অনলাইন ডেস্ক : স্বপ্নের দেশে পা রাখতেই সবকিছু অচেনা মনে হয় রুবিনার। বর্ণিল আলোর ঝলকানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। রুবিনাকে রিসিভ করতে এসেছে। যুবকের দৃষ্টি ওই তরুণীর শরীরজুড়ে। যুবকের নাম এরশাদ। রহস্যময় হাসি মুখ এরশাদের। গাড়িতে করে রুবিনাকে নিয়ে যায় দুবাইয়ের ফজিলার সিটি টাওয়ার নামক হোটেলে। তারপর দিনই ড্যান্সবারে ডাক পড়ে রুবিনার।
তাকে বলা হয় বারে অন্যান্য তরুণীদের মতো পুরুষদের সঙ্গে মিশতে হবে। সেভাবেই ওয়েস্টার্ন পোশাক পরানো হয় তাকে। নিজস্ব বিউটিশিয়ান দিয়ে সাজানো হয়। বারের সঙ্গেই ড্যান্সফ্লোর। বিটের তালে তালে নাচছে ভিনদেশি মানুষ। সঙ্গে সুশ্রী, স্বল্পবসনা তরুণীরা। রুবিনা হতভম্ব। এমন দৃশ্য কখনো দেখেননি। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে টেনে নিয়ে যায় মাদকে বুঁদ হয়ে থাকা এক বয়স্ক ব্যক্তি। নাচতে না জানলেও বারবার তাকে টেনে নেয় একজন থেকে আরেকজন। যেন এক অন্যরকম খেলা। পার্টি শেষে তার রুমে পাঠানো হয় এক আরবিয়ানকে। রুবিনা কান্না করেন। চিৎকার করেন। ভোগে বাধা দেয়ায় আরবিয়ান যুবক অভিযোগ করে রুবিনার বিরুদ্ধে। লাঠি হাতে রুমে ঢুকে আলমগীর। হোটেলের সুপারভাইজার। অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে মারধর করে রুবিনাকে। আলমগীর জানায়, টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে তাকে। এখানে এসবই করতে হবে। নইলে মেরে টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে।
এভাবেই রুবিনাসহ অসংখ্য বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতন করা হচ্ছে আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। উন্নত জীবন, ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে হোটেলে বন্দি রেখে মাসের পর মাস নির্যাতন করা হয় তাদের। এমনকি ঢাকায় রয়েছে এই চক্রের ড্যান্স শেখানো প্রতিষ্ঠান। ড্যান্স শেখানোর নামে মেয়েদের সংগ্রহ করে পাচার করা হয় দুবাইয়ে। পতিতাবৃত্তির বিনিময়ে বিপুল টাকা অর্জিত হলেও নির্যাতিতাদের অনেকের ভাগে তা জুটে না। কেউ কেউ মাস শেষে অল্প টাকা পান। এরকম সহস্রাধিক তরুণীকে পাচার করেছে আজম খান চক্র। এই চক্রে দেশে বিদেশে অর্ধশত ব্যক্তি জড়িত। দালালদের মাধ্যমে তরুণীদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যায়। তারপরই তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এ বিষয়ে লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে দুবাইয়ের বিভিন্ন হোটেল থেকে উদ্ধার হওয়া তরুণীরা। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর আজম খান ও তার সহযোগী আল আমিন হোসেন ডায়মন্ড গত সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে অপরাধ স্বীকার করেছে।
নির্যাতিতা তরুণী আফসানা পারভিন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। প্রতিবেশী এক নারীর মাধ্যমে টিএসসিতে পরিচয় হয় নির্মল দাস নামে এক যুবকের সঙ্গে। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকার নির্মল দাসের কাছে নিজের জন্য একটি চাকরি খুঁজছিলেন তিনি। নির্মল তাকে জানান, দুবাইয়ে ভালো চাকরি আছে। বেতন হবে প্রায় অর্ধলাখ টাকা। ভালো কাজ। রাজি হন আফসানা। তারপর দিনই নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি পাসপোর্ট অফিসে নিয়ে যায় নির্মল। সেখানে পাসপোর্ট করার জন্য আবেদন করা হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ পর চাকরির আলোচনার কথা বলে নির্মল ফোনে ডেকে নিয়ে যায় শান্তিনগরে। সেখানে পরিচয় হয় নাজিম খানের সঙ্গে। আজম খানের ছোট ভাই নাজিম। গাড়িতে বসেই আফসানার সঙ্গে কথা বলে সেদিন। আফসানাকে জানায়, দুবাইয়ে তাদের কয়েকটি হোটেল আছে। সেখানে কাজ করতে হবে। কাজ হচ্ছে গেস্টদের খাবার পরিবেশন করা। হোটেল ব্যবসা যাই হোক মাস শেষে নিয়মিত ৫০ হাজার টাকা পাবে আফসানা।
