হাসান গোর্কি : “আজ এই বসন্তের রাতে
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;
অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।”
(পাখিরা, ধূসর পাণ্ডুলিপি, জীবনানন্দ দাশ)

সিদ্ধার্থ ঋষিন: প্রকৃতির কী ভাষা আছে?
সঞ্জিব পুরোহিত: প্রথমত বিষয়টা নির্ভর করবে ভাষা বলতে আমরা কী বুঝবো তার ওপর।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: সেটা হতে পারে যে কোনো ধরণের বাঙময়তা অর্থাৎ উচ্চারিত অর্থপূর্ণ শব্দ বা ইঙ্গিত।
সঞ্জিব পুরোহিত: এই সংজ্ঞা প্রাণির ক্ষেত্রে সত্য। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও আংশিক সত্য। অপ্রাণিবাচক কোনকিছুর জন্য সত্য নয়। আমরা যদি প্রকৃতির ভাষার সংজ্ঞা পেতে চাই তাহলে এমন কণা বা তরঙ্গের বিচ্ছুরণকেও ভাষার অংশ বলতে হবে যা গ্রাহক (রিসিভার)-এর কাছে বার্তা বহন করে। আপনি নিশ্চয়-ই পাহাড়-সমুদ্রকে বাদ দিয়ে প্রকৃতির ভাষা আছে কিনা জানতে চাননি!

সিদ্ধার্থ ঋষিন: সব প্রাণির ভাষা আছে সেটা বুঝতে পারা কঠিন নয়। পিঁপড়া, হাতি, মৌমাছি এমনকি অণুজীবরাও দলবদ্ধ সিদ্ধান্তে জীবন চালায়। এ’কাজে যে প্রক্রিয়াতে-ই হোক তাদের সফলভাবে বার্তা বিনিময়ের দরকার হয়। দ্য ভয়েস অব নেচার (এক) থেকে অর্জিত অনুধাবনের ফলে এটাও মোটামুটি বিশ্বাস করছি যে বৃক্ষরাও বার্তা বিনিময় করে অর্থাৎ তাদের ভাষা আছে। আমি আসলে বুঝতে চাই সূর্য কথা বলে কিনা, সমুদ্রের গানের কোনো অর্থ আছে কিনা, পৌষের কুয়াশায় বিচ্ছুরিত চাঁদের আলোর রহস্যমতায় মানব জাতির জন্য নিগূঢ় কোনো তত্ত¡ আছে কিনা! অন্ধকার, আকাশের নীলিমা, উড্ডীন শুভ্র মেঘমালা, সোনালী শস্যের মাঠ, বিরান মরুভ‚মি নিজেদের মধ্যে বা আমাদের সাথে কথা বলে কিনা!
সঞ্জিব পুরোহিত: তারা যে কথা বলে না সেটা আমরা জানি। আপনি হয়তো প্রতীকী অর্থে এ’রকম বলছেন। তবে আমরা যদি উপরে স্বীকার করা সংজ্ঞায় ফিরে যাই তাহলে এটা ধারণা করা অসঙ্গত হবে না যে প্রকৃতিরও নিজস্ব ভাষা আছে। আমরা জানি, মৌলিক পদার্থের পরমাণুতে ঐ মৌলটির সমস্ত ধর্ম উপস্থিত থাকে। সমস্ত কঠিন ও তরল পদার্থ এবং গ্যাস ও আয়ন-এর গঠনের মূলে রয়েছে নিস্তরিত বা আধানগ্রস্ত পরমাণু। সরল ও পূর্ণসংখ্যক অনুপাতে বিভিন্ন পদার্থের পরমাণু সংযুক্ত হয়ে রাসায়নিক যৌগের সৃষ্টি করে। রাসায়নিক বিক্রয়াসমূহে পরমাণু সংযোজিত, বিভক্ত বা পুনর্বিন্যাসিত হয়। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, ফোটন, গ্রাভিটন, কোয়ার্ক মেসনসহ শতাধিক অতি পারমাণবিক কণা দিয়ে একটা পরমাণু গঠিত। এদের মধ্যে পারস্পরিকতা আছে বলেই একটা সংগঠন হিসেবে টিকে আছে। প্রকৃতিও এ’রকম একটা সংগঠন।