বিদ্যুৎ সরকার : জন, পুরো নাম জন মার্টিন খ্রিস্টান স¤প্রদায়ভুক্ত সুদর্শন একরোখা স্মার্ট ছেলে। বাবার পথ ধরে সেও ব্যবসায় মননিবেশ করেছে যখন সে সদ্য যুবকে রূপান্তরিত। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে পড়তে সেই উচ্চ মাধ্যমিক অব্দি পড়ে তারপর থমকে যায়। ব্যবসাটা তাদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে সেই আদি থেকে আজ অব্দি। সুতরাং পড়াশোনাটা এখানে গৌণ এবং ‘ওয়েস্টেজ অব মানি এন্ড টাইম’। স্বল্প বিদ্যা জানাটা মোটেও ভয়ংকরী নয় মোটেও। জনের আছে ডাউন টাউনের জনবহুল এলাকার একটি সুপরিচিত গ্রোসারি শপ। সপ্তাহের সাতদিনই খোলা থাকে তার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি। বেশিরভাগ সময়ই জন উপস্থিত থেকে শপ পরিচালনা করে। সে ছাড়া আরো তিনজন কর্মচারী এখানে কাজ করে আওয়ার বেসিস। কাস্টমারদের ফ্লোয়ের উপর নির্ভর করে ওদের আওয়ার দেয়া হয়। জন শুধু একদিন পুরো বেলা ছুটিতে থাকে। সে দিনটি সে বেশ রিলাক্স মুডে থাকে এবং হোই হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে কাটাতে পছন্দ করে। অবশ্য আগের দিন ফার্স্ট হাফ পর্যন্ত কাজ করে মুভি, বার কিংবা নাইট ক্লাব বা মিউজিক্যাল শো’তে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে মধ্য রাতের লাস্ট ট্রেন ধরে বাসায় ফিরে আসে। এমনিতে জন প্রতিদিনই শপের সমস্ত কাজ গুছিয়ে, বন্ধ করে আসতে আসতে সেই লাস্ট ট্রেনই এভেইল করতে হয় তাকে। পরদিন সকালের জন্য কোন কাজ বাকি রাখতে চায় না সে।
জনের দেশ বাংলাদেশ। বাবা পিটার গোমস এসেছিল সুদূর মেক্সিকো থেকে। মা বাংলাদেশরই। পিটার ব্যবসায়ী জাহাজে করে চিটাগাং এসে থেকে যায়। এক রবিবারে চার্চে প্রার্থনা করতে গিয়ে রুমা গোমেজ নামে এক মহিলার সাথে পরিচয় ঘটে। যা পরবর্তীতে প্রেমে রূপান্তরিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাকে থেকে যেতে হয় চিটাগাংগের পাথরঘাটার খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায়। দুই রুমের একটি পাকা বাড়িতে ওরা দু’জনই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। তাদের প্রথম এবং একমাত্র সন্তানের জন্মের পর পিটার ব্যবসায় মনযোগী হয় এবং ক্রমান্বয়ে সে উন্নতির পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। পিটার ও রুমার ইচ্ছে তাদের সন্তান কোন একদিন বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে সুনাম অর্জনে সার্থক হবে। তারই শুভ মহরতের ছোঁয়া বুঝি এখনই দৃশ্যমান।
বিগত পাঁচ বছর ধরে অনেক পরিশ্রম করে তবেই আজ এ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে একটি সুখকর পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছে জন। সে স্বপ্ন দেখে একদিন একটি সুপার স্টোর গড়ে তোলার।
