ড: বাহারুল হক : **** আমাদের পাশে ছিল আমার ছোট দাদার ঘর। দাদার ঘরে কাজ করার জন্য একটা ছেলে আনা হলো। ছোট ছেলে; আমার বয়সী। এই ৮/৯ বছর হবে। ওকে নিয়ে সমস্যা হয়ে গেলো। ওর নাম বাহার। দাদা তাকে বললেন- বাহার আমার নাতির নাম তোমাকে তাহের নামে ডাকা হবে। আবার সমস্যা হয়ে গেলো। কিছুদিন পর আমাদের ঘরে একটা নতুন কাজের ছেলে আসলো; তার নাম তাহের। আব্বা তাকে বললেন- পাশের ঘরে তাহের একজন আছে। তোমাকে তাহের ডাকা যাবে না। কি নামে ডাকবো বলো। সে কিছু বলে না। আব্বা বললেন- তোমার নাম কি? সে বললো- তাহের। আব্বা বললেন- না , পুরা নাম বলো। সে বললো- তাহের আলী। ব্যাস, সহজ সমাধান। তাহের হয়ে গেল আলী। তাহের বাদ। আমাদের আলীর নাম কথা শুনে তাহের একদিন বললো- আমার নামওতো বাহার আলী। দাদা আমাকে আলী ডাকলেইতো হতো। আলী বললো- তা তুমি দাদাকে বলোনি কেন? তাহের বললো- বলবো কখন! দাদাতো ধুম করে বলে দিলেন – তোমার নাম তাহের। বড় হয়ে বুঝলাম- আব্বা আর দাদা দুইজন দুই রকম স্বভাবের। আব্বা চাপিয়ে দেননি। দাদা কিন্তু চাপিয়ে দিয়েছেন।

**** ভিক্ষুক, ভিখারী, ভিক্ষাজীবী, ইত্যাদি শব্দের সাথে আমরা সবাই খুব ভালোভাবে পরিচিত। আদতে ভিক্ষাজীবী দেখতে দেখতে আমাদের বড় হওয়া। আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি সে গ্রামে ভিক্ষাজীবী নামতো প্রতি শুক্রবারে। আমাদেরও প্রস্তুতি থাকতো ভালো। আমি খুব ছোট তখন, তবুও শুক্রবারে ভিক্ষাজীবীকে ভিক্ষা দেয়ার দায়ীত্ব পালা ক্রমে অন্যদের সাথে কিছু সময়ের জন্য আমার উপরো পড়তো। একটা পাত্রে কিছু চাল নিয়ে ঘরের সদর দরজার সামনে উৎসাহ নিয়ে ভিক্ষাজীবীর অপেক্ষায় আমি বসে থাকতাম। ভিক্ষাজীবী এলেই প্রত্যেক কে দু’মুষ্টি করে চাল দিতাম। ভিক্ষাজীবীরাও ভালো। তারা কখনো আরেক মুষ্টি দাও বলে বিরক্ত করতো না। ভিক্ষাজীবীদেরকেও দেখতাম খুব ব্যস্ত। যেন সময় খুব কম এরকম ভাব নিয়ে তারা দ্রæত পায়ে হাঁটতো। যেহেতু ঘরের দিকে তাকালেই ভিক্ষাজীবীরা দেখতো কেউ একজন চাল নিয়ে বসে আছে ফলে তারা কোন রকম হাঁক-ডাক দিতো না। আমার দাদু এটাই চাইতেন। ঘরের সামনে ভিক্ষাজীবী হাঁক-ডাক দিচ্ছে এটা আমার দাদুর একদম না পছন্দ। সে জন্য দাদু চাল নিয়ে দরজার সামনে কাউকে বসিয়ে রাখতেন। বড় হলে বাহিরে নানা জাযগায় যাওয়া আসা করা শুরু করলাম। বাহিরেও দেখি ভিক্ষাজীবী। হাঁটে, বাজারে, রেল স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে, সর্বত্র ভিক্ষাজীবী আর ভিক্ষাজীবী। বড় হয়ে আমার প্রথম বিদেশ যাওয়া ভারতে। বিদ্যা চর্চার বদৌলতে আমার বহুদিন ভারতে থাকা লেগেছিল। ভারতেও দেখলাম ভিক্ষাজীবী আছে সব জায়গায়। তবে খেয়াল করে দেখলাম বাংলাদেশের আর ভারতের দু’দেশের ভিক্ষাজীবীর বৈশিষ্ট দু’রকম।

