(ইতিপূর্বে ১২-ই ভাদ্র ফেইসবুকে প্রকাশিত)
স্বপন কুমার সিকদার : “শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম, আঁচলের গাঁথা মালা, ফেলিও পথ পরে
বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে, যমুনা নদী পারে শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলী দীপশিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া, দু হাতে ঢেকো আঁখি, যদি গো জলে ভরে” – কাজী নজরুল ইসলাম।
১২-ই ভাদ্র। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ আমাদের জাতীয় কবি ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২-ই ভাদ্র তারিখে চিরবিদায় নেন। কবির প্রিয় মাস শ্রাবণ। তাই, উনার প্রয়াণ দিবসে এই বিনীত উপস্থাপন। প্রেম, প্রকৃতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি মিশিয়ে শ্রাবণ তথা শাওন মাসকে নিয়ে রয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য সৌন্দর্যমন্ডিত সৃষ্টি। তিনি সৃষ্টি করেছেন বরষা-বিরহ-প্রেমের অতলান্তিক আবহ। শ্রাবণ মাসটি কবির অগণিত গান ও কবিতার প্রভায় সমুজ্জ্বল।
বর্ষার রাণী শ্রাবণ। শ্রাবণের বৈভবশালী রূপ-সুধা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। গানে কবি প্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে শ্রাবণ-মেঘের আবহকে টেনে এনেছেন বারেবারে। যেমন -“শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না, বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না”।
প্রকৃতির বহুমাত্রিক রূপ শ্রাবণে। শ্রাবণ নিয়ে আসে মায়াবী জলকণার পরশ – প্রকৃতিকে সাজায় বর্ণাঢ্য সাজে। বৃষ্টি কখনো ঝমঝম, মুষুলধারে, কখনো টিপ টিপ। তা কবির অন্তরাত্মাকে নাড়া দেয় ও বলেন, “মোর ঘুমোঘোরে এলে মনোহর, শ্রাবণ-মেঘে নাচে-নাচে-নাচে শ্রাবণ-মেঘে নাচে নটবর, রমঝম, ঝমঝম, রমঝম। শিয়রে বসি চুপিচুপি চুমিলে নয়ন, মোর বিকশিল আবেশে তনু, নীপ-সম, নিরুপম, মনোরম”।
শ্রাবণে কখনো ঘন কালো আকাশ, বিদ্যুতের সাথে বজ্র রুদ্র রূপে। প্রকৃতির বৃষ্টিস্নাত রূপ মনকে উতলা করে। মেঘ, বৃষ্টি, রৌদ্রছায়ায় পুরো আকাশে চলে যেন লুকোচুরি খেলা। জীবন চলে শ্রাবণ-ধারার সাথে কখনো মিতালী, কখনো সংগ্রাম করে। শাওন রাতের জল ছলছল আবহ কাউকে পাওয়ার আশায় মনকে উচাটন করে – হৃদয়-তন্ত্রীতে ঝড় তোলে। কবির ভাষায় – “বৃষ্টি ভেজা নিঝুম রাতে, মন চায় প্রিয়জনকে পেতে”। কবি নজরুলের গানের বিশাল সৃষ্টিতে বরষা, প্রিয়া-বিরহ এক অনন্যরূপে উঠে এসেছে বারবার। কবির সত্ত¡াতে শ্রাবণ যেন আকাশে সঞ্চরণশীল মেঘপুজ্ঞ। তার গানে প্রিয়ার প্রতি উনার আবেগ ফুটে উঠেছে অনুপমরুপে। কবি তা প্রকাশ করেছেন এইভাবে – “আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনার। আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি, আমারি তিয়াসী বাসনায়”।
কবির গানে প্রেম, প্রীতি আর ভালোবাসার এক অপূর্ব সম্মিলন আমরা দেখতে পাই। যেমন –
“এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, বেণু কুঞ্জ ছায়ায় এসো তাল-তমাল বনে, এসো শ্যামল ফুটাইয়া যূথী কুন্দ নীপ কেয়া
শ্রাবণ বরিষণ হরষণ ঘনায়ে, এসো নব ঘন শ্যাম নূপুর শুনায়ে, যমুনা স্রোতে ভাসায়ে প্রেমের খেয়া, ঘন দেয়া, মোহনীয়া, শ্যাম পিয়া”।
কখনো বরিষণে কবির ঘুমন্ত প্রেম জেগে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। কবি বলেন – “সে রহে কোথায় হায়? আমি যার বরষার আনন্দ কেকা, নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা, যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর, কে সেই সুন্দর, কে”?
কখনো কবি শ্রাবণের মেঘকে উনার না বলা কথা বলার জন্য আহ্বান করেছেন – “ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ, বন্দিনী গিরি-ঝরণা পাষাণতলে যে কথা কহিতে চায়। ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি, তোদের ভাটির স্রোতে, নিয়ে যা আমার না বলা কথাগুলি, ধুয়ে মোর বুক হতে”।
কবি বরষার মাঝেই মহিয়ান সুন্দরকে খুঁজে পেতে চান। উনি প্রিয়াকে পত্র পাঠাতে চান বরষার কেয়া পাতে, তাও নিয়ে যাবে মেঘদূত। যেমন –
“যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে, লেখা কেয়া পাতে, বরষার ফুলদল বেদনায়, মূর্চ্ছিয়া আছে আঙিনাতে।”
প্রিয়া আর শ্রাবণ এক অভিন্ন সত্তায় মিশে আছে কবির করুণ বিরহী মনে। কবি তা প্রকাশ করে বলেন, “ঝর ঝর ঝরে শাওন ধারা, ভবনে এলো মোর কে পথহারা, বিরহ রজনী একলা যাপি, সঘনে বহে ঝড় সভয়ে কাঁপি”
শ্রাবণে মেঘে মেঘে ভরা অসীম আকাশ। কখনো যেন দিশাহারা হয়ে কাঁদছে। কখনো মেঘের ভেসে বেড়ানো কবি মনকে করে উদ্দীপ্ত ও প্রাণবন্ত। যেমন –
“দুলিবি কে আয় মেঘের দোলায়। কুসুম দোলে পাতার কোলে, পুবালি হাওয়ায় ”।
শ্রাবণে রুমঝুম ঝুম বাদল নুপুর কখনো বেজেই চলে। প্রিয়ার সান্নিধ্য পেতে কবি মন ব্যাকুল হয় – কবির মনে পড়ে অতীত স্মৃতি। তা তিনি তুলে ধরে বলেন –
“অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে, নিদ্রা নাহি তোমায় চাহি’ আমার নয়ন -পাতে। ভেজা মাটির গন্ধ সনে, তোমার স্মৃতি আনে মনে” ।
আকাশে বিজলীর ঝলকানি, রিমঝিম বৃষ্টি কবির মনকে বিরহী করে তোলে, প্রণয়নীর চিন্তায় মন হয় ব্যাকুল। তা তিনি প্রকাশ করেছেন বিভিন্নভাবে। যেমন –
“গগনে সঘন চমকিছে দামিনী, মেঘ-ঘন-রস রিমঝিম বরষে। একেলা ভবনে বসি’ বাতায়নে, পথ চাহে বিরহিণী কামিনী”।
কখনো শ্রাবণ কবি মনকে করে তোলে বিষাদ গ্রস্থ। তাই তিনি বলেন – “ফুটিল কি কদম কেয়া? দোলে, কা’র বুকে ফুল, কা’র নয়নে দেয়া?
কে গেল অভিসারে কে কাঁদে ভবনে? কা’র দীপ নিভে গেল দূরন্ত পবনে”?
মেঘলা নিশি বা ভোরে কবি মন হয় উচাঠন। মেঘের সাথে কবির মনও উড়ে চলে। কবি নিজের মনকে বিরহী প্রিয়ার মনের সাথে তুলনা করে বলেন –
“আজ শ্রাবণের লঘু মেঘের সাথে মন চলে মোর ভেসে”, রেবা নদীর বিজন তীরে মালবিকার দেশে।।
মন ভেসে যায় অলস হাওয়ায়, হালকা-পাখা মরালী-প্রায়, বিরহিনী কাদেঁ যথা একলা এলাকেশে”।
শ্রাবণে অশান্ত ধারায় বারি পতনের মাঝে কবি বিরহীর বীণার সুর যেন শুনতে পান। যেমন – “নিশি-ভোরে অশান্ত ধারায় ঝরঝর বারি ঝরে। আকাশ-পারের বিরহীর বীণা যেন সুর ঝুরে আকুল স্বরে”।
গগন জুড়ে আসে শ্রাবণের ঘন মেঘ ও সজোরে বাতাসের প্রবাহে ধরণী হয় বিহ্লল। চতুর্দিক যেন ভয়ে কাঁপে। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি, জোরে বৃষ্টি পতনের শব্দে মনে হয় যেন আকাশে ঝমঝম শব্দে ঝাঁঝর বাজছে। এমন পরিবেশে কবি মনও হয় ভীত ও সন্ত্রস্থ যা কবি প্রকাশ করেছেন এইভাবে –
“ঝরিছে অঝোর বরষার বারি। গগন সঘন ঘোর, পবন বহিছে জোর, একাকী কুটীরে মোর রহিতে নারি, শিয়রে নিবেছে বাতি, অন্ধ তমসা রাতি”।
কালো মেঘ নিয়ে আসে বাদলের ধারা। বারি ঝরে ঝরঝর। কালো মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকায়। মেঘ ডেকে ওঠে গুরু গুরু। কবির ভাষায় – “শ্রাবণের গগনের গায়, বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়। ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে”।
কবির দৃষ্টিতে শ্রাবণ যেন কখনো স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেনী-বর্ণা-মালবিকা।তাই তিনি আহ্বান করেছেন শ্রাবণকে যেন -“মেঘের হিন্দোলা দেয় পূব-হাওয়াতে দোলা”। কবি বলেন, “বাদল-মেঘে মাদল বাজে গুরুগুরু গগন-মাঝে”। তার গভীর রোল কবি হৃদয়কে করে দোলায়িত।
কবি ঘোর শ্রাবণ নিশিতে বিরহ বিহ্বল। শ্রাবণের বৃষ্টি ভেজা আকাশ মনকে করে উতলা। প্রিয় জনকে মন পেতে চায় কাছে। কবি তা প্রকাশ করেছেন নিপুণ দক্ষতায় – “আজ নতুন করে পড়ল মনে মনের মতনে, এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।
কার কথা আজ তড়িৎ-শিখায়, জাগিয়ে গেল আগুন লিখায়, ভোলা যে মোর দায় হল হায়, বুকের রতনে”।
শ্রাবণে ময়ূর ডাকে, বৃষ্টিধারার টাপুর টুপুর শব্দ কবির কাছে যেন নিক্কন। বিজলিতে বৃষ্টির চপল চাওয়া কবি যেন দেখতে পান মেঘের ফাঁকে।
শ্রাবণের লঘু মেঘের সাথে কবির মন ভেসে চলে। তিনি প্রেম নিবেদন করে বলেন – “অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে, নিদ্রা নাহি তোমায় চাহি আমার নয়ন-পাতে। ভেজা মাটির গন্ধ সনে, তোমার স্মৃতি আনে মনে, বাদলী হাওয়া লুটিয়ে কাঁদে আঁধার আঙিনাতে”।
নজরুলের গানে আছে বরষায় প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকুতি বিভিন্নরুপে। যেমন, “মেঘ মেদুর বরষায়, কোথা তুমি, ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভ‚মি। ঝুরে বারিধারা, ফিরে এসো পথহারা, কাঁদে নদী তট চুমি”। “আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে, দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে, ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে”।