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: পারস্পরিকতা বলতে আপনি হয়তো ইন্টারডিপেন্ডেন্স বুঝিয়েছেন। পরস্পর নির্ভরশীলতা থাকার অর্থ এটা নয় যে তাদের বার্তা বিনিময় করেই এটা করতে হবে। ধরুন, আপনি একটা ছাগলের খামার করলেন। খামারটি ৫ ফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। বন্দী দশা থেকে মুক্তির জন্য ছাগলরা বারবার দেওয়ালের কাছে গিয়ে ফিরে আসে। এখানে পারস্পরিকতা আছে। দেওয়ালের কাছে তারা বার্তাও পাচ্ছে। কিন্তু বার্তাটি দেওয়াল সচেতনভাবে দিচ্ছে না। অন্য একটা উদাহরণ দেখুন- ধরুন, ভুমিকম্পে একটা পাহাড়ি নদীতে পাথর পড়ে প্রাকৃতিক বাঁধের সৃষ্টি হলো এবং স্রোত বন্ধ হয়ে গেলো। জলধারা জমা হতে হতে এক সময় পাথর ডিঙিয়ে চলতে শুরু করলো। আপাত দৃষ্টিতে জল-পাহাড়ের এই দ্বৈরথে কেউ কাউকে বার্তা দিচ্ছে না। কিন্তু এখানে পারস্পরিকতা আছে।
সঞ্জিব পুরোহিত: আমরা যেভাবে কথা বলি, বার্তা বলতে আপনি সে’রকম কিছুই বুঝালেন। শুরুতে কণা বা তরঙ্গের বিচ্ছুরণকেও ভাষার অংশ হিসেবে আমরা স্বীকার করে নিয়েছিলাম। একই পরমাণুতে বসবাসকারী দুটি সাব-এটমিক পার্টিকেলকে বের করে নিয়ে আমরা যদি বিশাল দূরত্বে তাদের রেখে আসি তাহলেও তাদের জোড়া ভাঙবে না। ধরুন, পরমাণুর মধ্যে ‘ক’ পার্টিকেলের আপ স্পিন এবং ‘খ’ পার্টিকেলের ডাউন স্পিন ছিলো। আপনি যদি ‘ক’-র মাথা নিচু করে দেন তাহলে ‘খ’ বিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরে বসেও সাথে সাথে নিজের থেকেই তার মাথা উঁচু করে ফেলবে। কোনো বার্তা না পৌঁছালে এ’রকম হবার কথা নয়।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনার খামারের দেওয়াল বা পাথরের বাঁধ যে যথাক্রমে ছাগল ও জলধারাকে বার্তা দিচ্ছে না সেটা আমি বলিনি। আমি বলেছি এই বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেওয়াল ও ভেঙে পড়া প্রস্তর স্তুপের চৈতন্য নেই। তারা এটা ইচ্ছা করে করছে না। অতি পারমাণবিক স্তরে পদার্থের ভৌত কাঠামো থাকে না। সেখানে তরঙ্গ ও ভাব সমার্থক। একটা পরমাণুর ভেতরে বিশাল অংশ ফাঁকা। আমরা যদি পরমাণুর সব উপাদানকে চাপ দিয়ে এক বিন্দুতে সংকুচিত করে ফেলি তাহলে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের আকৃতি হবে একটা মটর দানার সমান। আর এই বিল্ডিংটাকে যদি সাব-এটমিক পার্টিকেলের সমাহার ধরি (বাস্তবেও তা-ই) তাহলে তা তরঙ্গ ছাড়া আর কিছু নয়। সেক্ষেত্রে তাকে ভাব, চৈতন্য বা কারণের অবভাস হিসেবে মানতে হয়। এভাবে আলোচনা করলে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না। ভৌত জগতকে আমরা যেভাবে দেখি সেভাবে সত্য ধরে নিয়ে বলুন অপ্রাণিবাচক বস্তুর কোনো ভাষা আছে কিনা।
সঞ্জিব পুরোহিত: উদ্ভিদের পাতা সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি, বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও শেকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শর্করা জাতীয় খাদ্যের সংশ্লেষ ঘটায়। এ’সময় উপজাত হিসেবে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়। এখানে যে ধরণের পারস্পরিকতা আছে তা যে বার্তা