অনলাইন ডেস্ক : বাবার মতোই একই নজির গড়লেন কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। জাস্টিন ট্রুডো যেমন প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ই স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন তেমনই তাঁর বাবাও পিয়ের এলিয়ট ট্রুডো কানাডার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তাঁর মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পারিবারিক জীবন নিয়ে বাবার পথেই হাঁটলেন তিনি।
গত ২ আগস্ট, মঙ্গলবার রাত ১২টার পরপরই ১৮ বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং তার স্ত্রী সোফি গ্রেগরি। উল্লেখ্য, ক্ষমতায় থাকাকালীন বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পিয়ের এলিয়ট ট্রুডো। ১৯৭১ সালে বিয়ের পর ১৯৭৯ সালে পিয়ের ট্রুডো এবং মার্গারিট ট্রুডো আলাদা থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে ১৯৮৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়।
পিয়ের ট্রুডো কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৮ সাল এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। ২০০০ সালে মারা যান তিনি। জাস্টিন ট্রুডোসহ তাঁর মোট পাঁচ সন্তান।
জাস্টিন ট্রুডো কানাডার দ্বিতীয়জন যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিয়ে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন। ইনস্টাগ্রামে ৫৩ বছর বয়সী জাস্টিন ট্রæডো ও ৪৮ বছরের সোফি গ্রেগরি দুজনেই একই ঘোষণা দিয়েছেন।
‘অর্থবহ এবং কঠিন আলাপ-আলোচনার’ পর তাঁরা এই ঘোষণা দিয়েছেন জানিয়ে ইন্সটগ্রামে বলেন, তাঁরা ‘একটি ঘনিষ্ঠ পরিবারের মতো থাকবেন, যার ভিত্তি হবে ভালোবাসা ও সম্মান’।
ট্রুডো ও সোফি ২০০৫ সালে মন্ট্রিয়লে বিয়ে করেন এবং বর্তমানে তাঁদের তিন সন্তান রয়েছে।
১৮ বছরের সংসার জীবন জাস্টিন ট্রুডো ও সোফি গ্রেগরির দম্পতির। তিন সন্তানের মা-বাবা তাঁরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই দম্পতি বেশ সুপরিচিত। হঠাৎ করেই তাঁদের বিচ্ছেদের ঘোষণায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কেন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও সোফি গ্রেগরি দম্পতি।
জনপ্রিয় এই জুটির দাম্পত্য জীবন নিয়ে পেছন ফিরে দেখলে আমরা দেখি,
ট্রুডোর বিয়ে নিয়ে কয়েক বছর ধরেই অটোয়াতে নানা গুঞ্জন শোনা গেলেও তাদের ব্যক্তিগত বিরোধ কখনো খবরের শিরোনাম হয়নি। সোফি গ্রেগরি ট্রুডোর সাথে তাঁর প্রথম প্রেমময় সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘ডিনার শেষে সে (ট্রুডো) আমাকে বলেছিল, আমার বয়স এখন ৩১ বছর এবং আমি এই ৩১ বছর শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।’
কানাডার সবচেয়ে পরিচিত মুখ, পাওয়ার কাপল হিসেবে বিবেচিত এই জুটির বিচ্ছেদ এই মুহূর্তে দেশটির সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী পুত্র, আর কুইবেকের এক লাবণ্যময়ী উপস্থাপক; উদীয়মান দুই কানাডিয়ান তারকার যে বন্ধনকে এক সময় গল্পের বই থেকে উঠে আসা সুন্দর কোনো গল্প বলে আখ্যা দেওয়া হতো।
২ আগস্ট, মঙ্গলবার রাত ১২টার পরপরই জাস্টিন ট্রুডো এবং গ্রেগরি ট্রুডো, দুজনের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে আলাদা আলাদাভাবে ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় ওই পোস্টে তাঁরা বলেছেন, ‘সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে আমাদের মধ্যে অনেকভাবেই আলোচনা হয়েছিল। যা ছিল অর্থবহ এবং জটিল।’ জাস্টিন ট্রুডো ও সোফি ২০০৫ সালে বিয়ে করেন এবং তাঁদের সংসারে জাভিয়ের (১৫), এলা-গ্রেস (১৪) এবং আদ্রিয়েন (৯) নামের তিন সন্তান রয়েছে।