বাংলাদেশের ভিক্ষুকরা হাত পেতে নেয় শুধু বিনিময়ে কিছু দেয়না। তাদেরকে কিছু ভিক্ষা দেয়ার জন্য চার দিকের মানুষকে আকুতি ভরা কন্ঠে তারা বার বার অনুরোধ করে যেতে থাকে । ভিক্ষাজীবীকে কেউ ভিক্ষা দিলে ভিক্ষাজীবী আল্লাহকে বলে দেয় ভিক্ষার বিনিময়ে আল্লাহ যেন ভিখদাতাকে সবকিছু দিয়ে দেন। যেমন, হে আল্লাহ তুমি ভিখদাতার ধন-দৌলত আয়ু বৃদ্ধি করে দাও, তুমি ———দাও, ইত্যাদি। অন্যদিকে ভারতের ভিক্ষাজীবীরা গান গেয়ে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পথ চলে। পথের মানুষ খুশি হয়ে কিছু পয়সা-কড়ি ভিক্ষাজীবীর হাতে গুজে দেয়। ব্যাপারটা অনেকটা ‘গিভ এন্ড টেক’। ভিক্ষাজীবী বিনোদনের বিনিময়ে অর্থ নেয়। ভিখদাতাকে কিছু দেয়ার দায় ভারতের ভিক্ষাজীবীরা ঈশ্বরের উপর চাপিয়ে দেয় না। জীবনের বহু লম্বা এক পথ অতিক্রম করে শেষে আমার আসা হলো এই কানাডায়। আসার আগে কানাডা সম্মন্ধে যা জেনেছিলাম তাতে কানাডায় ভিক্ষাজীবীর দেখা মিলবে এমনটা আমি মোটেই ভাবিনি। কিন্তু কানাডা এসে আমি ঠিকই ভিক্ষাজীবীর দেখা পেলাম এবং যার পর নাই অবাক হলাম। স্পস্টভাবে বুঝলাম ভিক্ষাবৃত্তি একটা আদি পেশা; কারণে হোক অকারণে হোক পৃথিবীর সর্বত্র সব দেশে সব সমাজে সব পরিবেশে কেউ না কেউ ভিখ মাগাকে বৃত্তি হিসাবে নেবেই। স্থান, কাল, জিডিপি, মাথা পিছু আয়, সব কিছুতেই পরিবর্তন আসবে কিন্ত এই আদি পেশার বিলুপ্তি কোন দিন ঘটবে না।

টরন্টোতে দুই ধরনের ভিক্ষাজীবী দেখলাম। এক ধরনের ভিক্ষাজীবী সাবওয়ে স্টেশনে তাদের জন্য বরাদ্ধকৃত নির্দিষ্ট জায়গায় আধুনিক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সুরেলা কন্ঠে গান গায়। যাত্রীদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনার সময় কোথায়? তারমধ্যেও কোন কোন যাত্রী দু/এক ডলার বা পঁচিশ সেন্টের দু/তিনটা কয়েন তাদের সামনে রেখে দেয়। এসব গায়ক ভিক্ষাজীবীরা মুখ ফুটে কাউকে বলেনা কিছু দিয়ে যেতে। তারা তাদের মত মন দিয়ে গেয়ে বাজিয়ে যায়, কেউ কিছু দিলে দিল না দিলে নাই। আরেক ধরনের ভিক্ষাজীবী আছে যাদের দেখা মেলে মেট্রো, ওয়ালমার্ট, শপার্স ড্রাগ মার্টের মত শপিং সেন্টারের সামনে। এরা হাতে একটা খালি কফি কাপ ধরে মানুষের কাছে চেঞ্জ চেয়ে যায়। খুব কম মানুষই কিছু দেয়। তবুও এরা বিরামহীনভাবে চেয়ে যেতে থাকে। এরা গান গায় না, বাদ্যযন্ত্র বাজায় না, আবার ঈশ্বরকেও তার ঝামেলার মধ্যে টানে না।

——- সেদিন এক জায়গা থেকে বাসে ফিরবো, কিন্ত বুঝতে পারছিলাম না বাসের জন্য কোন সাইডে দাঁড়াবো। রাস্তায় মানুষজন বলতে গেলে নাই। একজনকে পেলাম। যেই না আমি দৃস্টি আকর্ষনের জন্য বললাম- “এক্সকিউজ মি”। অমনি তিনি বললেন- “সরি, আই হ্যাভ নো চেঞ্জ”। সাহেব আমাকে ভিক্ষাজিবী মনে করেছিলেন, তাই সাহেবের এ উক্তি। ভিক্ষাজীবীরাও এখানে শুরু করে “এক্সকিউজ মি” দিয়ে । আপনারা হয়তো ভাবছেন ভিখারীর মত ড্রেস পরলেতো ভিখারী ভাববেই। আপনাদের ধারনা ঠিক না। এখানে ভিক্ষাজীবীরাও সুটেড-বুটেড + মুখে সিগারেট।