নয় তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: হ্যাঁ, এই পারস্পরিকতাকে আমরা বার্তা হিসেবে ধরে নিতে পারতাম যদি তা এক পাক্ষিক না হতো। বৃক্ষের পাতা যদি আলো চেয়ে সূর্যের কাছে বার্তা পাঠাতে পারতো তখন নিশ্চিত হবার সুযোগ ছিলো যে ফোটন কণাও সূর্য থেকে বার্তা নিয়ে আসে। আর ফোটন কণা যদি কোনো বার্তা নিয়ে আসে তা হতে হবে অন্ধ। প্রকৃতির যদি কোনো চৈতন্য থেকে থাকে তা-ও হতে হবে অন্ধ।
সঞ্জিব পুরোহিত: আমি খুব-ই একমত। চৈতন্য অন্ধ হয়ে থাকলে তা যে সচেতন চৈতন্যের চেয়ে কম বুদ্ধিমান হবে তা আমরা ধরে নিতে পারি না। দু’টি ভিন্ন জিনিস। আমাদের শরীরের কোষ আমাদের গঠন, বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ ও বংশগতিমূলক তথ্য বহন করে। কোষকেন্দ্র (নিউক্লিয়াস), কোষপঙ্ক (সাইটোপ্লাজম) এবং কোষঝিল্লি বা কোষপ্রাচীর নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে। ডিএনএ অণুর একেকটি অংশ একেকটি বংশগতীয় বৈশিষ্ট্য বহন করে। সে’কারণে এই অংশগুলিকে আমরা বংশাণু (জিন) বলে জানি। জিন-ই কোষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষ কোন্? ধরনের দেহসার বা প্রোটিন তৈরি বা সংশ্লেষণ করবে, তা নির্ধারণ করে। প্রোটিন উৎপাদন করার নির্দেশগুলি কোষকেন্দ্রের বাইরে কোষপঙ্কতে পরিবাহিত হয়। ঐ নির্দেশ মেনে রাইবোজোম তার কাঠামোতে প্রোটিন উৎপাদন বা সংশ্লেষ করে। আপনি যে সচেতন চৈতন্যের কথা বললেন তার চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বুদ্ধি ধারণ করে আমাদের এক একটি দেহ কোষ। মানবদেহে প্রায় ৩৭ লক্ষ কোটি কোষ আছে। তারা প্রত্যেকে অন্যের সাথে বার্তা বিনিময় করে। আমরা লগি দিয়ে গাছ থেকে আম পাড়তে পারি, গাড়ি চালাতে পারি, কবিতা লিখতে পারি, মঙ্গল গ্রহে যাবার উপযোগী যান তৈরি করতে পারি। এবার তুলনা করে দেখুন কোন্? চৈতন্য বেশি শক্তিশালী।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমি চাচ্ছিলাম, আপনি নিজের থেকেই এমন একটা উদাহরণ দিন যাতে আমি পার্থক্যটা মোটা দাগে হলেও স্পষ্ট করে দেখাতে পারি। আপনি সেই কাজটি-ই করেছেন। আপনি একটা জৈব যৌগের উদাহরণ দিলেন সংজ্ঞা অনুযায়ী যা জীবন্ত। একটা ধূলিকণা ও একটা প্রাণি কোষ বা উদ্ভিদ কোষকে আমরা এক করে দেখতে পারি না। ধূলিকণার তরঙ্গ বিচ্ছুরণ যদি অন্যদের জন্য কোনো বার্তা বহন করেও থাকে তাহলেও তাকে ভাষা বলা যাবে না, কারণ তা মিথষ্ক্রিয় (interactive) নয়। কিন্তু কোষের অঙ্গগুলি আলাদাভাবে আপাত চৈতন্যশূন্য হলেও তারা বার্তা গ্রহণ ও প্রেরণ করতে পারে। আসুন আমরা এই ভিডিয়োটি দেখে নিই। এখানে দেখুন কোষের প্রত্যেকটি অংশ কেমন জীবন্ত প্রাণের মতো আচরণ করছে: (https://www.youtube.com/watch?v=URUJD5NEXC8)।