ইয়ং সাব ওয়েতেই তাদের প্রথম দেখা। এখন প্রতি রাতেই দেখা হয় কথা হয় এবং এক সময় পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে যায় পরবর্তী গভীর রাত অব্দি। মিশেলের সাথে জনের কেমন করে প্রথম দেখা হলো এবং পরিচয় হলো? জনকে শপের সব কাজ শেষ করে প্রতি রাতেই বাসায় ফেরার জন্য ইয়ং সাবওয়েতে আসতে হয়। কিন্তু কখনো ওখানটায় মিশেলকে এর আগে দেখেনি। সেদিনই প্রথম ওকে আবিষ্কার করলো নির্দিষ্ট একটি বেঞ্চে বসে থাকতে। সাধারণত ঐ বেঞ্চটাতে রমণীকুলরাই বসে নিজকে সেফ রাখার জন্য। পড়নে ছিল কালো রঙের স্কিন টাইট প্যান্ট, হাই নেক পুলওভার আর চামড়ার কালো জ্যাকেট গায়ে, কালো বুটস পায়ে। কালো কার্ল্ড হেয়ারে, যে কোন মানুষের চোখে পড়ার জন্য যথেষ্ট এ মেয়েটি। ওখানে বসে লাস্ট ট্রেন না আসা পর্যন্ত এক মনে বই পড়ে যাচ্ছে। ট্রেন আসতেই জন উঠে পড়ে একটি কামরায়। সেই মেয়েটিও ঐ একই কামরায় উঠে ঠিক তার উল্টো দিকের একটি সিটে গিয়ে বসে এবং আগের মতোই বই পড়ায় মনযোগ দেয়। ওরা দু’জনে একই স্পট থেকে একই কামরায় প্রতিদিন ট্রেনে উঠাটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আসলে এ স্থান থেকে ট্রেনে উঠলে নামার সময় সরাসরি সিঁড়ির কাছটায় নামা সম্ভব হয়। একদিনের ঘটনা পরস্পরের কাছে আসার, পরিচিত হবার বিষয়কে ত্বরান্নিত করে। মিশেল সেদিন হয়তো কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল তাই ট্রেন আসার সাথে সাথে হুড়মুড় করে উঠতে গিয়ে ভুল করে তার সাইড ব্যাগ বেঞ্চের উপর ফেলে গিয়েছিল। জন তার পিছনেই ছিল, সে চট করে তার ব্যাগটা নিয়ে ফিরিয়ে দেয়। মিশেল তা হাতে নিয়ে তো অবাক এবং কিছুটা লজ্জিতও। অবশ্য জনকে ধন্যবাদটা দিতে কিন্তু ভুল করেনি মোটেও। এর পর থেকে পরস্পরের সাথে দেখা হলেই প্রথমে মৃদু হাসি বিনিময়, কুশলাদি বিনিময় হতে থাকে।
– আপনার নামটা কিন্তু এখনো জানা হয়নি আমার।
– মিশেল, মিশেল মিত্র ফ্রম ক্যালকাটা, য়্যু?
– জন মার্টিন ফ্রম বাংলাদেশ, নাইস টু মিট য়্যু।
– (হাত বাড়িয়ে দিয়ে) মি টু।
– আপনার নামটা কিন্তু ভারি মিষ্টি, কিছুটা পশ্চিমের ফ্লেভার পাওয়া যায়।
– থ্যাংক য়্যু, ঠিকই ধরেছেন। আসলে আমার মা ক্রিশ্চিয়ান স¤প্রদায় আর বাবা হিন্দুধর্মের তাই দু’জনের মিশ্রিত আমেজটা রাখার জন্য নাম রাখা হয়েছে মিশেল।
এমনিতে মিশেলের ইংরেজি অর্থও কিন্তু ‘মিক্সড’। ভালো হলো ব্যাপারটা তাই না?
– এক্কেবারে দশে দশ। দুই স¤প্রদায়ের ক্যামিস্ট্রি দারুণ। দুই স¤প্রদায় দুই কালচার মিলে মিশে নতুন একটি মিশ্র ধারার আবির্ভাব ঘটে। আপনার গন্তব্য কদ্দূর?
– আপনার তো ভিক্টোরিয়া পার্ক, আমার কেনেডি থেকে আরো কিছুটা পথ যেতে হবে বাসে করে ব্রিমলি অব্দি।
– আপনি তো কোথাও জব করছেন তাই না?
– হুম, একটি ক্যাফেতে পার্ট টাইম কাজ করছি। ক্লাস, এসাইনমেন্ট, রান্না-বান্না সপ্তাহান্তে ঘরের অন্যান্য কাজ করতে হয়।
– ও, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতে হচ্ছে আপনাকে, একাই থাকছেন বুঝি?
– হ্যাঁ, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে বসবাস করছি। আপনার স্টপেজ চলে এসেছে নামতে হবে না?
