ফরিদ আহমেদ : “বড় মাছের মধ্যে তোমার যেনো কোনটা পছন্দ?” ফোন ধরতেই উইলিয়াম জিজ্ঞেস করে।
বড় মাছের চেয়ে ছোট মাছের প্রতি আমার লোভ বেশি। তবে, এর মানে এই না যে বড় মাছ খাই না। তবে, বেছে নেবার সুযোগ থাকলে আমি নির্দ্বিধায় ছোট মাছের দিকে হাত বাড়াই।
“ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছো?” উত্তরে বলি আমি।
“রুই ধরনের বড় মাছের মধ্যে তোমার একটা পছন্দ আছে। তুমি আমাকে বলেছিলে একবার। ওটা কি মাছ?”
“ওহ! কাতলা।”
“হ্যাঁ, কাতলা। আমার কয়েক পিস কাতলা মাছ লাগবে। বাংলাদেশের গ্রোসারিতে কি পাওয়া যাবে?”

“কাতলা পছন্দ করে এমন লোকের সংখ্যা অনেক কম। আমি পছন্দ করি বলে কাতলা মাছ কিনতে যেও না। ঝামেলায় পড়বে তুমি।”
“কী ঝামেলা?” উইলিয়াম প্রশ্ন করে।
“আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কাতলা পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে নীচে। এর মানে হচ্ছে এই মাঝের স্বাদ কম। তার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এতে কাঁটা বেশি আর এর মাথার সাইজ বিশাল। তুমি কি মাছের মাথা রান্না করতে পারো?”
উইলিয়াম জানালো সে মাছের মাথা রান্না করতে পারে না।
“তাহলে কোনটা কিনবো? রুই?”
‘তুমি মৃগেল কিনতে পারো। এখানকার বাংলাদেশিদের মধ্যে পছন্দে এটা শীর্ষে।”
“আস্ত মাছতো আমি কিনবো না। আমার কয়েক পিস লাগবে শুধু। ওরা কি কেটে বিক্রি করে?”

“না, কেটে বিক্রি করে না। তবে, বাংলাদেশ থেকে কয়েক পিস এক সাথে করে ফ্রোজেন প্যাকেট হিসাবে আসে। সেটা কিনতে পারো তুমি।”
“তাহলে ওটাই কিনতে যাচ্ছি আমি।”
উইলিয়ামকে এই বুদ্ধি দেবার পর থেকেই মাথার মধ্যে খচখচানি শুরু হয় আমার। এই ধরনের ফ্রোজেন প্যাকেটের মাছ কিনে এনে বহু ঠকেছি আমরা। বরফ দিয়ে ভরে রাখে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। বরফ গলার পরে দেখা যায় সামান্য কয়েকটা মাত্র মাছ পড়ে আছে। তার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে এগুলো অনেক সময় পচা থাকে।
“শোনো উইলিয়াম। আসো আমরা দুইজনে মিলে একটা মাছ কিনি। তুমি অর্ধেক নিলে, আমি অর্ধেক।”

আমার প্রস্তাবে দারুণ খুশি হয়ে ওঠে সে। বলে যে তার অর্ধেকও লাগবে না।। কয়েকটা টুকরো হলেই হবে।
“আচ্ছা নিও কয়েক টুকরো।”
“ফরিদ, আমি যদি লেজ নেই, তুমি কি মাইন্ড করবা?” সামান্য অস্বস্তি নিয়ে উইলিয়াম বলে।
“আরে! আমি মাছ কিনছি তোমার জন্য। আমারতো মাছের দরকার নেই। এখানে তোমার প্রিফারেন্স আগে। তুমি যে যে টুকরো পছন্দ করো সেগুলো সব নিও।”
উইলিয়াম খুশি হয়ে যায় অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে। আমি ওকে বলি যে কয়েক মিনিট পরে ফোন দিচ্ছি আমি।

উইলিয়ামের বাসার কাছাকাছিই একটা বাংলাদেশের গ্রোসারি আছে। ওখানে কল দেই আমি। যে ছেলেটা দোকান চালায় তাকে চিনি আমি। তাকে জিজ্ঞেস করি যে ভালো মৃগেল আছে কিনা। সে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতেই নির্দেশনা দেই তাকে। বলি যে একটা মৃগেল কাটতে হবে এখনই। আমার বন্ধু উইলিয়াম আসবে। পুরো মাছের টুকরোগুলো তার সামনে ধরতে হবে। সে তার পছন্দের টুকরোগুলো বেছে নেবে, বিশেষ করে লেজটা তার। উইলিয়াম মাছ নেবার পরে তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না কিছুতে। আমার অংশ যখন আমি তুলতে আসবো, তখন আমি পে করবো।
ছেলেটা বুঝতে পারে বিষয়টা। আমাকে নিশ্চিত করে যে সে উইলিয়ামের কাছ থেকে টাকা নেবে না।
উইলিয়ামকে ফোন করে বললাম যে, “মৃগেল কাটছে। তুমি গিয়ে তোমার অংশ নিয়ে এসো।”

