অনলাইন ডেস্ক : বিদেশগামীদের করোনা সনদ সংগ্রহে সরকারি সিদ্ধান্তে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে তোলপাড় চলছে। যাত্রীরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন তাদের ভোগান্তি বাড়বে। একই সঙ্গে তারা পড়বেন করোনাঝুঁকিতে। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলেছে, সরকারের এই সিদ্ধান্তে অনেক যাত্রী টিকিট বাতিলের কথা ভাবছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোও।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তে জেলার সিভিল সার্জন অফিসগুলোতে দুর্নীতির আরেকটি খাত তৈরি হবে। উল্লেখ্য, আগামী ২৩ জুলাই থেকে বিদেশগমীদের জন্য করোনা সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এই সনদ নিতে হবে ১৬টি হাসপাতাল থেকে। কিন্তু বিদেশগামীদের হাসপাতালের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে নমুনা দিতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যে ব্যবস্থায় সনদ নেয়ার জন্য নমুনা দিতে হবে তাতে বিদেশগামীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এতে নেগেটিভ সনদ নিয়ে বিদেশ গেলেও যাত্রীদের অনেকেই পরে সেখানকার পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এভিয়েশন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনিতে সেক্টরটি চরম বিপর্যয়ের মুখে আছে, তার ওপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি বড় ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

জানা গেছে, এতদিন দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর দেয়া তালিকাভুক্ত হাসপাতাল থেকে করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাত্রীরা বিদেশ গেছেন। এই তালিকার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল দেশের নামিদামি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের নাম। এমিরেটস এয়ারলাইন্স তাদের যাত্রীদের জন্য ২৯টি হাসপাতালের তালিকা দিয়েছিল।

এর মধ্যে অন্যতম ছিল এভারকেয়ার, স্কয়ার, ইউনাইটেড, ইবনে সিনা, আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, কুর্মিটোলা জেনারেল, আইপিএইচ, চট্টগ্রাম মেডিকেল, ফরিদপুর মেডিকেল, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ বেড, চট্টগ্রাম ইউনিভাসিটি, সৈয়দ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল, ইমপিরিয়ার হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল, কুমিল্লা মেডিকেল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেল, খুলনা মেডিকেল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল, সিলেট ওসমানী মেডিকেল, রংপুর মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল, জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেলসহ ২৯টি নামিদামি হাসপাতাল অন্যতম।

এতদিন যাত্রীরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে এসব হাসপাতাল থেকে করোনা নেগেটিভ সনদ সংগ্রহ করতে পেরেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শনিবার ১৬ হাসপাতালের যে তালিকা দেয়া হয়েছে তাতে বিদেশগামীরা নমুনা প্রদানে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

সরকারের নতুন তালিকায় আগের অধিকাংশ নামিদামি ও ঝুঁকিমুক্ত হাসপাতালের নাম নেই। ১৬টি হাসপাতালের অধিকাংশই প্রবাসীরা চিনেন না। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের নির্ধারিত বুথে গিয়ে নমুনা দেয়ার সিদ্ধান্তে প্রবাসী ও বিদেশগামীদের সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করেছে।

তারা বলেছেন, জেলা সিভিল সার্জন অফিসগুলো এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের অভয়ারণ্য। তাছাড়া সারা দেশের প্রবাসী যাত্রী, ভ্রমণকারী ও অফিসের কাজে বিদেশগামীরা যদি একসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জন অফিসে নমুনা দিতে যান তাহলে ওই অফিসে বড় ধরনের ভিড় তৈরি হবে। বিশাল লাইন পড়ে যাবে। এতে বিদেশগামীদের মধ্যে করোনাঝুঁকি বাড়বে।

খোদ ঢাকা সিভিল সার্জন অফিসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, আজ থেকে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার বিদেশগামীরা নমুনা দিতে আসার কথা রয়েছে তাদের অফিসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ নিয়ে তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই।

কোথায় নমুনা সংগ্রহ করা হবে সে রকম কোনো বুথও তৈরি হয়নি। বিদেশগামীদের ভিড় বেড়ে গেলে সেটা সামাল দেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি।

নমুনা নেয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবলও তাদের নেই। পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট ও নিরাপত্তা সামগ্রীও নেই তাদের। তালিকার ১৬ হাসপাতালের মধ্যে ঢাকায় আছে ৩টি। এগুলো হল ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেডিসিন অ্যান্ড রেফারাল সেন্টার (এনআইএলএমআরসি), ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথ (এনপিএমএল-আইপিএইচ) ও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (এনআইপিএসওএম)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমনিতে নিয়মিত রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করাতে এসব হাসপাতাল হিমশিম খাচ্ছে সে ক্ষেত্রে এত বিশালসংখ্যক বিদেশগামীদের নমুনা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত করার মতো তাদের পর্যাপ্ত জনবল ও ইকুইপমেন্ট নেই।