– তাইতো! গুড্ নাইট, সি য়্যু টুমরো, টেক কেয়ার।
– গুড্ নাইট। ও হ্যাঁ, আগামীকাল থেকে ‘আপনি’ সম্বোধনটি আর শুনতে চাই না।
এবারের সামার খুবই ক্ষণস্থায়ী স্বভাব নিয়ে এসেছিল। কখনো মেঘ, কখনো রোদ্দূর মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা বৃষ্টির একটুকু ছোঁয়া লাগে। সামনে হবে রং বদলের খেলা। যেমন খুশি তেমন সাজো। পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির। পত্র-পল্লবে লেগেছে রঙ্গের প্রলেপ। নানা রঙ্গের এক রঙ্গিন মেলা। আস্ত টরন্টো শহর আজ থেকে রূপান্তরিত হবে একটি বিরাট প্রেম কাননে। ‘চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর……..।’ জনের মনেও লাগে ফাগুনের হাওয়া।
– চল আজ ধারে কাছে কোন পাব বা বারে গিয়ে সন্ধ্যেটা কাটাই।
– হুম, বাইরে যেভাবে স্নো পড়ছে তাতে করে ডাউন টাউনে যাওয়ার ইচ্ছেটা পরিহার করতেই হচ্ছে। চল তোমার প্রিয় সেই শার্লি বারেই যাই।
– শুধু কি আমার একারই প্রিয়, তোমার কি মোটেও না?
– অবশ্যই, বিশেষ করে ওদের ফুড আইটেমগুলোর তুলনা হয় না।
– মিশেল, তোমাকে তো বলাই হয় নাই, আমাকে দুদিনের
জন্য নিউইয়র্ক যেতে হচ্ছে একটা জরুরী বিজনেস পারপাসে। তের তারিখ ডেফিনিটলি ফিরে আসছি এবং চৌদ্দ তারিখ ভেলেন্টাইন্স ডে’তে অবশ্যই দেখা হচ্ছে আমাদের সেই প্রিয় স্থানেই।
– মনে আছে তা’হলে? আমিও আমার পড়া নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়বো, ভেকেশান শেষে জরুরী ক্লাস শুরু হয়ে যাবে যে। তখন একেবারে লেজে গোবরে অবস্থা হয়ে যাবে।
– কি যে বল, আমাদের জন্য একটা বিশেষ দিন মনে থাকবে না মানে?
জন ফিরে এসেছে। স্টেটস থেকে মিশেলের জন্য নিয়ে এসেছে কিছু দামী সুগন্ধি আর একটি ভেলেন্টাইন্স ডে স্কার্ট। মিশেলের সুগন্ধি ভীষণ পছন্দ। সকাল সকাল উঠেই শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে জন। রাতেই কিনে রেখেছে একটি সুন্দর লাল গোলাপের তোড়া। মিশেলের দেয়া টি সার্টের উপর লেদার জ্যাকেট চাপিয়ে গোলাপের তোড়া হাতে চলে এলো তাদের পূর্ব নির্ধারিত প্রিয় সেই ‘সফট বাইট’ বার এন্ড রেস্টুরেন্টে। দুপুর ১২টার আগেই পৌঁছে গেছে সেখানটায়। কখনো তো তার এমন দেরি হয় না নির্ধারিত কোন প্রোগ্রাম থাকলে। বরঞ্চ সময়ের কয়েক মিনিট আগে ভাগেই সে চলে আসে। আজ কেন এমনটি হলো? ফোনটা কেন অফ? আমার কাছে তো ফোন করে কোন ভয়েস মেইলও রাখেনি, তাইলে? কিছুদিন আগে কথায় কথায় মিশেল বলেছিল ওর মা নাকি ভীষণ অসুস্থ, সে কারণে আবার দেশে চলে গেল না তো? তা হলে কেমন করে যোগাযোগ হবে? ওর তো কোন ভন ধপপড়ঁহঃ বা বসধরষ রফ আমার জানা নেই তবে কেমন হবে?
লাস্ট ট্রেন চলছে। ট্রেনের কামরার এক কোনে নির্জনতাকে আলিঙ্গন করে বসে আছে জন মার্টিন। হাতে সেই লাল গোলাপ। পাশের সিটটি প্রথম থেকেই শূন্য। এখানেই মিশেলের বসার কথা ছিল আজও, এখানে বসেই হয়তো তার কাধে সে মাথা রাখতো। সে কেন আজ তার পাশে নেই, সে কেন আজ তার প্রিয় গোলাপ ফুলের শোভা থেকে দূরে? ভিক্টোরিয়া পার্ক এলে কে আজ বলবে ‘সি য়্যু টুমরো ডিয়ার’? আজ তাকে নেমে যেতে হবে এক হাতে গোলাপ আর এক বুকে গভীর শুন্যতা নিয়ে। হয়তো জনের অবচেতন মন বলে উঠবে ‘একটা শীতকাল আর চাঁদরের মতো গল্পে তুমি জড়িয়ে থাকতে আমার হৃদয়।’
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা