শারমীন শরীফ : পদ্মা রানী সরকার ১৯৫৪ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ভৈরবে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতাঁর নাম সুরেন্দ্র চন্দ্র সরকার, তিনি পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতাঁর নাম সুভাষিণী সরকার। পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লা জেলার ম্যরাদনগর থানার কামাল্লা গ্রামে হলেও তাঁর পিতা ব্যবসা করতেন, তাই পিতাঁর ব্যাবসায়ের সূত্রে ছোটবেলার সপরিবারে কুমিল্লা ছেড়ে ভৈরবে চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি বড় হন।
পদ্মা ভৈরবপুর মডেল স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন এবং ১৯৬৯ সালে ভৈরব গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হাজী আসমত আলী কলেজে প্রথম বর্ষে পড়াকালে নার্স নিয়োগ প্রসঙ্গে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। সেই বিজ্ঞাপন দেখে পদ্মা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ছয়/সাত মাস তিনি নার্সিং প্রশিক্ষন নেন। কিন্তু হোস্টেলের পরিবেশ বিশেষ করে হোস্টেল সুপারের ব্যাবহার ভাল না হওয়ায় কারণে পদ্মা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান এবং সেখান থেকে কলেজে যাতায়াত করতে থাকেন। ইতিমধ্যে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে তিনি সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে অংশগ্রহণ করেন। তখন মেয়েদের জন্য একটি মাত্র পদ ছিল, কমনরুম সম্পাদিকা। তিনি সেই পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। তিনি সেই পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি ভৈরবেই ছিলেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে ভৈরবে পাকবাহিনী প্রথম আক্রমণ করলে তিনি মা, বাবা ও ছোটভাইকে সাথে নিয়ে কুমিল্লার দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে ভৈরব ত্যাগ করেন। তাঁর বড়বোনের স্বামী রশিদ মিয়া ভৈরব আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তাঁর বোন, স্বামী এবং অপর ছোটভাইকে সাথে নিয়ে আলাদাভাবে নিরাপদ আশ্রয়ের লক্ষ্যে ভৈরব ছেড়ে গ্রামে চলে যান।
পালানোর তাঁরা যে লঞ্চে উঠেছিলেন সেটা নবীনগর হয়ে কুমিল্লা যাবার কথা, হঠাৎ লালপুর চরে সেটা আটকা পড়ে যায়। ওই চরটায় ছিল চোর-ডাকাতের আড্ডা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরা বেশ কয়েকটি হিন্দু পরিবার নৌকায় করে নারায়ণপুরে তাঁর খালার বাড়িতে যান। খালার বাড়িতে একদিন থাকার পরে প্রায় সতেরো মাইল হেঁটে তাঁরা নিজের বাড়িতে পৌঁছান। মে মাস পুরোটাই তাঁরা গ্রামে ছিলেন। এ-সময়ে তিনি দেখেছেন গ্রামে রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজনের নৃশংসতা। হঠাৎ পাকবাহিনী আক্রমণ শুরু করলে তাঁরা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। পরদিন ভয়ে ভয়ে ফিরে এসে দেখেছিলেন তাঁদের বাড়ি লুটপাট হয়ে গিয়েছে। ঘরে কিছুই ছিল না এমনকি পরনের কাপড়টাও নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামে তখন ২ শ্রেণীর মানুষ। একদল স্বাধীনতা বিরোধী, যারা মানুষ মারছে, লুট করছে, পাক বাহিনীকে সরাসরি সয়ায়তা করছে। এরেকদল মানুষ যারা স্বাধীনিতাঁর পক্ষে তাঁরা চাঁদা তুলে চাল, ডাল সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে সয়ায়তা করছে। গ্রামে তখন রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার এত বৃদ্ধি পেলো যে, দিনের বেলায় অন্যের বাড়িতে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে, বাড়ির টিন খুলে নিচ্ছে ভয়ে কেউ বাঁধা দিচ্ছে না।
গ্রামে তখন প্রতিরাতেই কোননা কোন বাড়িতে ডাকাতি হচ্ছিল। নিরাপত্তাহীনতাঁর পাশাপাশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় পদ্মা দেশ ছাড়া সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন একজন দালাল ঠিক করে ময়লা কাপড় পড়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে নৌকায় করে সোনামুড়া বর্ডার পার হয়ে পুরো পরিবার নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছান।