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি একটা সংগঠনে গিয়ে আটকে আছেন। এর আগে ও পরে না গেলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে না। কোষ ও ধূলিকণা— উভয়-ই কিছু পদার্থের অণু দিয়ে গঠিত। আপনার সংজ্ঞা অনুযায়ী অণুগুলি মৃত। এই ‘মৃত’ অণুগুলি যখন জৈব রূপ নিচ্ছে এবং প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তখন তাদের চৈতন্যকে আমরা বাঙময় মনে করছি। এর কারণ হলো, আমরা নিজেরাও একটা জৈব সংগঠন। ফলে এই সমরূপ আচরণকে-ই আমাদের কাছে বাঙময়তা মনে হচ্ছে। আপনি পাপুয়া নিউগিনির কোনো প্রত্যন্ত দ্বীপে গেলে সেখানকার অধিবাসীদের ভাষা বুঝবেন না। কিন্তু আকস্মিকভাবে কোনো বাঙালির সাথে দেখা হয়ে গেলে তার ভাষাকে আপনার কাছে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম বলে মনে হবে। ধূলিকণার ভাষা বুঝতে গেলে আপনাকেও ধূলিকণা হতে হবে। আপনি জানেন, গণিতবিদ জোসেফ ফার্গুসন, দার্শনিক বারুচ স্পিনোজা এবং জ্যোতির্বিদ জর্দানো ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, “পদার্থ নিজে এবং নিজের মধ্যে সত্তাবান। এদের বৃহত্তর অন্বয়, অনুবর্তিতা ও মিথস্ক্রিয়া-ই চৈতন্য” (Encyclopedia of Philosophy ed. Paul Edwards| New York: Macmillan and Free Press,, পৃষ্ঠা-৩৪)। আমাদের শ্রুতি সীমার বাইরে শব্দ আছে, দৃষ্টি সীমার বাইরের আলোক উৎস আছে, ঘ্রাণ শক্তির বাইরে ঘ্রাণ আছে। তার অর্থ এটা নয় যে এই শব্দ, বর্ণ বা গন্ধের অস্তিত্ব নেই। খণ্ডিত করে দেখলে প্রকৃতির চৈতন্যকে মৃত মনে হবে। আমরা কোষের মিথস্ক্রিয়া দেখলাম। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী পরমাণুগুলোর আচরণ দেখলেও আমাদের একই অনুভ‚তি হতে পারে। তাই কে জীবন্ত আর কে মৃত তা এক কথায় বলে দেওয়া যাবে না। এই ভিডিয়োটি এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে: https://www.youtube.com/watch?v=TStjgUmL1RQ

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল প্রকৃতির ভাষা নিয়ে। আপনার চাপিয়ে দেওয়া ধারণা মেনে এক পাক্ষিক চৈতন্যপ্রবাহকে ভাষা মানতেও আমার আপত্তি নেই। আমি বলতে চাই বার্তার প্রেরক ও গ্রাহকের সচেতন অবহিতি ছাড়া কোনো তথ্যের বিনিময় হলে তাকে আমরা ‘বার্তা বিনিময়’ বলতে পারি না। দু’টি পাথর ঠোকাঠুকি করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে তাতে পরস্পরের জন্য কোনো বার্তা থাকে না। প্রকৃতিতে যদি কোনো মিথিস্ক্রিয় চৈতন্যপ্রবাহ থেকে থাকে তাহলে তাকে অবশ্য-ই অনৈচ্ছিক ও অন্ধ হতে হবে।
সঞ্জিব পুরোহিত: প্রকৃতি সচেতন সত্তা কিনা, আর সেটা হয়ে থাকলে তার সচেতনতার স্তর কী সে বিষয়ে বিজ্ঞান এখনও তেমন কিছু জানে না। দর্শন শাস্ত্রের কোনো কোনো শাখায় প্রকৃতিকে সচেতন সত্তা মনে করা হয়। তাই ‘মিথিস্ক্রিয় চৈতন্যপ্রবাহ’কে ‘অনৈচ্ছিক ও অন্ধ’ হতে-ই হবে এরকম রায় দিয়ে ফেলা ঠিক নয়। এক পাক্ষিক বার্তাকে আপনি ভাষা বলতে চাচ্ছেন না। ধরুন, আমার পরিবারের এক সদস্য বোবা। আমরা কি বলবো, সে ভাষাহীন?

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনার প্রশ্ন শুনে হতাশ হলাম। বোবা ব্যক্তি শব্দ উচ্চারণ করতে না পারলেও এমন সব ইঙ্গিত দিতে ও কাজ করতে পারে এবং প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে যা ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হতে বাধা নেই।
সঞ্জিব পুরোহিত: প্রকৃতিও এমন সব ইঙ্গিত দিতে ও কাজ করতে পারে এবং প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে যা ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হতে বাধা থাকার কথা নয়। স্পিনোজার কথা স্মরণ করুন। তিনি মনে করেছেন, বস্তু আর বস্তুর ‘ধারণা’র মধ্যে একটা পার্থক্য হচ্ছে, একটি বাস্তব এবং এর ভৌত অস্তিত্ব আছে। অন্যটি হলো চৈতন্য যার ভৌত অস্তিত্ত¡ নেই। তিনি ধারণা ও অস্তিত্বকে সবকিছুর অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনে করেছেন। তাঁর মতে এই ‘চিন্তা’ এবং ‘বাস্তবতা’ (‘ভৌততা’ অর্থে) দুইটি আলাদা সাবস্টেন্স নয়; বরং একটি একক, অসীম, অবিভাজ্য সাবস্টেন্সের দুইটি গুণ। আপনি জানেন সাবস্টেন্স বলতে স্পিনোজা সারবস্তু বুঝিয়েছেন।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমাদের আলোচনায় মহাবিশ্বকে ‘সাবস্টেন্স’ ভাবার দর্শন কীভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে তা আমি বুঝিনি। বস্তু জগৎ স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তর্গতভাবে সত্য ও অনির্ভরশীলভাবে অস্তিত্বে থেকে থাকলে তার সম্মিলিত চৈতন্য (Cumulative Consciousness) অন্ধ হতে বাধ্য। অন্ততপক্ষে তা বুদ্ধিমান হতে পারবে না। সেক্ষেত্রে প্রাণি (বা উদ্ভিদেরও) বুদ্ধির ব্যাখ্যা থাকে না।
সঞ্জিব পুরোহিত: নেগেটিভ ও পজিটিভ এনার্জিকে হিসেবে নিলে মহাজগতে মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য। তাই আমরা বলতে পারি, মহাজগতের সম্মিলিত চৈতন্যের যোগফলও শূন্য। এটা বলা অনুচিত হবে যে তাকে অন্ধ হতেই হবে। মহাবিশ্ব ‘সাবস্টেন্স’ হলে তা বুদ্ধিমান বা অন্ধ, যা-ই হোক তাতে কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। সে’ক্ষেত্রে তা হবে স্বয়ম্ভূ, অন্তর্গতভাবে সুসম, পারস্পরিক ও ব্যাখাতীত ধরণের সচেতন— কিছুটা প্রাণি বা উদ্ভিদের কোষের মতো বা জৈব-অজৈব অণুর মতো। প্রাণি বা উদ্ভিদের বুদ্ধিকে আমরা একটা অজৈব অণুর বুদ্ধির চেয়ে উন্নত মনে করছি এ’কারণে যে আমরা তাদের ভাষা পড়তে পারি না। ধ্যান মগ্নতার এক বিশেষ মুহূর্তে মুনি ঋষিরা তাদের দেহের বাইরে চলে আসেন বলে দাবি করেন। এমন হতে পারে যে তাদের দেহজ অস্তিত্ব যে ফোর্স ফিল্ড তৈরি করতে পারে তার ভরকেন্দ্র দেহের বাইরে চলে আসে, যেভাবে সৌর জগতের গ্রহগুলির এক পার্শ্বিক অবস্থানের কারণে এর বেরি সেন্টার প্রায়-ই সূর্যের বাইরে চলে আসে। বিষয়টা এ’রকম হলে তাদের সে’সময়ের চৈতন্যকে কি আমরা বোবা বলবো?