ঘটনাটি গত বছরের শেষের দিকে। কিছুদিন পরে ফোনে নাজিম জানায়, ২৩শে ডিসেম্বর তার ফ্লাইট। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে গাড়িতে পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানের টিকিট দেয় নাজিম। ওই সময়ে আফসানার মায়ের বিকাশ নম্বরে দুই দফায় ৪০ হাজার টাকা পাঠায় নাজিম। দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আফসানার কপালে জুটে বন্দি জীবন। রুমের বাইরে তালা। প্রয়োজন হলেই রুম খুলে ড্যান্সবারে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে মদে বুঁদ হয়ে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে নাচতে হতো। তারপর যখন তখন রুমে পাঠানো হতো গেস্ট। কখনো কখনো এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে নিয়ে যাওয়া হতো। প্রতিটি হোটেল অন্তত ২০ জন করে তরুণী রয়েছে এই চক্রের। তাদের প্রত্যেককে দিয়েই এ কাজ করানো হয়। যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে নাচ করে তাদের ভাগ্যে অল্প-স্বল্প টাকা জুটলেও বেশিরভাগ তরুণীকেই কোনো টাকা দেয়া হয় না। হোটেলগুলো পরিচালনা করতো আজম খান। বারে, লবিতে তার দেখা মিলতো।
এই চক্রের সদস্য আল আমিন ডায়মন্ড একজন ড্যান্স প্রশিক্ষক। ড্যান্স শিখিয়ে বিদেশে চাকরি দেয়ার নামে ২০১৯ সালের ২রা মে মিরপুরের শিল্পীকে লালবাগের ৪৩/৩ শহীদ নগরের স্বপন হোসেনের কাছে নিয়ে যায় ডায়মন্ড। পরবর্তীতে স্বপ্নন নিয়ে যায় মূল হোতা আজম খানের কাছে। তারপর শিল্পীকে দুবাইয়ের সারজায় নিয়ে যায়। সারজায় হোটেলে নিয়ে আজম খান নিজে ও তার ঘনিষ্ঠরা শিল্পীকে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে জোর করে ড্যান্সবারে ড্যান্স করানো থেকে শুরু করে গেস্টদের রাতের সঙ্গী হতে বাধ্য করা হতো তাকে।
আফসানা, রুবিনা, শিল্পীসহ নির্যাতিতা তরুণীরা জানান, করোনার কারণে গত এপ্রিল মাস থেকে হোটেল, বার বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই খাবারের কষ্ট হচ্ছিল। নিয়মিত খাবার দেয়া হতো না তরুণীদের। এই অবস্থায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে কল দিয়ে অভিযোগ করেন আফসানা। পরে হোটেল থেকে আফসানা, রুবিনাসহ কয়েক তরুণীকে উদ্ধার করা হয়। ১৬ই জুন দেশে ফিরেন আফসানা। এসব তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নানুপুরের আজম খানসহ এই চক্রের আল আমিন হোসেন ডায়মন্ড, স্বপন হোসেন, নাজিম, এরশাদ, নির্মল দাশ, আলমগীর, আমান, শুভসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করেছে সিআইডি।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দুবাইয়ে মেট্টো নাইট ক্লাব, ঢলিউড লাইভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট রেস্টুরেন্ট, (হোটেল সিটি টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায়), গুলশান লাইভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট রেস্টুরেন্ট ও রয়েল ফরচুন নামে চারটি হোটেল রয়েছে আজম খানের। এই চক্রে দেশি ছাড়া পাকিস্তানিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা রয়েছে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজীব ফারহান জানান, এই চক্রের টার্গেট থাকতো কম বয়সী সুন্দরী নারী। তাদের মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যেত। সেখানে যৌন নির্যাতন করা হতো। এক ধরনের দাসত্বের জীবন যাপন করতে হতো পাচার হওয়া নারীদের। টাকাও দেয়া হতো না। উল্টো মারধর করা হতো। প্রায় এক দশক ধরে অপকর্ম করে আসছে এই চক্র। এই চক্রের গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের মধ্যে আজম খান ও আল আমিন হোসেন ডায়মন্ড অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।