেখভাল করবে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর তৃতীয় তফসিলে বলা হয়েছে, ছোটখাটো নালা, ড্রেন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে সিটি করপোরেশন। এই আইনের সূত্র ধরে বর্তমানে সংস্থা দুটি পরস্পরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।
রাজধানীতে প্রায় ১০ কিলোমিটার বক্স-কালভার্ট রয়েছে। এই বক্স-কালভার্ট বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের অন্যতম মাধ্যম। এ ছাড়া রয়েছে ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন। এ দুটি মাধ্যমেই বৃষ্টির পানি বিভিন্ন জলাশয়, খাল বা নদীতে পড়ে। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের রয়েছে দুই হাজার ৫১ কিলোমিটার সারফেস ড্রেন। মূলত বৃষ্টির পানি সারফেস ড্রেন দিয়ে বক্স-কালভার্ট বা স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইনে প্রবেশ করে। এই পানি নিচু জলাশয়ে গিয়ে জমা হয়। ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শেষে বক্স-কালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজের অন্তত ৮০ শতাংশই ভরাট হয়ে যায়। সেগুলো পরিস্কার না করলে তো জলাবদ্ধতা হবেই।
ভোগান্তির শেষ নেই : জলাবদ্ধতা আর বৃষ্টির ভোগান্তি থেকে গতকালও মুক্তি পাননি নগরবাসী। আগের দিনের জলাবদ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল রাজধানীতে আবারও ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হওয়া এই বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় রাজপথ। নিউমার্কেট এলাকায় দেখা যায়, পুরো রাস্তা তলিয়ে পানির ওপর দিয়ে ময়লা-আবর্জনা ভেসে বেড়াচ্ছে। কারওয়ান বাজার এলাকায় দেখা যায়, পানির ওপর বিভিন্ন ধরনের তরিতরকারি ভেসে বেড়াচ্ছে। এভাবে অনেক প্রধান সড়ক পানির নিচে চলে যায়। সকালে দুর্ভোগে পড়েন অফিসমুখী নগরবাসী। অনেক স্থানে রাস্তা ও ফুটপাত তলিয়ে যাওয়ায় যানজট প্রকট আকার ধারণ করে। রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মালিবাগ, রামপুরা, পুরান ঢাকা, আরামবাগ, বনানী, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে করে নগরজীবনে ঘটে ছন্দপতন।