ভজন সরকার : রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা নিয়ে সবচেয়ে কষ্টকর কাজটি করেন বিশিষ্ট লেখক ও রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর পরিশ্রমলব্ধ গ্রন্থটির নাম “গীতবিতান-কালানুক্রমিক সূচী”। সে গ্রন্থে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সে রচিত গানের সংখ্যা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রায় ১৯৫টি গানের স্বরলিপি যে বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের “স্বরবিতান”-এ নেই-এমনকি অনেকগুলো গান গীতবিতানেও উল্লেখ নেই- এমন সব খুঁটিনাটি তথ্য প্রভাতকুমারের গবেষণায় আছে।

সাহিত্যিক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বয়স অনুযায়ী গানের সংখ্যা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা মোট ২১৭৮। সে হিসেব মতে দেখা যায়- তেরো, চোদ্দ ও পঞ্চান্ন বছর বয়সে ২টি করে, সত্তরে ৪টি, বিয়াল্লিশে ৫টি, ঊনত্রিশ ও সাইত্রিশে ৬টি করে, পঁয়তাল্লিশ ও ঊনআশিতে ৭টি করে, সাতছট্টি ও একাত্তরে ৮টি করে, ষোল, তেত্রিশ ও ছেচল্লিশে ৯টি করে, সতেরো, তেতাল্লিশ ও তিয়াত্তরে ১০টি করে, আঠাশে ১১টি, একত্রিশ ও চল্লিশে ১৩টি করে, একচল্লিশ ও ছাপ্পান্নোতে ১৪টি করে, আঠারোতে ১৬টি, ছাব্বিশ, সাতচল্লিশ ও আটান্নতে ১৯টি করে, ঊনসত্তরে ২২টি, পঁয়ত্রিশে ২৩টি, আটত্রিশে ২৪টি, চুয়ান্নতে ২৫টি, বত্রিশে ২৭টি, ছত্রিশে ৩০টি, বাষটিতে ৩১টি, কুড়ি বছর বয়সে ৩২টি, চৌত্রিশ, সাতান্ন ও তেষট্টিতে ৩৩টি করে, চুয়াল্লিশে ৩৭টি, আটষট্টি ও বাহাত্তরে ৩৮টি করে, ঊনিশ বছর বয়সে ৪৪টি, চব্বিশ ও পঞ্চাশে ৪৫টি করে, ছেষট্টি ও আটাত্তরে ৪৬টি করে, একুশে ও পঁচিশে ৪৭টি করে, ঊনচল্লিশ ও পচাত্তরে ৪৯টি করে, বাইশ বছর বয়সে ৫৬টি,ষাট বছরে ৫৭টি, সাতাশ বছরে ৬০টি, পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ৬১টি, বাহান্ন ও চুয়াত্তরে ৬৪টি করে, ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে ৬৬টি, আটচল্লিশ বছর বয়সে ৭৬টি, সাতাত্তর বছর বয়সে ৮০টি, তেইশ বছর বয়সে ৯১টি, একষট্টিতে ৯১টি, চৌষট্টি বছর বয়সে ৯৯টি ও তিপান্ন বছর বয়সে ১১৫টি গান রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। এ হিসেব মতে রবীন্দ্রনাথের মোট ২১৭৭টি গান।

একটি গানের সংখ্যা নিয়ে হেরফের আছে। এ নিয়ে রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী ও গবেষক দীপক দে বলেছেন, “একটি মাত্র গানের পার্থক্য হওয়ার কারণ হলো, দু’টি গান দু’বার করে অন্তর্ভুক্ত করেছেন প্রভাতকুমার তাঁর গ্রন্থে আর একটি গান অন্তভুক্ত হয়েছে তালিকায় কিন্তু প্রভাতকুমারের গ্রন্থে নেই। দু’বার করে উল্লেখ করা গান দু’টো হলো, “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” ও “ বিরহে মরিব বলে ছিল মনে পণ”। আর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত গানটি হলো, “কেন আর মিথ্যে আশা বারে বারে”।

