ফরিদ আহমেদ : উপন্যাসের সূচনা হয়েছে সদ্গতির আয়োজন দিয়ে। নিশুতি রাতে লক্ষ্যা নদীর পারে চিতায় জ্বলছে এক লাশ। সেই লাশকে ঘিরে রয়েছে কয়েকজন রহস্যময় মানুষ। যে লাশটাকে এনেছে, তার যেমন রয়েছে রহস্য, যারা লাশের আত্মীয় হিসাবে সেখানে উপস্থিত তাদের ঘিরেও রয়েছে রহস্য। শ্মশানে যে চণ্ডাল রয়েছে, সে-ও রহস্যমুক্ত মানুষ নয়। এমনকি দাউ দাউ করে পুড়ছে যে নীরব শব, সেটাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। চণ্ডাল আবিষ্কার করেছে এই লাশ কোনো হিন্দুর লাশ না। মজার বিষয় হচ্ছে, চণ্ডাল নিজেও হিন্দু না। শুধু মানুষগুলোই যে রহস্য ছড়াচ্ছে তা নয়। পরিবেশটাও রহস্যময়। লক্ষ্যা নদীর ওপার থেকে ভেসে আসছে অজ্ঞাত কোনো আলোর সংকেত।
এই বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে যে এই উপন্যাস হয়তো রহস্যময় এক উপন্যাস। এই উপন্যাসে রহস্য আছে, তবে রহস্যের চেয়েও এখানে রোমাঞ্চের উপাদান বেশি। তার চেয়েও বেশি রয়েছে পরাবাস্তবতার উপাদান।
পরাবাস্তব এক নগরী ঢাবাকা। এই নগরীতে অতীত আর বর্তমান হাত ধরাধরি করে চলে। এখানে বাস্তব মিশে যায় অবাস্তবের সাথে, কল্পনার স্রোত এসে আছড়ে পড়ে অকল্পনার কঠিন পাথুরি তীরে, আলো এসে এখানে মিশে যায় অন্ধকারের সাথে। তৈরি হয় আলো-ছায়াময় এক অপার্থিব পরিবেশ। সেই অপার্থিব পরিবেশে চেনা চরিত্র হয়ে যায় অচেনা, অচেনা চরিত্রকে মনে হয় চেনা চেনা। চেনা-অচেনার মাঝের দেয়ালটা বড্ড ধূসর।
পরাবাস্তব এই শহরে রয়েছে বিচিত্র সব চরিত্র। এখানে রয়েছে বুড্ডার মতো পেশাদার খুনি। টাকা নিয়ে খুন করাই যার একমাত্র পেশা। সেখানে আবেগের কোনো আলোড়ন নেই। রয়েছে পাণ্ডব কর্মকারের মতো পাথুরি চেহারার মানুষ। চেহারা দেখে মনের ভিতরে কী চলছে বোঝার কোনো উপায় নেই। খুনের মধ্যবর্তী মাধ্যম হিসাবে কাজ করেন। তিনি। এখানে রয়েছে পরিমলের মতো জেন্ডার বিভ্রান্ত মানুষ। সমাজের চাপে যাকে নিজের লৈঙ্গিক পরিচয়কে লুকিয়ে রাখতে হয়। চাপা দিয়ে রাখতে হয় নিজের মনের আনন্দকে। কাউকাবুন্নেসার মতো দুঃসাহসী সদ্য তরুণীও রয়েছে, যাকে যে দেখে সেই বলতে বাধ্য হয়, ‘এমন মেয়ে বাপের জনমেও দেখি নাই’। না দেখারই কথা। উদ্ভিন্ন যৌবনা এই তরুণী যৌবনের প্রারম্ভেই পুরুষের লালসার শিকার হয়েছে। শিকার হয়েছে বললে অবশ্য ভুল হবে। শিকারিরা বরং নারী মাংস খেতে সে তার শিকারে পরিণত হয়েছে। কাউকাবুন্নেসা তাদের অণ্ডকোষ থেঁতলে দিয়ে নপুংসক বানিয়ে ছেড়েছে। কাউকে কাউকে দুনিয়া থেকেই দূর করে দিয়েছে এই মেয়ে নির্বিকারভাবে। এমন মেয়ে বাপের জনমেও কারও দেখার কথা না। রয়েছে মনাক্কা বেগমের মতো আরেক নারী। একেবারে নিম্ন পর্যায় থেকে উঠে গিয়েছে ক্ষমতার উঁচু পর্যায়ে। এর জন্য নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া, স্বার্থের কারণে শত্রুর কাছে সমর্পণ করতেও দ্বিধা করেনি সে। শত্রুর দুর্বলতাকে ব্যবহার করে নিজে শক্তিশালী হয়েছে সে।