সিদ্ধার্থ ঋষিন: না। সেটা বোবা বা অন্ধ নয়। কারণ, তখন তারা প্রাণ-অপ্রাণ নির্বিশেষে সকলের/সব কিছুর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। কিন্তু প্রকৃতির ভাষা বোঝার জন্য আমাদের এ’রকম একটা অপ্রমানিত প্রস্তাবনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে কেনো!
সঞ্জিব পুরোহিত: আমার মনে হয় শুরু থেকে-ই আলোচনটাকে আমরা বহু নির্বাচনী প্রশ্ন বা ‘হ্যাঁ’-‘না’-র উত্তর খোঁজার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিলাম। বিষয়টা এভাবে দেখা যাক— ধরা যাক বন্য প্রাণি, পাখি, পতঙ্গ, অণুজীব, লতা, গুল্ম, বিটপ, বৃক্ষে পূর্ণ একটা নিরক্ষীয় বন। সেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সারা বছর সেখানে সূর্যের আলোর প্রাচুর্য থাকে। কাছের সাগর থেকে বয়ে আসা আর্দ্র বিমল বায়ু প্রবাহ থাকে। পাখিরা বুনো ফল খায়, মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে, তৃণভোজী প্রাণিদের খাবারের উপযোগী লতা- গুল্ম- ঘাস আছে সেখানে। পানি পান করার জন্য জলাশয় আছে। সেখানে ব্যাকটেরিয়া থেকে ডাইনোসর (কল্পনা করতে দোষ কী! ) পর্যন্ত সবার জন্য বাস্তু সংস্থান আছে। এখানে প্রাণিদের ভাষা নিয়ে আমাদের সন্দেহ নেই। উদ্ভিদের ভাষার বিষয়টাও কিছুটা তর্ক সাপেক্ষে আমরা মেনে নিয়েছি। জলাশয়, সূর্যালোক, মৃত্তিকা ও বায়ুর ভাষা নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। এবার আপনি ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার দিকে তাকান। যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছেন তাকেও মৃত ভাবুন; কিন্তু এতটুকু মেনে নিন যে, যে প্রতিফলক আপনার প্রতিকৃতি তৈরি করেছে সে মৃত হলেও আপনার বার্তার উত্তর দিয়েছে। সূর্যালোক পত্র পল্লবের কাছে ফোটন কণার মাধ্যমে প্রেরিত বার্তার জবাব পায় কিনা, দখিণা সমীর শিরিষের মগডালে ঔদাস্যভরে বসে থাকা ঘুঘুর পালক ছুঁয়ে গেলে প্রতি বার্তা পায় কিনা বা একটা তৃষ্ণার্ত হরিণ শাবক জল পান করার পর জলাশয় কী বার্তা পায় সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এতটুকু আন্দাজ করতে পারি যে প্রকৃতির এই সবগুলো সদস্য/উপাদানের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ও গতিময় পারস্পরিকতা আছে। এটাকে প্রকৃতির ভাষা বলতে বাধা দেখি না।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।