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সূত্র থেকেই দেখা যায়, রবিঠাকুর সবচেয়ে বেশি গান লিখেছিলেন তেপান্ন বছর বয়সে ১১৫টি। তেরো বছর বয়সে লিখেছিলেন প্রথম গান, “গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে”। চোদ্দ বছর বয়সেও লিখেছিলেন ২টি গান। পনেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের লেখা কোন গান নেই, যেমন নেই ঊনষাট বছর বয়সেও অথচ ষোল বছরে লিখেছিলেন ৯টি গান- ষাট বছর বয়সে লিখেছিলেন ৫৭টি গান। কী ঘটেছিল পনেরো আর ঊনষাট বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের? রবীন্দ্রনাথের শেষ গান মৃত্যুর কয়েক মাস আগে “হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ”-আশি বছর বয়সে। তার এক বছর আগেও ঊনআশি বছর বয়সে লিখেছেন ৭টি গান।

এ শুধু গানের সংখ্যা নিরূপন; সুরের সংখ্যা, তাল ও রাগের বিভিন্ন ধারা নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। কিন্ত স্বরলিপিবিহীন যে ১৯৫টি গান আছে, সে গানগুলোর স্বরলিপি গ্রন্থনের উদ্যোগ কেউ কি নিয়েছেন? জানা যায়, ইদানিং এই স্বরলিপিহীন ১৯৫টি গানে সুর করছেন কলকাতার শিল্পী স্বাগতালক্ষ্ণী দাশগুপ্ত।

যাক সে কথা, রবীন্দ্রনাথের এই যে দু’হাজারের বেশি গান, প্রতিটি গানই কি মানবিচারে উৎকর্ষ? আমি গানের অ আ ক খ তেমন বুঝি না। তাই আমার বিচার গীতবিতান পড়ে এবং কিছু গান শুনে। সে বিবেচনায় আমার দৃষ্টিভংগী মূলত কাব্য ও কথার অর্থ বিচারে। গীতবিতানের পড়ে অনেকের মনে হতেই পারে যে, অনেক গান শুধু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ব’লে মনে হয় এ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে, গানের মান বিচার না করেই। খুব নির্দয়ভাবে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে এসব গান রবীন্দ্রনাথ বাতিল করে দিতে পারতেন অনায়াসে; কিন্তু দেননি।

রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা কাটাছেঁড়া করেছেন, সে পান্ডুলিপি আছে। কিন্তু কোনো রচনা লিখে সেগুলো বাতিল করে দিয়েছেন এমন নজির আছে কি? হয়ত তেমন নেই। এ নিয়ে নানান রকম অভিমত আছে। অনেকে বলেন যে, রবীন্দ্রনাথের চারপাশে অনেক স্তাবক থাকতেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অযাচিত প্রশংসা করতেন। আমার ভাবতে বেশ অবাকই লাগে, এই স্তাবক পরিবেষ্ঠিত থেকেও একজন মানুষ কিভাবে এত লেখালিখে করে গেছেন। হয়ত রবীন্দ্রনাথ বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে একা করে নেয়ার যে অসাধারণ ক্ষমতা সেটি ভাবতে অবাকই লাগে।
তবে প্রশ্ন করা যেতে পারে, দু’হাজার গানের মধ্যে কতগুলো গান মান-উত্তীর্ণ? সে পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ কাজ করেছেন বলে আমি জানি না। তবে যতদূর মনে হয়, বাঙালি মানসে রবীন্দ্রনাথ এমন উচ্চতায় বসে আছেন যে, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা ও সাহস কারও হয়নি এবং কবে হবে সেটাও সন্দেহাতীত নয়।

তবে গীতবিতান পড়ে যতটুকু মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের পূজা কিংবা পূজা ও প্রার্থনা নামে যে পর্ব দু’টো আছে সেখানকার অনেক গানই গ্রন্থিত না করাই উচিত ছিল। এ সব গানের অধিকাংশই রবীন্দ্রনাথের গান রচনার প্রথম দিকের লেখা অর্থাৎ ব্রাহ্মসভার জন্য লেখা গান।
বিলেত থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ জ্যোতিদাদার ব্রাহ্মসভায় গাইবার জন্য কিছু গান লিখেছিলেন, যার অধিকাংশই পূজা পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। খুবই অপ্রচলিত ও স্বল্পশ্রুত এ গানগুলোতে বাণী ও সুরের তেমন আহামরি কোনো ব্যবহার নেই। গানগুলো তেমনভাবে গাইতেও শোনা যায় না। গানগুলো পড়লে কাব্যকথাতেও কোনো চমক মেলে না। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন বলেই এ গানগুলোর তেমন বিরূপ সমালোচনা বা আলোচনা নেই।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে এ গানগুলোর অনেকগুলোই গীতবিতানে স্থান পাওয়া উচিত হয়নি। গান রচনার প্রথম পর্বের এ গানগুলো নিয়ে রবীন্দ্রশিষ্য শান্তিদেব ঘোষও কিঞ্চিৎ মন্তব্য করেছেন। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথের রচিত যে গানগুলোর মাধ্যমে বাংলা গান আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে, এ গানগুলো তার অনেক আগে রচিত ও সুর করা। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাংলা গান আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। বিশেষকরে বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথই সঞ্চারী নামে আরেকটি অংশ অন্তর্ভুক্ত করেন, যার ব্যবহার শুধু নতুনই নয় অভিনবও বটে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান রচনার প্রথম দিকের এ গানগুলোতে এ অভিনবত্ব নেই।