বারো মাসের মধ্যে শ্রাবণ প্রাণে, মনে, প্রকৃতিতে ছড়ায় আলাদা ব্যঞ্জনা।
বৃক্ষ, লতা, পাতাগুল্ম যেন প্রাণ পায়। শ্রাবণের বৃষ্টির ছোঁয়ায় কদম, হিজল, কেয়া ও যুথিকা প্রস্ফুটিত হয়। শাপলার ঐশ্বর্য্যে নয়নাভিরাম হয়ে উঠে প্রকৃতি। আম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, জাম্বুরাসহ অসংখ্য দেশীয় ফলের সমারোহ শ্রাবণে। কবি শ্রাবণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে বলেন, “রিমিঝিম রিমিঝিম ঐ নামিল দেয়া, শুনি’ শিহরে কদম, বিদরে কেয়া। ঝিলে শাপলা কমল, ওই মলিল দল”।
শ্রাবণ কখনো প্রেম-বিরহ তাড়িত। বর্ষা আসতেই আমাদের মনে পড়ে নজরুলের গান – মনে পড়ে প্রিয়তমার স্মৃতি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষাকে দেখেছেন ‘বাদলের পরী’ মূর্তিতে। তিনি লিখেন, “রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে, কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে”। একই ভাবের অন্য একটি গান, “পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে, বলিও আমার পরদেশীরে”।
নজরুলের বর্ষা ঋতুর গানে প্রেম ফুটে উঠেছে নতুন মাত্রায়, বারে বারে। যেমন, “দোলে বন তমালের’, ‘গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে”, “এলো কৃষ্ণ কানাইয়া”, “সখী বাঁধো লো বাঁধো”, “সোনার হিন্দোলে কিশোর” ইত্যাদি। এসব গানে বর্ষা আর প্রেম মিলে মিশে একাকার। বর্ষার অনেক গানে নিপুণভাবে প্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন কবি।
কবি বলছেন “আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে, থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশের আকাশে”।
তা’ছাড়া আছে “মেঘ-ঘন-কুন্তলা”, “কাঁখে বরষা-জলের ঘাগরি”, “এলায়ে মেঘ-বেণী, কাল-ফণী, আসিল কি দেব কুমারী” ইত্যাদি সৃষ্টি।
বর্ষার প্রকৃতিতে কবি তার প্রিয়াকে খুঁজে বলেন “কত বরষায় খুঁজেছি তোমায়, তারায় তারায়”। বিরহী মনের ছোঁয়া ফুটে উঠেছে নজরুলের গানে। প্রেমের পাশাপাশি বিরহও ধরা দিয়েছে নানাভাবে। যেমন, “ঝুরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে”। বর্ষা, প্রিয়া আর বিরহের দৃশ্য আরও অনেক গানেই এঁকেছেন প্রেমের কবি নজরুল। তা আমরা দেখি “অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?”, কিংবা, “এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, ফুটাইয়া যূঁথি-কুন্দ-নীপ-কেয়া, বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে, বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া” ইত্যাদি গানে।
নজরুলের গানে শ্রাবন এসেছে কখনো প্রচন্ড সুরের মূর্চ্ছণা নিয়ে। বিরহ ও বিরহী মন শ্রাবনে উতলা হয়ে ওঠে। বদলে যায় প্রকৃতির রূপ। জীবনে আমরা যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখন শ্রাবণ আসে সজীব পরশ নিয়ে, ভালোবাসার অনুরাগে। যেমন – “এ ঘোর শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে, হায়, রহি রহি সেই মুখ পড়িছে মনে। বিজলিতে সেই আঁখি, চমকিছে থাকি থাকি, শিহরাতো এমনি সে বাহু-বাঁধনে”। শ্রাবণ-ধারা নব ধারারও সৃষ্টি করে। যেমন – “এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া”, “ঝরে ঝরঝর কোন্ গভীর গোপন ধারা এ শাঙনে। আজি রহিয়া রহিয়া গুমরায় হিয়া একা এ আঙনে” ইত্যাদি গান ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে শ্রাবণ নবধারায় – পূর্ণ করে দেয় সঙ্গীত ভান্ডার।