‘অন্য সব সময়ের মতোই, আমরা একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাসহ এবং যা কিছু আমরা একসাথে গড়েছি ও গড়বো, সেই সবের জন্যও একটি ঘনিষ্ঠ পরিবারের মতো থাকব। আমাদের সন্তানদের কল্যাণের জন্য আমরা আমাদের এবং তাদের গোপনীয়তা বজায় রাখার অনুরোধ করছি আপনাদের’। ট্রুডোর সঙ্গে সোফির কেন বিচ্ছেদ হলো, তার কারণ স্পষ্টভাবে এখনো কিছু জানা যায়নি। হয়তো কখনোই জানা যাবে না।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া আলাদা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী সপ্তাহে ট্রুডো পরিবার একসঙ্গে ছুটি কাটাতে যাবে। তাঁরা জানায়, ট্রুডো ও সোফি দুজনেই বিচ্ছেদের জন্য আইনিভাবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।
কার্যালয় থেকে আরও জানানো হয়, ‘তারা ঘনিষ্ঠ পরিবারের মতোই থাকবে, আর সোফি এবং প্রধানমন্ত্রী তাদের সন্তানদের একটা নিরাপদ, স্নেহময় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বড় করার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। সন্তানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনেরই সক্রিয় উপস্থিতি থাকবে এবং কানাডিয়ানরা প্রায়ই তাদের পুরো পরিবারকে একসঙ্গে দেখতে পাবেন।’
ট্রুডোর সন্তানরা অটোয়াতে রিদু হল গ্রাউন্ডে রিদু কটেজেই বসবাস করবেন। তবে সোফি শহরের অন্য কোথাও আলাদা বাড়িতে থাকা শুরু করবেন বলে জানা গেছে, তবে রিদু কটেজেও তাঁর আসা-যাওয়া থাকবে।
এ দিকে, বিচ্ছেদের খবরে ট্রুডো পরিবারের শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই ব্যথিত হয়ে সহানুভ‚তি জানিয়েছেন। অনেকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ব্যক্তিগত জীবনের বোঝাপড়া ট্রুডোর রাজনৈতিক জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রীর জননিরাপত্তা মন্ত্রী ডমিনিক লেবø্যাঙ্ক এমপিদের আশ্বাস করে জানিয়েছেন, ট্রুডো ভালো আছেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে হৈ চৈ তৈরির কিছু নেই।
গত জুলাই থেকেই প্রধান প্রধান পাবলিক ইভেন্টগুলোতে অনুপস্থিত ছিলেন সোফি। এমনকি রিদু হলে অতি স¤প্রতি মন্ত্রী পরিষদের ব্যাপক রদবদল অনুষ্ঠানে এবং লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে সামরিক জোটের শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটোর নেতা ও তাদের স্ত্রীদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারেও অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।
ট্রূডো ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে যে মনোমালিন্য চলছে তা গণমাধ্যমেও তেমন টের পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র ২০১৫ সালে সাংবাদিক লরা স্টোনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলেছিলেন- যখন সিবিসি’র সাক্ষাৎকারে ট্রæডোর স্মৃতিচারণ নিয়ে সোফিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ট্রুডোকে পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং ট্রুডো তা অস্বীকার করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ সোফির কাছে তুলতেই তিনি হেসেছিলেন যে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন এখন সবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। ঐ সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে এটুকু বলতে পারি যে বিয়ে খুব সহজ জিনিস নয়। আমরাও যে কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেটা নিয়ে আমি এক রকম গর্বিতই বলা যায়, হ্যাঁ, কারণ আমরা অকৃত্রিমতা চাই। আমরা দুজনেই স্বপ্নচারী এবং আমরা যতদিন সম্ভব একসঙ্গে থাকতে চাই।’