“আমি দশ মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি ওখানে।”
ফোন রাখার পরেই মাথার ভিতরে আবার অস্বস্তি শুরু হয় আমার। আমি উইলিয়ামকে চিনি। ঝামেলাবাজ লোক একটা। ওর সাথে যতো জায়গায় গিয়েছি সব জায়গাতেই সে ঝামেলা পাকিয়েছে। তার ঝামেলা পাকানোর একটা নমুনা হচ্ছে সে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ওয়েটারদের ঘুষ দেয়। ঘুষ দেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাড়তি খাবার আনা। যে খাবার কিনতে হয়তো দুই তিন ডলার লাগবে, সেটা সে ওয়েটারদের দশ ডলার ঘুষ দিয়ে ফ্রি আনায়।
একবার নীলগিরি নামের একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি। একটা সস তার খুব পছন্দ হয়েছে। সে ওই সসের আরেকটা চায়। অর্ডার দিলে খুব বড়জোর এক বা দেড় ডলার বিল আসবে। অনেক সময় রেস্টুরেন্টগুলো সসের মতো এমন তুচ্ছ জিনিসের জন্য বিলও করে না। সহজে যে জিনিসটা পাওয়া যাবে, সেটার জন্য জটিল রাস্তা ধরলো উইলিয়াম। ওয়েটার ছেলেটাকে ডেকে ষড়যন্ত্রকারীদের মতো ফিসফিস করে বললো, “আমাকে একটা বাড়তি সস এনে দাও, তোমাকে আমি পাঁচ ডলার দেবো।”
ওয়েটার ছেলেটা বলে যে, “স্যার, আই ক্যান্ট টেক মানি ফ্রম ইউ। দেয়ার আর ক্যামেরাজ হিয়ার। ইফ ইউ ওয়ান্ট টু গিভ মি দ্য মানি, ইউ হ্যাভ টু কাম টু দ্য ওয়েশরুম।”

ওয়েটার ছেলেটার কথা শুনে আমি প্রমাদ গুনি। বাচ্চা একটা ছেলে। দেশে হয়তো মায়ের কোলের মধ্যে বড় হয়েছে। বিদেশে এসে বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্ট কাজ করছে। কিন্তু, জীবনের অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি।
ওয়েটার ছেলেটা অনভিজ্ঞ হলেও উইলিয়াম না। সে ওয়াশরুমের যাবার জন্য ওঠে না। তার বদলে ছেলেটাকে ডাক দেয়,
“কাম ক্লোজ টু মি।”
ছেলেটাকে বিভ্রান্ত দেখায়।
“কাম ক্লোজ টু মি। তোমার কাপড়ে ময়লা লেগে রয়েছে।” উইলিয়াম আবার বলে।
বিভ্রান্ত ছেলেটা এগিয়ে যায় উইলিয়ামের দিকে। উইলিয়াম তার এপ্রোন পরিষ্কার করার ছলে এপ্রোনের পকেটের মধ্যে একটা দশ ডলারের নোট গুঁজে দেয়। কোন ফাঁকে যে সে মুঠোর মধ্যে টাকা লুকিয়ে রেখেছিলো সেটা বুঝতেই পারিনি আমি।

এপ্রোনের পকেটে টাকা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা। আবেগে চোখ দুটো টলমল হয়ে পড়ে। এই নিষ্ঠুর দেশে এই রকম আদর হয়তো কেউ তাকে দেখায়নি আগে।
“নাউ, গেট মি এনাদার সস সান। সস ছাড়া খেতে পারছি না আমি।”
“শিওর স্যার” বলে ছেলেটা ছুটে যায় কিচেনের দিকে। সস আনার তাড়া, নাকি চোখের জল লুকোনোর চেষ্টা, বুঝতে পারি না আমি।
এই রকম ঝামেলা বাংলাদেশের গ্রোসারিতেও করতে পারে, সেটা মাথায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমিও যাবো। আন্নাকে এমনিতে আনতে যেতে হবে আমার। হাইওয়ে না নিয়ে লোকাল রাস্তা ধরলে গ্রোসারিটা পড়বে।
ওখানে গিয়ে দেখি উইলিয়াম আগেই হাজির এবং যথারীতি ঝামেলা একটা পাকিয়েছে।
সিংকের মধ্যে পানি আটকানো হয়েছে। সেখানে একটা মৃগেল মাছ হাবুডুবু খাচ্ছে।

