ভজন সরকার : (১)
প্রবাসের অনেক মন্দিরেই সংগীতায়োজনের মঞ্চ আছে। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন সংগীতের আয়োজনও করে থাকেন। এটা খুব ভালো একটা দিক। বর্ণ ও জাতিভেদপ্রথায় জর্জরিত হিন্দু সমাজের জন্য এটা খুবই ভালো সংবাদ। ভিন্ন ধর্মের মানুষের অন্তত প্রবেশাধিকারের সুযোগ তো হলো, যা আগে তো বটেই এখনো ভারত-বাংলাদেশের অনেক মন্দিরেই নেই।
মন্দিরের মতো প্রবাসের মসজিদগুলোতেও এ রকম অডিটোরিয়ামের বা মঞ্চের ব্যবস্থা রাখা হোক, যেখানে সংগীত-শিল্পকলাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।

আমি প্রবাসে অনেক প্রগতিশীল সংস্কৃতজনকে চিনি, যাঁরা নিয়মিত মসজিদে যান আবার সংগীতচর্চাও করেন। আমি বিশ্বাস করি তাঁরাই পারবেন মন্দিরের মতো মসজিদ প্রাংগনেও সংগীতানুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ তৈরীর ব্যবস্থা করতে। তাহলে ধর্মশালাগুলোর কিছু অংশে ভিন্ন ধর্মের মানুষের অন্তত কিছুটা হলেও প্রবেশাধিকারের সুযোগ হবে; যেমন প্রবাসের কিছুকিছু মন্দিরে শুরু হয়েছে।
বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইলো।

[পুনশ্চঃ এক সময় ভাবতাম, এখনো ভাবি, হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এই ধর্ম, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মশালা তথা মন্দির-মসজিদ-গীর্জা এগুলো তো একদিনে মুছে যাবে না। কারণ, এগুলোর পেছনে শুধু পারলৌকিক লাভ-লোকসানই নেই, আছে ইহলৌকিক ব্যবসা-বানিজ্য-রাজনীতি। তাই মানুষ না-চাইলেও সুবিধাভোগীরা ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করবেই। যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্মশালাগুলো ক্রমেক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মানুষ এই একবিংশ শতকে ওই সব অদেখা-অজানা রূপকথার প্রলোভন আর গাল-গল্পে বিশ্বাস রাখতে পারছে না।

আগে যেমন চাইতাম, এখনো চাই, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হোক বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র; রূপান্তরিত হোক লাইব্রেরিতে, সংগীত-শিল্পকলা মঞ্চে, বিজ্ঞান শিক্ষালয়ে কিংবা শরীরচর্চার কেন্দ্রে।

যেমন বলছিলাম, ধর্মশালাগুলো থাকুক, যারা প্রার্থনা করতে চান তাঁরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যান অসুবিধে নেই। কিন্তু প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে গড়ে উঠুক সংগীত-শিল্পকলা-বিজ্ঞান কেন্দ্রও।]

(২)
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি) নির্বাচন হলো স¤প্রতিম স্থানীয় নির্বাচন হয় রাজ্য সরকার অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের অধীনে। ভোটে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। বিরোধীদল প্রার্থী দিতে পারেনি। প্রার্থীদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৪ জনের অধিক মানুষ মারা গেছে। ভোট গণনা কেন্দ্র থেকে ব্যালট লুট হয়েছে। ভোটের ফলাফলের পরেও হিংসা-হত্যা-অগ্নিসংযোগ চলছে।

বাম আমলে নচিকেতা, জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, অপর্ণা সেন, শ্রীজাত প্রমূখ বুদ্ধিজীবিরা কী সংগ্রামীই না ছিলেন অন্যায় আর মৃত্যুর বিরুদ্ধে। আর এখন সবাই শাসক দলের চামচামি করছে। এটা শুধু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নয়, বাংলাদেশেরও চিত্র। প্রতিবাদ করার মানুষ কমে যাচ্ছে। মানুষের বিবেক ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।

উন্নত বিশ্বে ভোটে দাঁড়ানোর মানুষ পাওয়া যায় না। কারণ, জনপ্রতিনিধি হওয়া অনেক দায়িত্বের। এটা অন্যান্য চাকুরীর মতোই। বেতন নির্দিষ্ট কিন্তু কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা অনেক। কিন্তু চিত্রটা আমাদের এই অঞ্চলে অন্যরকম। জনপ্রতিনিধিরা চুরি-চামারি করে, লুট করে এবং অযথা ক্ষমতা দেখায়। সম্পদশালী হওয়ার এ এক অভিনব পদ্ধতি। তাই তো ভোটে জেতার এমন প্রাণান্তকর চেষ্টা। কী বিচিত্র বাজ্ঞালি মনোজগত!

(পুনশ্চঃ বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে “সূর্য ওঠার আগেই” ভোট হয়। নির্বাচন নিয়ে মারামারি-রক্তপাত হয়। ভারতের ত্রিপুরার গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৯৬% ভাগ প্রার্থী বিনাভোটেই নির্বাচিত হয়েছে। অর্থাৎ বিরোধীরা ভয়ে প্রার্থীই হতে পারেনি, ভোটে লড়া তো দূরের কথা। একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, উল্লেখিত এই তিন জায়গাতেই বাঙালিরা শাসন করে। আসলে সমস্যাটা কি তবে পুরো বাঙালি জাতির “মানুষ” হতে না-পারার?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “সাত কোটি বাজ্ঞালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।” হুমায়ুন আজাদের সেই কথাই কি সত্যি “বাঙালি” একটি রুগ্ন জাতিগোষ্ঠী-র নাম? দেশে কিংবা প্রবাসে বাঙালিদের মধ্যে এই অসাধুতা দেখা যায়। নির্বাচন নিয়ে এমন অসভ্যতা-বর্বরতা এই একবিংশ শতকে বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও খুব কমই আছে। কী বিচিত্র এ বাঙালি মন ও মানসিকতা, সেলুকাস।)

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)