সেখানে পৌঁছে দেশের জন্য কিছু করার চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠেন পর্দা। লোক খুঁজতে থাকেন এবং প্রতিদিন সকালে মন তলাথেকে আগরতলা শহরে চলে আসতেন। সারাদিন আগরতলা শহরে বিভিন্ন জনের সাথে দেখা করে দেশের খবরা খবর নিয়ে আবার বিকেলে মনতলা চলে যেতেন। এভাবে একদিন সাক্ষাৎ ঘটে তৎকালীন এমপি হাজী হাশেমের সাথে। এরপর দেখা হয় আওয়ামীলীগ নেতা জিল্লুর রহমানের সাথে। জিল্লুর রহমানী একদিন পদ্মাকে পাঠান কৃষ্ণনগরে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে। ওখানে গিয়ে পদ্মার সাথে দেখা হয় নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা সাহেবের সাথে এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখনো সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ জুন মাসের শেষের দিকে জয়বাংলা অফিস থেকে খবর এলো ডাক্তার আখতাঁর আহমেদ এর উদ্যোগে দারোগাটিলাতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং সেখানে মুক্তি যোদ্ধাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। কয়েকজন মেয়ে দরকার নার্স হিসেবে। ডাক্তার ডালিয়া আহমেদ এবং আর্মির দুই একজন হাবিলদার মিলে সেই হাসপাতালে কাজ করতে শুরু করেন। আগেই কয়েক মাসের নার্সিং প্রশিক্ষণ থাকায় পদ্মা সেই হাসপাতালে নার্সিংয়ে যোগ দেন।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডাঃ সালাউদ্দিন, ডাঃ আখতার আহমেদ ও ডাঃ নাজিম উদ্দিনসহ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার লক্ষ্যে দারোগাটিলা হাসপাতালকে ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নাম দিয়ে বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তরিত করা হয়। পদ্মা বাংলাদেশ হাসপাতালে দেশে স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কাজ করেন। হাসপাতালে কাজ করার সময় সেখানে একদিন একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা আসে। সে মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্কারে ছিল, পাশেই শেল পড়াতে সেই মুক্তিযোদ্ধা মুখ, কান, গলা সব বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে কথা বলা একদমই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পর্দা দিনরাত চেষ্টা করে এমনকি অবসর সময়েও তাকে কথা বলাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। পদ্মার একান্ত সেবায় মুক্তিযোদ্ধাটি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে শুরু করে।
আরো এক দিনের ঘটনা, কুমিল্লার এক কৃষক পরিবারের ছেলে নাম মালেক। সরাসরি যুদ্ধের সে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি কে গুলি করে মারার পর হাতের ছুরি দিয়ে তাদের গলা কেটে মাথা হাতে নিয়ে এসে পাগল হয়ে যায়। সেই ছেলেকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। পদ্মার অপরিসীম স্নেহ মমতায় কয়েকদিনের মধ্যেই মালেক সুস্থ হয়ে ওঠে এবং আবার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যায়। পদ্মা যখন বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে কাজ করতেন তখন তাঁর পরিবারকে বিশ্রামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ফ্যামিলি ক্যাম্পে এনে রাখেন। যাদের ছেলে-মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে একমাত্র সেসব পরিবারকে ফ্যামিলি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হতো।
দেশের স্বাধীন হলে ২৫ ডিসেম্বর তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারি তিনি এ. জেড. এম. সাদিকুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পদ্মার স্বামী ও একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি তৎকালীন হাবিব ব্যাংকের নোয়াখালী বসুরহাট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর রহমান ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন এবং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পদ্মার সার্বক্ষণিক সাথে ছিলেন তাঁর খালাতো বোন কল্পনা। হাসপাতালে পদ্মার সাথে আরো যে কয়েকজন নারী কাজ করেছেন তাদের মধ্যে লুলু, টুলু, আসমা, রেশমা, জাকিয়া, খুকু, অনুপমা, নীলিমা, বাসনা, আলো ও মধুমিতাঁর নাম তাঁর মনে আছে। শেষ দিকে গোবরা ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গীতা কর ও ইরা কর বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৭২ থেকে তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধার সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি প্রাইভেটে ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭৫ সালে কুমিল্লার চৌওারা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
পদ্মা রানী সরকার সাদিকুর রহমানকে বিয়ে করার পর পদ্মা রহমান নামে পরিচিত হন। তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বর্তমানে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে আছেন। এছাড়াও তিনি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।