তবে কানাডিয়ানরাও নিয়মিতই ট্রুডো-সোফির প্রেমের সব খবর রেখেছেন। ট্রুডো ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর সোফিকে প্রস্তাব দেন এবং সেদিন ছিল তার বাবার ৮৫তম জন্মদিন। ওই দিনের কথা স্মরণ করে এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে ট্রুডো বলেছিলেন, ‘শ্যাম্পেন আর ওয়েস্টার ছিল খাবারের তালিকায়। আর আমি হাঁটু গেঁড়ে বসে তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম।’ ট্রুডো-সোফির বিয়ের খবর দেশটির গণমাধ্যমের প্রথম পাতা জুড়ে ছিল। ২০০৫ সালের মে মাসে তাঁরা বিয়ে করেন, যাকে ‘রূপকথার গল্পের মতো এক বিয়ে’ বলে আখ্যা দিয়েছিল শাতেলেন ম্যাগাজিন। ওই সময় ট্রুডো তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অনুমানধর্মী মন্তব্য করেছিলেন, আর সোফি বলেছিলেন, এমনটা ঘটলেও তিনি মানিয়ে নিতে পারবেন বলে তাঁর বিশ্বাস। ২০১৫ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে লিবারেল পার্টি জয়লাভ করে, পরের বছর ১৬ই এপ্রিলে ভোগ ম্যাগাজিনে উঠে আসে জাস্টিন ট্রুডোর প্রোফাইল। ওই নিবন্ধটি হয়তো খুব কম মানুষই মনে রেখেছেন, কিন্তু নিবন্ধের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ট্রুডো সোফিকে জড়িয়ে ধরা দুর্দান্ত ছবিটি নিশ্চয়ই এখনও অনেকের মনে আছে।
আলোকচিত্রী নরম্যান জিন রয় এর তোলা ছবিটির ক্যাপশনে ছিল: ‘ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগরি ট্রুডো তাঁদের প্রথম ডেটের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ডিনার শেষে সে (ট্রুডো) আমাকে বলেছিল, আমার বয়স এখন ৩১ বছর এবং আমি এই ৩১ বছর শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।” প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনের এমন একটি সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও দলের নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছার উপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। জাস্টিন ট্রæডোর বাবা, সাবেক কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো এবং মা মার্গারেটের ডিভোর্স হয়েছিল ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পিয়েরের শেষ সময়টাতে। যদিও ১৯৭৭ সাল থেকেই তারা আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন।
জাস্টিন ট্রুডো প্রায় ৮ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং তিনটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।
১৯৭৯ সালে ‘বিয়ন্ড রিজন’ নামক স্মৃতিকথায় মার্গারেট নাটকীয় ভঙ্গিতে একজন প্রধানমন্ত্রীকে বিয়ে করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন। এদিকে সোফি গ্রেগরিও নিজে বই লিখছেন। ‘ক্লোজ টুগেদার’ নামের বইটিতে তার ‘আত্ম-জ্ঞান, গ্রহণযোগ্যতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভ‚তিগুলো থাকবে। জানা গেছে, এ বইয়ে গ্রেগরি নানা প্রশ্ন করবেন যা মানুষের মানসিক শান্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। যেমন, তিনি প্রশ্ন করবেন, ‘সম্পর্ক থেকে আমরা আসলে কি চাই, আর আমরা সেখানে কি অবদান রাখতে পারি?’ আরও একটি প্রশ্ন হলো, ‘যা আমাদের জীবনে উপকারী নয়, তাকে বিদায় জানানোর উপায় কি?’ ট্রুডো-সোফির আলাদা হয়ে যাওয়ায় অনেকে যেমন মর্মাহত হয়েছেন, ঠিক তেমনি অনেকেই মনে করেন, কোন কারণে সম্পর্কে চির ধরলে সেটার সমাপ্তি ঘটানোই বুদ্ধিমানের কাজ।