উদাহরণ হিসেবে অনেক গানের কথাই বলা যায়, আমি শুধু কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ করছি।
পূজা পর্যায়ের ৫১১ ক্রমিকের গানটি,
“দেবাধিদেব মহাদেব অসীম সম্পদ, অসীম মহিমা।
মহাসভা তব অনন্ত আকাশে।
কোটি কন্ঠ গাহে জয় জয় জয় হে।”
কিংবা
পূজা পর্যায়ের ৫১৩ ক্রমিকের গানটি
“জরজর প্রাণে, নাথ, বরিষন করো তব প্রেমসুধা
নিবারো এ হ্নদয়দহন।
করো হে মোচন করো পাপমোহ
দূর করো বিষয়বাসনা”।

এ রকম অনেক গানের উল্লেখই করা যায়, যা রবীন্দ্রনাথের রচনা বলে না দিলে অনেকেই হয়ত অন্যভাবে আলোচনা করতেন। আবার এমন অনেক গান আছে যার কথায় চমক নেই কিন্তু সুরের তানে প্রাণ টানে। আবার কিছু গান আছে যার কথা ও সুর কিছুই টানে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পন্ডিত মহাসভা কেন গানগুলো ছাপিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁরাই জানেন; সে কি শুধু সংখ্যা বাড়াবার প্রয়োজনে?
কিন্তু আরেকটি গান আছে পূজা পর্যায়েরই যার কথায় তেমন ভার নেই কিন্তু সুর প্রাণকে উদাস করে দেয়। গানটি পূজা পর্যায়েরই ৫১৪ ক্রমিকে স্থান দিয়েছেন কবি,
“কোথায় তুমি, আমি কোথায়
জীবন কোন পথে চলিছে কেহ নাহি জানি।
নিশিদিন হেনভাবে আর কতকাল যাবে
দীননাথ, পদতলে লহো টানি।”

বিলাবল রাগে রবীন্দ্রনাথ গানটি সুর করেছিলেন ১৯০১ সালে। আর শিল্পী পূর্বা দাম এমন দরদী কন্ঠে গানটি গেয়েছেন যে, কথার অপ্রতুলতা ছাপিয়ে সুরের চমক কান থেকে প্রাণে গিয়ে লাগে।
পরিশেষে এটা বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের এই ২১১৭টি গানের প্রতিটির কথা ও সুর বিচার করলে এ রকম অনেক অপ্রয়োজনীয় গানের দেখা পাওয়া যাবে; যাকে আমি একটু নির্দয়ভাবেই “বাজে” গান বলেছি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান বিচারের এ কাজটি অনেকেই করেননি। যদিও রবীন্দ্রনাথের নির্মোহ আলোচনা- সমালোচনা করার মতো যোগ্য লোক যে ছিল না তেমনটি নয়। কিন্তু বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে সবসময় ব্যবচ্ছেদ করেছেন দু’বিবেচনায়।

প্রথমত, ভক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অতিমানব তথা ঈশ্বরের সমতুল্য মনে ক’রে আর দ্বিতীয়ত, অহেতুক ও অপ্রাসংগিক সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথকে হেয় ক’রে নিজেদের পরিচিতি বাড়ানো বা রবীন্দ্র-আলোয় নিজেকে তুলে ধরবার অপপ্রয়াসে। কিন্তু দু’বিবেচনাতেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিশেষকরে গান নিয়ে সব আলোচনা বস্তুনিষ্ঠতার বাইরেই থেকে গেছে।
(তথ্য সহায়তাঃ ১। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ গীতবিতান-কালানুক্রমিক সূচী”;
২। প্রবন্ধ “ রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা ও অপ্রকাশিত স্বরলিপি”- দীপক দে।)
(ভজন সরকার: কবি,কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও)