বিদ্যুৎ সরকার : যেমন আমার মনের জানলার পাশে একটি লাল-সবুজ পতাকা অহনীশ উড়ছে তেমনি, দিনভর সত্যিকারের একটি লাল-সবুজ পতাকা বিরামহীন উড়ছে সত্যিকারের একটি জানালার পাশেই। ঠিক যেখানটায় বসে মনের ক্ষুধা মেটাতে কাজ করতে হয় প্রতিদিন। রাস্তার পাশে দোতলার ছোট্ট একটি কামড়া। এর জানালার পাশেই আমার বসার স্থান। যেমন সতেজ রোদ এই গ্রীষ্মে, তেমনি বিশুদ্ধ হাওয়ার মুক্ত বিচরণ। বাতাসে মন দোলে, পতাকা উড়ে সারাক্ষণ। ড্যানফোর্থের মিনি বাংলাদেশের সাক্ষ্য বহন করে এই লাল-সবুজ পতাকা। অনেকেই বলেন টরন্টোর “বাংলা পাড়া”। এ জানালার মধ্য দিয়েই খন্ডিত আকাশ দেখি – শরতের আকাশ, গ্রীষ্মের আকাশ, শীতের আকাশ। মাঝে মধ্যে যা-ও দু’একটা পাখি উড়ে, ঘুড়ি উড়ে না কখনও, কোন কালে। মন আকাশে লাল, নীল ঘুড়ি উড়ে যখন-তখন, সারা বেলা। সুদূর বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। কৃষকের ঘাম ঝরানো সবুজ ধান ক্ষেত। সুখ যেখানে উন্মুখ হয়ে থাকে হাসি ফোটাবার প্রত্যাশায়। সেই ধান ক্ষেতের সবুজের ভেতর থেকে হঠাৎ বুঝি উড়ে উড়ে ঘুরে বেরায় লাল ঘুড়ি অন্তবিহীন নীলের মাঝে। এখানেও যেন এঁকে যায় একটি পতাকারই প্রতিচ্ছবি।

সেই একাত্তরের বনগাঁর যশোর রোড। অন্ধকারাচ্ছন্ন তাবুর নিচে স্যাঁত স্যাঁতে মাটির বিছানায় শীর্ন দেহে বৃদ্ধ শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে একটি মানচিত্র, একটি লাল-সবুজ পতাকার। ছেলে তার মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে অনেকদিন আগেই। একটি পতাকার জন্য, একটি মানচিত্রের জন্য কিভাবে মুক্তিযোদ্ধারা লড়ে যাচ্ছে শত্রæসেনার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে জীবন বাজী রেখে। অতঃপর লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে একটি লাল সূর্য্য খচিত সবুজ পতাকা উড়ছে আমাদের আকাশে, উড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে – একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ যার নাম “বাংলাদেশ”। বাইশ হাজার কিলোমিটার দূরের একটি জানালার পাশে আমার অতি প্রিয় পতাকাটি উড়ছে বিরামহীন। অন্তবিহীন কাল ধরে এ লাল-সবুজ পতাকা উড়তে থাকবে। পতাকার শরীর ছুঁয়ে যে নির্মল বাতাসটুকু আমার দেহে স্পর্শ রাখে তাতে আমার হৃদয় জুড়োয়, প্রাণ শীতল হয় নিমিষেই। আমার জানালা দিয়ে এই গ্রীষ্মে যেটুকু খন্ডিত আকাশ দেখি সে তো আমারই আকাশ। টুকরো টুকরো মেঘ উড়ে চলে যায় ঠিকানাবিহীন অন্য আকাশে। একটি লাল-সবুজের পতাকা। আমাদের ভাললাগার পতাকা, গৌরবের পতাকা- উদ্বৃত্ব ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে চিরদিন। মৌসুমী ভৌমিকের “যশোর রোড”- এর গানের সাথে একাত্তরের স্মৃতিরা মিলে-মিশে থাকবে আমার জানালার ফ্রেমের মাঝে চিরকাল।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা