অনলাইন ডেস্ক : প্রাণঘাতী করোনায় বদলে গেছে মানুষের জীবনধারা। ঘরবন্দী মানুষের মধ্যে এখনো উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা। করোনাকাল শেষ হবে কবে তার নেই কোনো সীমারেখা। অফিস-আদালতসহ মানুষের কর্মকান্ডেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ঘরে বসেই এখন অনেকে অফিস করছেন। ল্যাপটপেই পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন কেউ কেউ। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না কেউ। রাজনৈতিক কর্মকান্ডও চলছে ভার্চুয়ালে।

আইন-আদালতে বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ। কোথাও কোথাও চলছে অনলাইনে ক্লাস। বন্ধ রয়েছে বিয়েশাদি, আচার-অনুষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় মাহফিলও। অধিকাংশ পর্যটন কেন্দ্রই এখন মানুষশূন্য। তবে এরই মধ্যে প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রকৃতি। কমেছে পরিবেশে দূষণের মাত্রা। অবশ্য বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই এখন লকডাউন সীমিত আকারে হচ্ছে। অফিস-আদালতসহ কর্মক্ষেত্রগুলো সীমিত আকারে খুলতে শুরু করেছে।

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশের যে পরিস্থিতি তাতে শতভাগ ভার্চুয়াল অফিস-আদালত করা সম্ভব নয়। এটা হয়তো সাময়িক। করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে আবার আগের মতো অফিস-আদালত শুরু হবে। তবে এ ধরনের মহামারী যেহেতু আগে কখনো আসেনি, ফলে এটা তো একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। নতুন অভিজ্ঞতা। দক্ষতা বাড়াতে হবে। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। সিস্টেমগুলোকে অনলাইন করতে হবে। এটা করতে পারলে কাজের গতিও বাড়বে। আবার দুর্নীতি অনিয়মও কমবে।’ বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, কভিড-১৯ এর প্রভাবে বিশ্বজুড়েই নানা রকম পরিবর্তন এসেছে। মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য হচ্ছে। কাজকর্ম করছে অনলাইনে। ভার্চুয়াল একটা জগৎ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটারও একটা বড় ঝুঁকি রয়েছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনই কিন্তু শিশু-কিশোরদের বিপথগামী করে ফেলতে পারে খুব সহজেই। সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, মানুষের জীবন ধারা পাল্টে যাচ্ছে। দিন দিন কাজের ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। এতে ক্ষুধার্ত মানুষের সারি লম্বাই হবে, যা সমাজে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি করবে। ক্ষুধার কারণে মনুুষ্যত্ব লোপ পাবে। ফলে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, করোনায় বদলে গেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্র। রাজপথে আগের মতো নেই সভা-সমাবেশ আর মিছিল কিংবা মানববন্ধন। হরতাল-অবরোধ বা সহিংস কর্মসূচি বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। বর্তমানে রাজনৈতিক সব কর্মকান্ডই পরিচালিত হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব দলের নেতারাই তাদের কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন স্কাইপি, গুগল মিট বা জুম অ্যাপের মাধ্যমে। দলীয় সংবাদ সম্মেলন বা দিবসভিত্তিক আলোচনাও হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। সবাই যার যার অবস্থানে নিরাপদ থেকে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। নেতারা সরাসরি কর্মী-সমর্থকদের দেখা দিচ্ছেন না। বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও তাদের মূল্যবান বক্তব্য সবার মাঝে পৌঁছে দিচ্ছেন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। অন্যরকম রাজনীতি চলছে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বেই। মহামারী করোনা আতঙ্কে মানুষ যখন ঘরে বন্দী তখন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে প্রকৃতি। নাগরিক দৃশ্যপট থেকে যেসব পশুপাখি বহুদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিল, তারা আবার নিজেদের জায়গায় ফিরতে শুরু করেছে। মানুষের মৃত্যু বিষাদের মধ্যেও যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রকৃতি। পরিবেশে কমেছে দূষণের মাত্রা। করোনাকালে অনেক কল-কারখানা বন্ধ থাকায় বাতাসে ধূলিকণাসহ বিষাক্ত সব পদার্থের উপস্থিতি কমেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বায়ু ও শব্দ দূষণের মাত্রা আগের চেয়ে কম । সমুদ্রসৈকতে দলবেঁধে জলকেলি করছে ডলফিন। সৈকতে নিশ্চিন্তে ডিম পাড়ছে লাখ লাখ অলিভ রিডলে কচ্ছপ। করোনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বছরের শুরুতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। করোনার আঘাতে এবার শুরু থেকেই হোঁচট খেয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ল-ভ- হয়ে গেছে সব পরিকল্পনা। স্থগিত হয়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২০। ক্লাস-পরীক্ষা অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার সঠিক সময়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও করোনার কারণে ফলাফল প্রকাশিত হয় এক মাস পরে। আবার ফলাফল প্রকাশিত হলেও এখনো শুরু হয়নি উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি কার্যক্রম। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও প্রযুক্তির স্বল্পতার কারণে কোনো কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। ফলে একাংশ শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ছে। করোনায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর। এ শিক্ষার্থীরা বাসার চেয়ে স্কুলে শিখে বেশি। তাদের সবচেয়ে আনন্দের জায়গা হচ্ছে স্কুল। সকালে নিয়ম করে স্কুলে যাওয়া, বাড়ি ফেরা, পড়তে বসা ইত্যাদি সব এখন অনিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে শিশুরা তাদের শিক্ষা ভুলতে শুরু করেছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সময়ের এক বড় অংশ ব্যয় করছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প। দেশের প্রায় সব পর্যটন কেন্দ্র এখন বন্ধ। তিন মাস ধরে প্রায় শূন্য পর্যটন কেদ্রগুলো। করোনার কারণে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে দর্শনীয় স্থানগুলোতে। ‘ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে ‘মৃত প্রায়’ পর্যটনশিল্পে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ খাত সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী এখন বেকার।