***** মন একটি বহুল ব্যবহৃত বাংলা শব্দ। কথায় কাজে প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয় মন শব্দটি। শব্দটির গুরুত্বও অপরিসীম। মনকে বাদ দিয়ে কিছুই হয়না। মন নিয়ে যেমন সুবিধা তেমনি অনেক সমস্যাও হয় মন নিয়ে তাই বিদ্যা শাস্ত্রে আছে বড় গুরুত্বপুর্ণ এক বিজ্ঞান – মনোবিজ্ঞান। এ শাস্ত্র শুধু মন নিয়ে। অথচ মন কোন বস্তু নয়। মন দেখা যায়না, ধরা যায়না, মনের কোন ভর বা ওজন নাই। মন স্পর্শ করা যায়না, ছোঁয়া যায়না তবু ও আমরা বলি মন ছুঁয়ে গেছে। হাঁ, ছুঁয়ে যায়। এক মন ছুঁয়ে যায় শুধু আরেক মন। সেন্টিমিটার মিলিমিটার কোন কিছুতে মনের গভীরতা নির্ণয়ও করা যায়না, কিন্তু এক মন আরেক মনের গভীরতা নির্ণয় করতে পারে। মন দেখা যায়না, কিন্তু এক মন দেখতে পায় আরেক মন। সে জন্য বলা হয় – ওর মন এখানে নাই। মন কোন জায়গা দখল করে না, তারপর ও বলা হয় – ওর মন এখন আমার দখলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- মনের গতি আছে– আমার মনে হয় সে গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি। পৃথিবীর বহু কিছু আলোর চলার পথে বাঁধা হতে পারে, কি আছে এ ধরায় যা মনের গতি পথে বাঁধা হতে পারে? কিছু আছে কি?

***** একজন প্রিয় মানুষ আমাকে বললো তাকে একট কাগজ দিতে যে কাগজে তার সম্মন্ধে আমার অভিমত ব্যাক্ত থাকবে। তার অনুরোধে লিখলাম। এটা সেটা লিখে পাতা ভরিয়ে ফেললাম। লিখে এবার আমি পড়লাম। পড়ে ভাবলাম- আহারে আজ আমি একটা ছোট মানুষ বলে কত কিছু লিখলাম। আজ যদি আমি বড় একজন মানুষ, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হতাম তাহলে কি এতকিছু লিখতে হতো? হতোনা। শুধু একটা লাইন, যেমন- “আমার —- একজন ভালো মানুষ” লিখলেই চলতো। এর বেশি কিছু লিখতে হতো না। তাহলে বলি, শুনেন- কাবুল ইউনিভার্সিটিতে বাংলার শিক্ষক নিবে একজন। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী একজন প্রার্থী। তিনি কাবুল যাবেন ইন্টারভিউ দিতে। মুজতবা আলী জানলেন প্রার্থী আরো অনেক। তারাও যাচ্ছে কাবুল। মুজতবা আলী জানলেন তাদের প্রত্যেকের হাতে আছে অনেক রকমের প্রশংসাপত্র। তারা সেসব ইন্টার্ভিউ বোর্ডে দেখাবেন। মুজতবা আলী ঘাবড়ে গেলেন। তার হাতেতো সে রকম কিছু নাই। তিনি কি দেখাবেন। ভারি চিন্তিত মুজতবা আলী গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। গিয়ে সব বললেন এবং একটা পত্র চাইলেন যা তিনি সাথে করে কাবুল নিয়ে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ তার কথা শুনলেন; তারপর রাইটিং প্যাডটা টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর তিনি লিখলেন- “আমার মুজতবা বাংলা জানে।” লাইনটা লিখে নিচে একটা দস্তখত দিলেন। তারপর প্যাড থেকে পাতাটা ছিঁড়ে মুজতবা আলীর হাতে দিলেন। কাবুলে ইন্টারভিউও বোর্ডকে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাগজটা দিলেন। বোর্ডের কারো মুখে আর কোন কথা নাই। সবাই বললো-ওর আর কি দেখবো, ইন্টারভিউই বা কি নেবো! রবীন্দ্রনাথ বলেছে সে বাংলা জানে। আরতো কোন কথা থাকতে পারে না। ওকে নিয়ে নাও। ব্যাস, মুজবা আলীর চাকুরি হযে গেল। তিনি যোগদান করলেন। আসলে বড় মানুষদের কম বললে কম লিখলে চলে। অপরদিকে ছোট মানুষদের লিখতে হয় বেশি বলতেও হয় বেশি। বড় মানুষদের সুবিধাও বড়।