ঢাবাকাতে এইসব বিচিত্র চরিত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের চেনাজানা চরিত্ররাও রয়েছে। এখানে রয়েছেন কবি আলেন গিন্সবার্গ, যাকে গিরিঙ্গিবাজ হিসাবে নাম দিয়েছে কাউকাবুন্নেসা। টাকার অভাবে ঢাবাকাতে আটকে পড়েছেন তিনি। চুরি করা নোবেল প্রাইজ বিক্রি করে দেশে যাবার পয়সা জোগাড় করেন তিনি। ঢাবাকাতে টপ্পাগান খ্যাত নিধু বাবুকেও এক ঝলকের মতো দেখা যায়। যেমন দেখা যায় নির্গুইন্যা কবির আড়ালে কবি নির্মলেন্দু গুণকেও। খাবার খেয়ে যিনি পয়সা না দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান রেস্টুরেন্ট থেকে।
শুরুতেই বলেছিলাম ঢাকাবার সূচনা হয়েছে লক্ষ্যা নদীর পারের শ্মশান থেকে। এখানেই এক একটা চরিত্রের আগমন ঘটে। তারপর শুরু হয় সেই চরিত্রের নিজস্ব গল্প। সেই গল্পগুলো বিচিত্র ধরনের। একজনের সাথে আরেকজনের গল্পের মিল নেই। এই গল্পগুলোকে আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে। মনে হতে পারে যে সবকিছু বুঝি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, একটা পর্যায়ে গিয়ে বোঝা যায় এগুলো সব এক সুতো দিয়ে গাঁথা। একটার সাথে আরেকটা রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। সেই যোগসূত্র উন্মোচনের সাথে সাথে উন্মোচিত হতে থাকে রহস্যে ঢাকা ঢাবাকার নিজস্ব চরিত্রও।
ঢাবাকা কি আমাদের চিরচেনা ঢাকা শহরের পরাবাস্তব চিত্রণ? এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। ঢাবাকার মাধ্যমে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন আমাদের শুধু রহস্যে মোড়া রোমাঞ্চকর একটা গল্পই শোনাননি, একই সাথে শুনিয়েছেন এই শহরের অনেক গোপন গল্প, অনেক না জানা ইতিহাস। পুরনো ঢাকা মূর্ত হয়ে উঠেছে ঢাবাকার মাধ্যমে। ঢাবাকা এই উপন্যাসে শুধু পটভ‚মি নয়, একটা আলাদা চরিত্রও বটে। ঢাবাকা সবাইকে তার কোলে আশ্রয় দেয় মায়ের মতো। “এই ঢাবাকা মায়ের মত কোলে ঠাই দিলেও মাতৃসম নয়। সৎমায়েরও অধম। ললাটে নিত্যদিন গালি আর গঞ্জনা নিয়ে বেঁচে থাকে। কেউ ভালোবাসে না। সবাই ফায়দা লোটে। নিজের ধান্দা আর আরেকজন এর ঘাড়ে পা রেখে কিভাবে উপরে উঠা যায় সেই ধান্দায় থাকে।”
এটা একটা নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস। এই নিরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বইটার ভ‚মিকাতে লিখেছেন, “গল্প ঠিক কীভাবে এগোবে, কীভাবে এর বিস্তার এবং পরিসমাপ্তি ঘটবে – সবই আউটলাইন করে লিখি আমি। তবে ঢাবাকা লেখার সময় এই অভ্যেস থেকে সরে এসেছিলাম। কোনো রকম পরিকল্পনা আর রূপরেখা ছাড়া লিখলে কী দাঁড়ায় – সেটা দেখতে চেয়েছিলাম আমি। সেদিক থেকে ঢাবাকা আমার জন্য একটি আনন্দদায়ক এবং রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণ ছিল।”