করোনাকালে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে আটকে গেছে বিয়েশাদি। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতেও জ্বলছে না লাল বাতি। জুয়েলারি দোকানগুলোতে নেই আগের মতো ভিড়। ধস নেমেছে পার্লার শিল্পে। মিরপুর বেনারসি পল্লীতেও নেই লোকসমাগম। অনেকেই বিয়ের জন্য পার্টি সেন্টার ভাড়া নিয়েও বুকিং বাতিল করেছেন। ২৬ মার্চ থেকেই বিয়েশাদিসহ সামাজিক আচার অনুষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় মাহফিল অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় জনসমাগম হয় এমন সব অনুষ্ঠান বন্ধ করতে সরকারি নির্দেশ থাকায় বিয়ের কার্ড ছাপিয়েও অনুষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন কেউ কেউ। তবে কোথাও কোথাও বর-কনে পক্ষের অল্প লোকজন নিয়ে গোপনে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান হচ্ছে। আবার পুলিশি হানায় প-ও হয়েছে কিছু অনুষ্ঠান। মিরপুর বেনারসি পল্লীর এক বিক্রেতা বলেন, প্রতি বছর বসন্তে, না গরম, না ঠান্ডা এমন আবহাওয়ায় বিয়ের শাড়ি বিক্রি বেশি হয়। অনেকে বিয়ের কনে ও বিয়েতে অংশ নেওয়া অন্যদের শাড়িও অর্ডার দিয়ে কিনে থাকেন। এবার অনেক অর্ডার ছিল। কিন্তু সব বাতিল করে দিয়েছেন। করোনার কারণে দোকান বন্ধ।

ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলছে আদালতও : করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার টানা সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর বন্ধ হয়ে যায় আদালতও। পরে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে জরুরি বিষয় শুনানিতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালতের কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করতে গত ৯ মে অনলাইন কোর্ট অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) জারি করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর ১০ মে ভার্চুয়াল কোর্ট সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। ১১ মে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল কোর্টে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মে থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে অধস্তন আদালতে ৯৫ হাজার ৫২৩টি জামিন আদালতের শুনানি নিয়ে ৪৯ হাজার ৭৬২ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে শিশু আদালত থেকে জামিন পেয়েছে ৬০৮ শিশু। বর্তমানে ভার্চুয়াল আদালতে চেক ডিজঅর্নার সংক্রান্ত মামলা দায়ের ও ফৌজদারি মামলায় আত্মসমর্পণের সুযোগ রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেকেই কর্মীদের বাসায় বসে অফিস করার সুযোগ দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশই নয়, পুরো বিশ্বেই এখন অফিসের বদলে বাড়িতে বসেই দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। আবার ব্যতিক্রমও আছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে অফিস করাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান গুগল, মাইক্রোসফট, টুইটার, হিটাচি, অ্যাপল, আমাজন, শেভরন, সেলসফোর্স, স্পটিফাইয়ের মতো কোম্পানি কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্তরাজ্য, জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বাড়িতে বসে কাজ করছেন। আমাদের দেশের টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোও ইতিমধ্যে এ পথে হেঁটেছে। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আকস্মিকভাবে চলে আসা প্রাণঘাতী করোনায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই এখন এক অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে। এটা কবে শেষ হবে তাও কারও জানা নেই। এখন সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ সব কর্মকান্ডই বন্ধ। কোনো আচার-অনুষ্ঠান নেই বললেই চলে। বিয়েশাদি নেই। এমনকি মানুষ মারা গেলে জানাজায়ও যাওয়া যাচ্ছে না। তবে এই অস্বাভাবিকতা শেষ হওয়া জরুরি। নইলে মানুষ বেশি দিন ঘরবন্দী হয়ে থাকতে পারবে না। আর কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্রই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।