ঢাকা সিভিল সার্জন অফিসের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এসব নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ৭২ ঘণ্টার আগে তাদের ওয়েসসাইটে ডাউনলোড করা, নমুনা প্রদানকারী ও সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলোকে জানিয়ে দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

তাছাড়া ঢাকা সিভিল সার্জন অফিসে এ রকম আইটি বিশেষজ্ঞ ও আইটি ইকুইপমেন্ট নেই। কাজেই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিদেশগামীদের নমুনা ফলাফল বিমানবন্দরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুবই কম।

এতে অসংখ্য যাত্রী বিমানবন্দরে গিয়ে সনদ পাবেন না। এ নিয়ে তারা চরম ভোগান্তিতে পড়বেন। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মফস্বলের সিভিল সার্জন অফিসগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।

তাদের পক্ষেও বিদেশগামীদের কাছ থেকে নমুনা নিয়ে সেগুলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তালিকাভুক্ত ১৬ হাসপাতাল থেকে টেস্ট করিয়ে ওয়েসবাইটে আপলোড করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

এদিকে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ভোগান্তির ভয়ে এয়ারলাইন্সগুলোতে টিকিট বাতিল হচ্ছে। অধিকাংশ ভ্রমণপিপাসু এবং অফিসের কাজে যারা বিদেশ যাবেন তারা ভ্রমণ স্থগিতের কথা জানাচ্ছেন ট্রাভেল এজেন্টগুলোকে।

ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলেছে, সরকার যে পদ্ধতিতে সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে নমুনা দেয়ার কথা বলেছেন, তাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে।

একজন ট্রাভেল এজেন্সি মালিক জানান, যারা বিজনেস ক্লাসের যাত্রী ও পরিবার-পরিজন নিয়ে নমুনা দিতে যাবেন তাদের পক্ষে এভাবে লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। এতে করোনা আরও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাছাড়া প্রবাসীরা এ দেশের রেমিটেন্স যোদ্ধা।

তাদের হয়রানির বিষয়টি সরকারকে আন্তরিকভাবে দেখতে হবে। নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালের টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই কোনো দেশের। যেখানে প্রবাসীরা নিরাপদবোধ করবেন এ রকম হাসপাতালের নাম দেয়া উচিত। সাড়ে ৩ হাজার টাকায় এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা দিতেও তারা অনীহা জানিয়েছেন।

এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের এই লিস্ট মানতে গেলে তাদের যাত্রী সংখ্যা অনেক কমে যাবে। বিশেষ করে বিজনেস ক্লাসের যাত্রীরা এখন ভ্রমণ করতে আগ্রহ দেখাবেন না। অনেকে এই ঘোষণায় তাদের ভ্রমণ বাতিল করার জন্য বলেছেন। এমিরেটস অফিস থেকে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টের কাছে ২৯টি হাসপাতালের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে।

ট্রাভেল এজেন্টগুলোকে এই তালিকা ফলো করতে বলা হয়েছে। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন ট্রাভেল এজেন্সিগুলোও। তাদের বক্তব্য যদি সরকার এই তালিকা না মানেন তাহলে তো বিমানবন্দরে গিয়ে যাত্রীদের বিদেশ গমন অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

তাতে তারা লোকসানে পড়বেন। কাতার এয়ার ওয়েজের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের দেয়া ১৬ হাসপাতালের এই তালিকা এবং জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে নমুনা দেয়ার সিস্টেম ফলো করলে এখানে দুর্নীতি ঢুকে যাবে।

এটা হবে আত্মঘাতী। কোনো বিদেশগামী মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে এ অবস্থায় জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে করোনার ঝুঁকিতে পড়তে চাইবেন না। একই কথা বলেছেন, টার্কিশ এয়ারলাইন্স, এয়ার অ্যারাবিয়া, শ্রীলংকান এয়ারলাইন্স, মালিন্দো এয়ারসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্স।

খোদ বাংলাদেশ বিমানের এক কর্মকর্তা সরকারের এই তালিকা দেখে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত করোনাঝুঁকি আরও ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাবে। দুর্নীতি আরও চরম আকার ধারণ করবে। এ নিয়ে পরিবেশ নষ্ট হবে।

এটা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। লাইন ধরা নিয়ে মারামারি শুরু হবে। ফ্লাইটের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে।