ইউসুফ কামাল : রোজা’র ছুটি শেষে অভি’র বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কর্মব্যাস্ততা আবার আগের মতো শুরু হয়ে গেলো। দীর্ঘ এক মাস বন্ধের পর সবাই আবার ফিরে এলো লেখাপড়ার জীবনে। আবার শুরু হয়ে গেল হল জীবনের হৈচৈ, ডাইনিং হলের খাওয়া আর সময় মতো ক্লাস করা। সব আবার আগের মতোই চলতে থাকলো, শুধু দিন শেষের অবসরে রিয়া অজান্তেই চলে আসে অভি’র চোখের সামনে। তখন অভি’র সময়টা শুধুই মধুর রিয়া’ময়।
যুদ্ধের সেই ভয়াবহ সময়গুলোর মধ্যে রিয়া’কে কেমন করে যে ভালো লেগে গিয়েছিলো অভি অনেক চেষ্টা করেও সেটা আর মনে করতে পারেনি। রোজই দেখা হতো দূর থেকে, বড় জোর দুই দিন কাছা কাছি দেখা হয়েছিলো। তারপর অভি’র যুদ্ধে চলে যাওয়ায় কারণে আর দেখা হয়নি। সুদীর্ঘ চার মাস পর আবার দেখা হয়েছিলো দু’জনের।
বান্ধবী ছবি’র বাসায় সেদিন রিয়া’র কথা শোনার পর অভি কোন মতেই ওর কথা কথাগুলো ভুলতে পারছিলো না। দু’দিন ধরে অভি গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত রিয়া কিভাবে নিলো? জীবন যুদ্ধে একাকী নামার এত সাহস সে কিভাবে পেলো? এত সাহসের উৎস কি?
দু’দিন পর ছবি’র সাথে বিকেলের দিকে ওর বাড়ীর সামনে দেখা, কুশলাদি বিনিময়ের পর রিয়া’র সে দিনের কথাবার্তার প্রসংগ উঠলো। আর তখন ছবি যা বল্লো তাতে অভি’র চোখের সামনে সেদিনের ঘটনার পিছনের অজানা তথ্য উন্মোচিত হয়ে গেলো, সব পরিস্কার হয়ে গেলো।
ছবি বল্লো, ভাই রিয়া আপনাকে নিয়ে এতো চিন্তা করে আমি কল্পনাও করি নাই। আপনাকে ও প্রচন্ড বিশ্বাস করে।
আমাকে সরাসরি বলে দিলো, আপনার এখন সময় দরকার, নিজের অবস্থানটা একটু শক্ত করে নেওয়া দরকার। অভি ভাবলো রিয়া এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার সাথে কোন রকম আলোচনাও তো করলো না!
তবে আলোচনা না করেও রিয়া যে বুঝতে পেরেছে এই সময় অভি’র পক্ষে সংসার করা সম্ভব না সেটা অভি’র আর বুঝতে বাকি থাকলো না।
লেখাপড়া শেষ হতে এখনও অনেক সময় লাগবে, উপার্জনের জন্য আরো বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাই প্রস্তুতির জন্য কিছুদিনের জন্য সময় দেওয়া দরকার।
আস্তে আস্তে অভি’র কাছে রিয়া’র সে দিনের কথার পিছনের বিষয়গুলো ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে শুরু করলো। অভি ভাবলো রিয়া তো এ বিষয়ে কোন কথাই সে দিন বলেনি, কিন্তু কেন বল্লো না?
অভি’র কাছে এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। অভি ধীরে ধীরে রিয়া’কে নতুন করে চিনতে শুরু করলো।
জীবন তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে চলে। অভি তার ক্লাস নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো, এর মধ্যে টিউটরিয়েল পরীক্ষার জন্য কয়েকদিন ধরে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে পরীক্ষার দিলো। পরীক্ষা ভালোই হলো পরীক্ষার ব্যাস্ততায় সে দিন পনেরো কোন দিকেই খেয়াল করতে পারেনি।
পরীক্ষা আর প্রতিদিনের ক্লাসের সাথে মিলেমিশে দিনগুলো মিশ্র ভাবে কেটে যেতে থাকলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটাই এমন, কোথা দিয়ে যে দিন পার হয়ে যায় বোঝা যায় না।
মাস তিনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈমিত্তিক ছুটির সাথে আরো দুই দিনের ছুটি মিলিয়ে চার দিনের একটা ছুটি পাওয়ায় অভি বাড়ী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অনেক দিন বাড়ী যাওয়া হয় না, সবাই কেমন আছে? মনের মধ্যে কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করলো। রিয়া’র কোন খবর ও তো জানে না অভি।
পর দিন সকালের বাস ধরে অভি চলে এলো ওর প্রিয় শহরে, যে শহরে থেকেই ও ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে, স্কুল কলেজের সীমানা পেরিয়ে যেয়ে পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িতে।
সারাদিন ওর প্রিয় রুমে ঘুমিয়ে কাটিয়ে বিকেলে বাইরে বের হতেই রিয়া’র নার্সিং এ যোগ দেওয়ার খবরটা অভি’র কানে পৌঁছে গেলো।
তার মানে রিয়া ঠিকই তার না বলা কথা’র পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে নিখুঁতভাবে। কথাটা শুনে হঠাৎ করেই অভি’র সারা শরীরে একটা কম্পনের সৃষ্টি হলো, স্থবির হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো অভি, বাবা মায়ের দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে রাজী না হয়ে জীবন যুদ্ধে পা বাড়ালো শুধুমাত্র ওর জন্য।
অভি’র ভীষণ চা’য়ের তেষ্টা পেলো, পরিচিত এক দোকানে বসে অনভ্যস্ত হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে চা খাওয়া শেষ করলো। সিগারেটে ও অভ্যস্থ না, কিন্তু কেন যেন খারাপ লাগলো না। কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো।
দোকান থেকে বেড়িয়েই অভি একটা রিক্সায় উঠে বসলো, ছবি’র সাথে দেখা করে রিয়া’র বিস্তারিত খবর নেওয়া দরকার। বিষয়টা এখনো ওর মাথার মধ্যে ঘুর পাক খাচ্ছে, আর ওর পরিবারই বা বিষয়টা কি ভাবে নিলো!
ভাবলো রিয়া’র সাথে একবার দেখা করা দরকার। দেখা করলে হয়তো ওর একটু ভালো লাগবে। (চলবে)
ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া