ভজন সরকার : প্রপিতামহ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তিনি বিলেত থেকে চলে আসেন কলকাতায়। আর সে বছরই বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হিন্দু-মুসলিম স¤প্রীতি নিয়ে গান লিখেছেন “বাংলার মাটি বাংলার জল”। রবীন্দ্রনাথের এ গান গেয়ে তিনি বঙ্গভঙ্গ-এর বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন।
যদিও তার পরের বছরই তিনি আবার বিলেত চলে যান ব্যারিস্টারি পড়তে কিন্তু আইন পড়া বাদ দিয়ে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন পাশ্চাত্যসংগীতে ও যন্ত্রসংগীতে। ফিরেও আসেন বছরখানিকের মধ্যেই। এসেই তালিম নেন ভারতীয় উচ্চাংগসংগীতের এবং পরে রবীন্দ্রসংগীতের অবশ্যই।
রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টির নেশায় একের পর এক গান রচনা করেছেন এবং সুরও করেছেন তাৎক্ষণিকই। কিন্তু যে মানুষটি রবীন্দ্রনাথের এ সৃষ্টিকে সংরক্ষণ ক’রে অনাগত কালের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর সম্বন্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“তার (দিনেন্দ্রনাথ) চেষ্টা না থাকলে আমার গানের অধিকাংশই বিলুপ্ত হোত। কেননা নিজের রচনা সম্বন্ধে আমার বিস্মরণ শক্তি অসাধারণ। আমার সুরগুলি রক্ষা করার এবং যোগ্য এমনকি অযোগ্য অপাত্রকে সমর্পণ করা তার যেন সাধনার বিষয় ছিল। তাতে তার কোন দিন ক্লান্তি ধৈর্যচ্যুতি হতে দেখিনি”।
সম্পর্কে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাতি। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে। জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালে। ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ শ্রুতিধর ছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সুর একবার শুনেই নির্ভুলভাবে লিখে রাখতেন। ভারতীয় উচ্চাংগ সংগীত সম্বন্ধে তাঁর ছিল অগাধ পান্ডিত্য। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন সে কথা,
“দিনেন্দ্রনাথের কন্ঠে আমার গান শুনেছি, কিন্তু কোনোদিন তার নিজের গান শুনিনি। কখনো কখনো কোনো কবিতায় তাকে সুর বসাতে অনুরোধ করেছি, কথাটাকে একেবারেই অসাধ্য ব’লে সে উড়িয়ে দিয়েছে। গান নিয়ে যারা তার সঙ্গে ব্যবহার করেছে, তারা জানে সুরের জ্ঞান তার ছিল অসামান্য। আমার বিশ্বাস গান সৃষ্টি করা এবং সেটা প্রচার করার সম্বন্ধে তার কুন্ঠার কারণই ছিল তাই। পাছে তার যোগ্যতা তার আদর্শ পর্যন্ত না পৌঁছায়, বোধ করি এই ছিল তার আশঙ্কা।”
যদিও জানা যায়, প্রায় ১৩টির মতো গান দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা ও সুর করেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথের গান, ডি এল রায়ের গান, কীর্তন, বাউল ইত্যাদি গানেও ছিলেন পারদর্শী। ১৯২৬ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি দিনেন্দ্রনাথের কিছু গান রেকর্ড ক’রে প্রকাশ করেন।
তার আগেই ১৯১৫ সালে “ফাল্গুনী” গীতিনাট্য দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে উৎসর্গ করেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন,
“যাহারা ফাল্গুনীর ফল্গুনদীটিকে বৃদ্ধকবির চিত্তমরুর তলদেশ হইতে উপরে টানিয়া আনিয়াছে তাহাদের এবং সেইসঙ্গে সেই বালকদলের সকল নাটের কান্ডারী আমার সকল গানের ভান্ডারী শ্রীমান দিনেন্দ্রনাথের হস্তে এই নাট্যকাব্যটিকে কবি-বাউলের একতারার মতো সমর্পণ করিলাম”।
রবীন্দ্রনাথের “সকল গানের ভাণ্ডারী” দিনেন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। পরে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানেও শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যদিও পরে বিভিন্ন পারিবারিক টানাপোড়েনে শান্তিনিকেতন এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
রবীন্দ্রনাথের গানের সুর পরিবর্তনের অভিযোগও আসে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ইন্দিরাদেবীর সাথে চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ কিঞ্চিৎ অভিযোগ করলেও দিনেন্দ্রনাথের প্রজ্ঞার প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল অটুট। তাই দিনেন্দ্রনাথের লেখা স্বরলিপিতেই রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন দিতেন। কিন্তু কিছু গানের সুর যেমন “বিশ্ববীণারবে বিশ্বজনে মোহিছে” রবীন্দ্রনাথ তাঁর আপত্তির কথা ইন্দিরাদেবীকে জানিয়েছিলেন চিঠিতে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান এমন সুচারুভাবে সংরক্ষণ করে তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার যে গুরুদায়িত্ব দিনেন্দ্রনাথ পালন করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা কৃতজ্ঞ চিত্তেই মনে রেখেছিলেন। তাই অতি অল্প বয়সে ১৯৩৫ সালে যখন তাঁর জীবনাবসান হয়, তখন রবীন্দ্রনাথ ভীষণ বেদনাহত হয়ে লিখেছিলেন,
“এই আশ্রমকে আনন্দনিকেতন করবার জন্য তরুতলার শ্যাম শোভা যেমন, তেমনি প্রয়োজন ছিল সংগীতের উৎসবের। সেই আনন্দ উপচার সংগ্রহের প্রচেষ্টায় প্রধান সহায় ছিলেন দিনেন্দ্র। এই আনন্দের ভাব যে ব্যাপ্ত হয়েছে, আশ্রমের মধ্যে সজীবভাবে প্রবেশ করেছে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে এর মূলেতে ছিলেন দিনেন্দ্র।
আমি যে সময়ে এখানে এসেছিলাম তখন আমি ছিলাম ক্লান্ত, আমার বয়স তখন অধিক হয়েছে। প্রথমে যা পেরেছি শেষে তা-ও পারিনি। আমার কবিপ্রকৃতিতে আমি যে দান করেছি সেই গানের বাহন ছিলেন দিনেন্দ্র।”
১৯৩৫ সালের ২১ জুলাই দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সৃষ্টি “সংগীত”; সে সংগীতের অমরত্ব প্রাপ্তি ও জনপ্রিয়তার পেছনে যাঁদের প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও প্রতিভা নিরন্তর কাজ করেছে, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)