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মূলত থ্রিলার লেখক। বেশ কিছু দুর্দান্ত থ্রিলার লিখে দুই বাংলাতেই দারুণভাবে জনপ্রিয় তিনি এখন। তাঁর উপন্যাস নিয়ে বাংলাদেশে যেমন ওয়েব সিরিজ হয়েছ, একইভাবে পশ্চিম বাংলাতেও সৃজিত মুখার্জী ওয়েব সিরিজ তৈরি করেছেন। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের কোনো বই বের হলে তাই সেটা থ্রিলার হবে, সেটাই পাঠক আশা করে। ‘ঢাবাকা’ সেই প্রত্যাশা মিটিয়েছে। এখানে থ্রিলের কোনো অভাব নেই। পাঠকের জন্য বাড়তি পাওনা হচ্ছে এই নিরীক্ষার জায়গাটা। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো সমাজের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের গ্লামারবিহীন মানুষ। সাধারণভাবে এরা মানুষের আগ্রহ জাগানোর মতো কেউ না। কিন্তু, এইসব গ্লামারবিহীন মানুষদের দিয়েই গ্লামারাস একটা উপন্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে।
‘ঢাবাকা’-র পরাবাস্তবতা অতীত এবং বর্তমান শুধু যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে তা নয়। এখানে বর্তমান এসেছে পরোক্ষে, কিন্তু প্রচণ্ডভাবে। এটা একটা গ্রাফিক্স উপন্যাস। প্রতিটা পৃষ্ঠাতেই ছবি আছে। কাউকাবুন্নেসার সাথে পাণ্ডব কর্মকারের যখন দেখা হয়, সেই ছবিতে দেখা যায় পাণ্ডব কর্মকার স্বর্ণের দোকানে বসে একটা দৈনিক পত্রিকা পড়ছেন। পত্রিকাটার নাম ‘দৈনিক ওয়াদ্দাফাক’। পত্রিকার শেষ পাতার হেড লাইন হচ্ছে ‘রুখে দাও ভোটচোরদের!’, আর প্রথম পাতার শিরোনাম হচ্ছে, ‘দ্যাশে হোগা মারা সারা’। এর নীচেই রয়েছে শহীদ নূর হোসেনের ছবি। বুকে তাঁর লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। বর্তমানকে এর চেয়ে শক্তিশালীভাবে প্রতিফলিত করা আর কোনভাবে সম্ভব?
এর আগে গ্রাফিক উপন্যাস আমি কখনো পড়ি নাই। ঠিক কী কারণে গ্রাফিক উপন্যাস করা হয়, সেটা আমার জানা নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার এই আইডিয়াটা পছন্দ হয়নি। এর পিছনের কারণটা বলছি। আমি যখন কোনো উপন্যাস পড়ি, তখন চরিত্রগুলোকে আমি আমার মতো করে তৈরি করে নেই। আমার ধারণা বেশিরভাগ পাঠকই সেটা করেন। ঢাবাকা গ্রাফিক উপন্যাস হবার কারণে আমার সেই স্বাধীনতা, সেই কল্পনাবিলাসটুকু বাধাগ্রস্ত হয়েছে। চরিত্রগুলোর চেহারা বইয়ের পাতায় থাকায় আমার কল্পনা বেশি দূর যেতে পারেনি। লেখক এবং শিল্পীর দেওয়া চেহারাই প্রাধান্য পেয়েছে। পাঠক হিসাবে এখানে আমি সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছি বলে আমার ধারণা।
সবশেষে বলবো, ‘ঢাবাকা’ একটা অসাধারণ উপন্যাস। প্রচণ্ড গতিশীল, দারুণ সাবলীল এবং দুর্দান্ত ব্যতিক্রমী এক বই। যাঁদের থ্রিলার গল্পের প্রতি অনাগ্রহ রয়েছে, তারাও এটা পড়ে আনন্দ পাবেন, এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারি আমি।