ইউসুফ কামাল : বলতে গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বারবারা’র সাথে আমার একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একটা শ্রদ্ধা বোধ ছিলো আমার তরফ থেকে আর বারবারা যে আমাকে স্নেহ করতেন সেটা তার কথাবার্তায় পরিস্কার বোঝা যেতো। শীতের শুরুতে বারবারা’র সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো, আমেরিকার শীত সম্মন্ধে আমার যে মোটেও ধারণা ছিলো না সেটা উনি বুঝে ফেলেছিলেন। শীতকে আমি হেলা ফেলা করতে শুরু করেছিলাম, তাইতো থার্মাল এর কথা বলেছিলেন। এটা গায়ে দিয়ে তার উপরে অন্যান্য জামা কাপড় পরলে যে কতটুকু আরাম লাগে, শরীরে এক ধরনের উষ্মতা অনুভব করা যায় সেটা আমি পরে বুঝেছিলাম। হঠাৎ করে যদি একবার ঠান্ডা লেগে যায় তাতে আমি যে বড় একটা বিপদে পরবো, সেটা বুঝেই বারবারা লোক মারফৎ আমার জন্য ‘কোলস্’ থেকে দুইটা থার্মাল আনিয়ে রেখেছিলেন।
কানাডা থেকে আমার ফিরে আসার পরের দিন বারবারা’র বাসায় কথাবার্তা শেষ করে উঠে আসার সময় দুইটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বাসায় এসে প্যাকেট দুইটা খোলার পর এক প্যাকেটে দুইটা থার্মাল আর অন্য প্যাকেট এ চারটা টাই পেয়েছিলাম। দামী টাইগুলো যে জার্মানের তৈরী সেটা টাই এর সাথের ট্যাগ দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম। বেচারা রবার্ট হয়তো ট্যাগ খুলে আর ওগুলো পরতেও পারেননি। সাথে সোনালী রংয়ের দুইটা টাই পিন পেয়ছিলাম। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে মেয়ের ফোনে বারবারা’র মৃত্যুর সংবাদটা জানার পর থেকেই মনটা স্বাভাবিক কারণেই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। বারবারা’র সাথে আমার তো কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই তবু এই ভালো মানুষটা প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের সবার কাছেই পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন। সাত দিন পর আবার মেয়ের ফোনে বারবারা সংক্রান্ত নতুন খবর পেলাম, লস এ্যান্জেলস্ থেকে ওর একমাত্র ছেলে এসেছে। মেয়ে বল্লো, মায়ের মৃত্যুতে তার মধ্যে কোন রকম দু:খ বোধ আছে বলে মনেই হলো না। সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, তাকে দেখে তাই মনে হয়েছে।
বাবা মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে যারা সিনিয়র শেল্টার হোমে রেখে আসে তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কিই বা আশা করা যায়? এখানে একা ফেলে রাখা আর সিনিয়র শেল্টার হোমে রাখার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বরং শেল্টার হোমে সুবিধা বেশি। সন্তানরা পরিবারের সাথে রাখতে চায় না, অথচ এই বৃদ্ধ বাবা মা কতটা কষ্ট করে সন্তানকে বড় করে তোলে সেটা তারা সহজেই ভুলে যায়। বারবারা’র বিষয়টা এর উল্টো, পার্থক্য শুধু বাবা মায়ের জন্য সিনিয়র সিটিজেন হোমে রাখলে টাকা দিতে হয় আর এখানে মায়ের জন্য কোন টাকা দিতে হয় না। বারাবারা নিজেই যথেষ্ট পরিমাণে স্বচ্ছল, রবার্ট সেই চিন্তা করেই আগে থেকেই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন বারবারা’কে দু:শ্চিন্তা ও ঝামেলা মুক্ত থাকার জন্যে। স্বামীর টাকার সাথে তার নিজের পেনশনের টাকা সব মিলিয়ে প্রচুর টাকা বারবারা’র একাউন্টে, তাছাড়া রবার্ট তার মৃত্যুর আগেই বাড়ির মালিকানাও বারবারা’র নামে উইল করে দিয়ে গেছেন, ভবিষৎ এ যাতে কারো কাছে হাত পাততে না হয়। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে রবার্ট সব দিক দিয়ে বারবারাকে সুরক্ষিত করে দিয়ে গেছেন।