সে ছেলেটাকে বলেছে যে মাছের আঁশ ছাড়াতে সে পারে না। তাকে আঁশ ছাড়িয়ে দিতে হবে। ফ্রোজেন মাছের আঁশ ছাড়ানো যায় না। তাই ওটাকে নরম করার জন্য পানিতে চুবিয়ে রেখেছে। নরম হলে আঁশ ছাড়িয়ে তারপরে কাটবে।
দোকানের ছেলেটা অনভিজ্ঞ। নরম মাছ যে ইলেক্ট্রিক স দিয়ে কাটা বিপদজনক, সেটা সে জানে না। তাকে বললাম আমি কথাটা। সে বলে যে, “ভাইয়া কী করবো, উনি এসে বলতেছেন যে আঁশ ছাড়িয়ে দিতে হবে।”
“উইলিয়াম একটা অলস লোক। রিটায়ারমেন্টের পরে আরও অলস হয়েছে। এই মাছের আঁশ সে না ছাড়াতে পারার কথা না।”
সে যে অলস এই কথায় হাসিমুখে সায় দেয় উইলিয়াম।
ছেলেটা আমার কথা শুনে মাছটাকে উঠিয়ে কেটে দেয়। কিছুটা নরম হয়ে যাওয়ায় কষ্টই হচ্ছিলো কাটতে। আমি না গেলে এই মাছ কাটতে গিয়ে নির্ঘাত বিপদে পড়তো ছেলেটা।
মাছ কাটার পরে উইলিয়ামকে বলি তার পছন্দের অংশগুলো বেছে নিতে।
মাছের দাম দিতে যখন যাচ্ছি, উইলিয়াম বলে যে “তুমি আমাকে মাছের দাম দিতে দিবা না, তাই না?”

“তুমি সামান্য কয়েকটা পিস নিছো, ওর জন্য আবার দাম কীসের?”
গতকাল দুপুর বেলা হঠাৎ করেই দেখি উইলিয়াম কল দিয়েছে।
“তুমি বাসায়, না অফিসে?”
“অফিসে। কী ঘটনা?”
“তুমি বাসায় আসলে বলো। আমি একটু আসতে চাচ্ছি।”
“কী জন্য?” জিজ্ঞেস করি আমি।
“মৃগেল মাছ দিয়ে ঝোল করেছিলাম। তোমাকে কিছুটা দিতে চাই।”
“উইলিয়াম, ওই একই মাছ আমিও এনেছি। মাছের তরকারি তোমার আনতে হবে না।”
“আমি চাচ্ছি তুমি আমার রান্নাটা পরখ করো। খেয়ে আমাকে জানিও কেমন হয়েছে।”
কাজের শেষে বাসায় ফেরার পথে উইলিয়ামকে কল দেই। সে ধরে না। মেসেজ রাখি।
বিকালের দিকে দেখি সে কল ব্যাক করেছে। আমি বাসায় আছি জেনেই বললো যে সে আসছে।

একটা ফয়েল ট্রেতে করে দেখি সে মাছ নিয়ে এসেছে আমার জন্য। ওটার ঢাকনা হিসাবে যে সাদা কাগজটা রেয়েছে, সেখানে কিছু একটা লেখা।
‘তুমি মনে হচ্ছে একেবারে প্রপার গিফট নিয়ে এসেছো। টু ফরিদ, ফ্রম উইলিয়াম, এটা লিখেছো নাকি?” আমি দেখার চেষ্টা করি লেখাটা।
তাকিয়ে দেখি সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা রয়েছে ‘ফিশ কারি মেইড বাই উইলিয়াম’।
“নিজের রান্নার প্রচারণা শুরু করে দিয়েছো মনে হচ্ছে তুমি।” আমি মুচকি হেসে বলি।
উইলিয়াম লজ্জা পায়, বিব্রত হয়। গলা পরিষ্কার করে বলে, “অ্যাাাডেল লিখেছে।”
আন্না বাসায় ফেরার পরে তাকে বললাম সব ঘটনা।
সব শুনে-টুনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে সে বললো,
“দুনিয়াতে যে কতো ধরনের পাগল আছে।”