শ্রাবণ মানেই বাদলা দিন আর অথই পানি। কখনো অতি বর্ষণে দেখা দেয় নদীভাঙন ও বন্যা। মনের মেঘগুলো ছুটে চলে শ্রাবণের আকাশ জুড়ে। এই বৃষ্টি, এই মেঘ নীলাকাশে। কবির কাছে শ্রাবণ যেন কখনো বিরহকাল। বিভিন্নভাবে তার প্রকাশ। যেমন- “আসিলে এ ভাঙা ঘরে কে মোর রাঙা অতিথি। হরষে বরিষে বারি শাওন-গগন তিতি”। “আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে। গুরু দেয়া গরজন কাঁপে হিয়া ঘনঘন, শনশন কাঁদে বায়ু নীপ-কাননে। ভাঙিয়া দুয়ার মম এসো এসো প্রিয়তম, শ্বসিছে বাহির ঘর ভেজা পবনে” এবং কবির আরও অনেক গানে।
শ্রাবণে ঘোর ঘনঘটায় কখনো গগন ছেয়ে যায়। শিহরে তরুলতা। নিখিল নয়নে যেন শ্রাবণের ধারা। বারিধারে কাঁদে যেন চারিধারে।সজল শাওন-মেঘ পরিবেশকে গভীরতর করে অনেকভাবে। কবি লিখলেন – “সেদিন শ্রাবণধারার মত, সুর ঝ’রে যায় অবিরত, যেদিন তোমার স্মৃতি এসে কাঁদায় আমায় ঘুম ভাঙিয়ে”। “তোমার আঁখির মত আকাশের দুটি তারা, চেয়ে থাকে মোর প্রাণে নিশীথে তন্দ্রাহারা। সে কি তুমি? সে কি তুমি”? ইত্যাদি গান।
কবির কাছে শ্রাবন মেঘের চেয়েও শ্যামল। কবি বলেন – “মেঘ-বরণ কন্যা থাকে মেঘ্লামতীর দেশে, সেই দেশে মেঘ জল ঢালিও তাহার আকুল কেশে। তাহার কালো চোখের কাজল, শাওন মেঘের চেয়েও শ্যামল, চাউনীতে তার বিজলি ছড়ায়, চমক বেড়ায় ভেসে”।
শ্রাবণ যেন ভেসে চলে গানে আর গানে।মনের ময়ূর ময়ূরী নাচে আনন্দে। কবি তা প্রকাশ করে বলেন – “মেঘের ডমরু ঘন বাজে। বিজলী চমকায়, আমার বনছায়, মনের ময়ূর যেন সাজে। সঘন শ্রাবণ গগন-তলে, রিমি ঝিমি ঝিম্ নবধারা জলে, চরণ-ধ্বনি বাজায় কে সে- নয়ন লূটায় তারি লাজে”।কবির অনেক গানেই আমরা দেখি বিরহ ও প্রেমের অফুরন্ত ছোঁয়া। যেমন- “কভু নদীর পানে চেয়ে,’ লুকিয়ে যথা নয়ন মোছে গায়েঁর কালো মেয়ে, একলা বধূ বসে থাকে যথায় বাতায়নে, বাদল দিনের শেষে”। “আজি বাদল বঁধূ এলো শ্রাবণ-সাঁঝেÑ নীপের দীপ ঢাকি’ আঁচল ভাঁজে”। “শ্রাবণ রাতের আঁধারে নিরালা ব’সে আছি বাতায়নে, রেবা নদীর খরস্রোত বহে বেগে আমার মনে”।
শ্রাবণের ঘন ঘোর বারিধারার দিনে প্রিয় জনের সান্নিধ্য পেতে কবির মন কত যে আকুলিত হত তা প্রকাশ করেছেন নানারুপে। যেমন –
“ঘন ঘোর বরিষণ মেঘ-ডমরু বাজে, শ্রাবণ রজনী আঁধার। বেদনা-বিজুরি-শিখা রহি’ রহি’ চমকে, মন চাহে প্রেম অভিসার”।
“রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা। গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা। ঘুমন্ত ধরা মাঝে, জল-নূপুর বাজে, বিবাগী মন মোর হল পথহারা”।
প্রেমের কবি, ভালবাসার কবি শ্রাবনের দিনে প্রিয়তমার কাছে প্রেম নিবেদন করে বলেন, “এ ঘোর শ্রাবণ দিন কাটে কেমনে, বলো তুমি বিনে প্রিয়তমা মোর, …দেখা দাও আজি এ শ্রাবণে- এসো ভরি মোর দু নয়নে”।