আমার মেয়ে জানালো বারবারা’র সন্তান এর মধ্যে একদিন বাসায় এসে সৌজন্যমূলকভাবে দেখা করে গেছে। বাড়ি বিক্রীর কথাও বল্লো, রিয়েল এষ্টেট এর লোকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, ওদের লোক খুব সহসা এসে বাড়ি ইন্সপেকশান করে যাবে। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে ও আবার এসে কাগজপত্রে সই স্বাক্ষর করে দিয়ে যাবে। মায়ের ব্যবহার উপযোগী পোষাকসহ সব রকম জিনিষপত্র কয়েকটা বড় ব্যাগে ভরে ডোনেশান সেন্টারে দিয়ে এসেছে। বেশি মূল্যবান জিনিষপত্র ও নিজে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। সারা জীবনে ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা পছন্দের জিনিষপত্রের মূল্য একমাত্র তার কাছেই বড় যে সংগ্রহ করে, যা অন্যের কাছে মূল্যহীন। তাই তো ওগুলো প্রতি কোন মায়াও নেই। ল,ইয়্যার এর মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা তোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করে সমস্ত টাকা ওর নিজের একাউন্টে জমা করে নিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে বিশ পঁচিশ দিন চরম খারাপ অবস্থায় ছিলেন, হাসপাতাল আর বাসা আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলেন তখন কিন্তু বারবারা’র সন্তান একটি বারের জন্যও দেখা করতেও আসেনি। জীবিত অবস্থায় দেখতে আসেনি অথচ মায়ের মৃত্যুর পর এসে তড়িঘড়ি করে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
বিষয়টা শোনার পর ভাবলাম মায়া মমতা কেমন যেন মানুষের মন থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সর্বত্রই কেমন যেন একটা মেকী সম্পর্কের ছড়াছড়ি, বাইরের দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও ভিতরে কালিমায় ভরে আছে। নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও বারবারা’র মনটা ছিলো উদার। পেশাগত কাজের মধ্যেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে আহত রবার্টকে সেবা যতœ দিয়ে সুস্থ করে তুলে ছিলেন। আর সেই সময় দু’জন মনের দিক দিয়ে দু’জনের কাছে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে বারবারা নিজে রবার্টকে ফিরিয়ে না দিয়ে বরং তার ভালোবাসার প্রতি সন্মান দেখিয়ে এক সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তাই তো রবার্টের হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জের দিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দু’জন সরাসরি কোর্টে যেয়ে বিয়ে করে ফেলেছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে রবার্টের রিটায়ারমেন্টের সময়ই ওরা আর্টিফিসিয়াল পায়ের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলো। তাতে হাঁটা চলা ফেরায় তেমন সমস্যা হতো না কিন্তু স্বাধীন চেতা মানুষটা অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়াটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। রবার্ট ধীরে সুস্থে সব কিছু চিন্তা করে, তার নিজের স্থাবর অস্থাবর সব কিছু বারবারা’কে লিখে দিয়ে শেষে নিজে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সব কিছুর ব্যবস্থাই করে দিয়েছিলেন কিন্তু বারবারা’র মনের নির্জনতাটা কোনোভাবেই দূর করে যেতে পারেন নাই। কয়েক দিন ধরে বারবারা’র কথা মনে পড়ায় কোন কাজই করতে পারছিলাম না, ঘুরে ফিরে অসহায় বৃদ্ধা মানুষের চেহারাটাই শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো।
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেলসিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএস এ