শ্রাবণ মেঘ যেন কবিকে অনেক কিছু বলতে চায়। শাওনের ঘন ঘোর অঝোর ধারার কবির সৃষ্টিতে অবদান সীমাহীন। তা তিনি বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। যেমন – “কে বিরহী রহি রহি দ্বারে আঘাত হানো”। “জলদ-তাল বাজে শ্রাবণ-মেঘে, তরুরে জড়ায়ে দোলে বন-লতা পবন বেগে, মনের মাঝে দোলে মিলন-বিরহ-দোলনা। শান্ত আকাশে আজি বেদনা ঘনায়, কত কি বলিতে চায় শ্রাবণ-ধারায়”।
“আজ উতল ঝড়ের কাতরানিতে গুমরে ওঠে বুক, নিবিড় ব্যথায় মূক হয়ে যায় মুখর আমার মুখ।
জলো হাওয়ার ঝাপটা লেগে, অনেক কথা উঠল জেগে, পরান আমার বেড়ায় মেগে, একটু যতনে”।
শ্রাবণের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত কবি বলেন – “রিমিঝিমি রিমিঝিমি বারিধারা বরষে। … চমকে বিজলি ঘনঘন, শনশন পূব হাওয়া বহিছে হরষে। এসো বিরহী শ্যামল মোর ভবনে, নূপুর শোনায়ে শ্রবণে, চাহে ফুটিতে এ হিয়া নীপ সম, তব মধুর সজল পরশে”।
শ্রাবণ রাতে সঘন বর্ষাধারা নামে। কবির বিরহী মন নানাভাবে প্রেম নিবেদন করে প্রিয়তমার কাছে। যেমন – “ঝর ঝর বারি ঝরে অম্বর ব্যাপিয়া, এসো এসো মেঘমালা প্রিয়া প্রিয়া।। দূরে থেকো না এই শ্রাবণ নিশীথে, কাঁদে তব তরে পিয়াসি হিয়া”। “দেখা কি পাব না হায়, আশা যে ফুরায়ে যায়, শ্রাবণে এলো গো মেঘ, কাঁদিছে কেকা”।
মেঘলা দিন কবির কাছে বিরহের একটি দিন, আবার কখনো তা ভালবাসায় মোড়ানো স্মৃতিবিজড়িত একটি বিশেষ দিন। মেঘবালিকা যেন ডানা মেলে – ছুঁয়ে যায় আকাশের ওই নীল সীমানা। অঝোর ধারা কখনো ঝরে সারাদিন। তাতে কবির মন হয় দিশেহারা। কবি মন মেঘলা দিনে কখনো হয় রোমাঞ্চিত, আবার কখনো বিরহী। কবি বলেন, “আজি বরিষনমুখরিত শ্রাবণরাতি, স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি”। কবি শ্রাবণের বর্ষনকে স্রষ্টার করুনা বর্ষণের সাথেও তুলনা করেছেন। যেমন – “শাওন বরিষা সম তব করুণার ধারা, ঝরিয়া পড়ুক পরানে আমার”।
গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে, বৃষ্টির নুপুর বাজিয়ে শ্রাবণ আসে। শ্রাবণ আনে নতুন আশা। কবির কথাগুলো শ্রাবণের বাতাসে ধানের চারা দোলার মত আমাদের অন্তরকেও দোলায়িত করে, করে সজ্ঞীবিত ও প্রাণবন্ত। বাংলা সাহিত্য সীমাহীনভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে কবির শ্রাবণ নিয়ে সৃষ্টিতে। আমাদের প্রাণের কবি, গানের কবি, প্রেম-বিরহ-ভালোবাসার কবি ও উনার প্রিয় শ্রাবন আমাদের আনন্দ ও প্রেরণা দিবে চিরকাল। মানবতা ও অসা¤প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতীক এই মহান কবির প্রয়াণের বিশেষ দিনে কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করচ্ছি। সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। সবার প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ।
প্রকৌশলী, ‘ইনস্টিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, বাংলাদেশ’-এর সদস্য, কোয়ালিটি এসুরেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্টে অনার্সসহ স্নাতক (অন্টারিও), ও সমাজ হৈতষী কর্মী।