অনলাইন ডেস্ক : করোনা যেন অনেকের জন্য আশীর্বাদ! বিশেষ করে করোনার পরীক্ষা ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এরই মধ্যে এ চক্রের সদস্যরা হাজারো মানুষের হাতে করোনা টেস্টের নামে ভুয়া সনদ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিশদ তদন্ত করে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা বিস্ময়কর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনার টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। একটি ল্যাপটপ থেকে গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোর থেকে এই মনগড়া করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মেইলে পাঠায় তারা। তাদের কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। টেস্টের জন্য জনপ্রতি নেওয়া হয় সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি একশ’ ডলার। এ হিসাবে করোনার টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা। করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে এমন নির্মম বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত জেকেজির চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী প্রতারক আরিফ চৌধুরী। জেকেজির কেলেঙ্কারিতে আরিফসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও সাবরিনা পলাতক। করোনা হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টের অপকর্ম ঘিরে যখন নানামুখী আলোচনা তখনই জেকেজির চারটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মিলল এমন তথ্য। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র গতকাল এসব তথ্য জানায়। গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি ছিল জেকেজির। পরে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়।

যেভাবে করোনার তৈরি ভুয়া সার্টিফিকেট : অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, জেকেজি তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের সনদ দেয়। তার মধ্যে আইইডিসিআরের মাধ্যমে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাদ বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট তারা গুলশানের তাদের কার্যালয়ের ১৫ তলার একটি ফ্লোরে বসে ল্যাপটপে তৈরি করেছিল। ওই ফ্লোরে একটি ল্যাপটপ, একটি বিছানা আর টেবিল ছাড়া কোনো সামগ্রী ছিল না। জেকেজির ৭-৮ জন কর্মী দিনরাত ওই ল্যাপটপে বসে ভুয়া রিপোর্ট বানাতেন।

নেগেটিভ-পজিটিভ : জানা গেছে, জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের স্যাম্পল সংগ্রহ করতেন। ওই সময় রোগীদের কাছে ১০টি প্রশ্ন সংবলিত একটি কাগজ দেওয়া হতো। সেখানে লেখা থাকত ক’দিন ধরে জ্বর, সম্প্রতি বাড়িতে কোনো মেহমান এসেছেন কিনা, শরীর ব্যথা বা ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে কিনা, পাতলা পায়খানা হচ্ছে কিনা। ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ সূচক প্রশ্নশিট তারা পূরণ করে নিয়ে আসতেন। এরপর গুলশানের কার্যালয়ে বসেই ওই প্রশ্নশিট ধরে মনগড়া নেগেটিভ-পজিটিভ করোনা টেস্টের রিপোর্ট তৈরি করে জেকেজি। ১০টি প্রশ্নের মধ্যে যিনি পাঁচটির বেশিতে করোনার উপসর্গ রয়েছে এমন টিক চিহ্ন দিয়েছেন, তাকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়া হতো। অন্যদের দেওয়া হতো নেগেটিভ রিপোর্ট।

হানিমুন ট্রিপ : করোনার এই ভুয়া প্রতিবেদন তৈরির বিষয়টি জেকেজির প্রায় সব কর্মীর কাছে ওপেন সিক্রেট ছিল। তারা যাতে বিষয়টি বাইরে প্রকাশ করে না দেন সেজন্য ভিন্ন কৌশল হাতে নেন ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করার পর একদিন আনন্দ ট্রিপের নামে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে একজন নারী একজন পুরুষ কর্মীকে আলাদাভাবে পাঠানো হতো। এটার নাম দিয়েছিল ‘হানিমুন ট্রিপ’। এমনকি মহাখালীতে তিতুমীর কলেজের মাঠে জেকেজি যে বুথ স্থাপন করেছিল সেখানে প্রায় প্রতি রাতে মদের পার্টি বসত। জেকেজির কর্মীরা রাতভর সেখানে নাচানাচি করতেন। এ নিয়ে তিতুমীর কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে জেকেজির কর্মীদের মারামারির ঘটনা ঘটে।

বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি একশ’ ডলার : স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য জেকেজির হটলাইন নম্বর ছিল। ওই নম্বরে কেউ ফোন করলে তার বাসায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা স্যাম্পল কালেকশন করতেন। আবার অনেকে জেকেজির বুথে এসে স্যাম্পল দিতেন। বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে করোনার টেস্টের জন্য জনপ্রতি সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হতো। আর কোনো বাসায় মাঠকর্মীদের যাতায়াত বাবদ নেওয়া হতো এক হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি প্রতি টেস্টের জন্য একশ’ ডলার নেওয়া হতো। যদিও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ভিত্তিতে বিনামূল্যে তাদের স্যাম্পল কালেকশন করার কথা ছিল।

যেভাবে নার্স ও তার স্বামী চাকরিচ্যুত : জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই জেকেজিতে চাকরি করতে তানজিনা পাটোয়ারী নামে এক নার্স ও তার স্বামী হুমায়ুন কবীর। পরীক্ষা ছাড়াই করোনার টেস্ট রিপোর্ট হাজার হাজার মানুষকে দেওয়া হচ্ছে- এটা প্রথমে মেনে নিতে পারেননি তানজিনা। তিনি জেকেজির সব মাঠকর্মীর সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। মাসে তার বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। তবে এক পর্যায়ে তানজিনা বলেন, ‘স্যাম্পল সংগ্রহের পর যদি এ ধরনের ভুয়া রিপোর্ট তার মাধ্যমে করানো হয়, তাহলে তাকে বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে।’ এটা জেকেজির কর্ণধার আরিফ চৌধুরীকে জানিয়ে দেন তানজিনা। বেতন বাড়ানোর কথা শোনার পরপরই জেকেজি থেকে স্বামী হুমায়ুন কবীরসহ তানজিনাকে চাকরিচ্যুত করেন আরিফ চৌধুরী। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারানোর পর এই দম্পতি নিজেরা পুরনো চুরিবিদ্যা কাজে লাগান। একটি সাইট থেকে আশকোনার বাসায় বসেই তৈরি করতে থাকেন করোনার ভুয়া সনদ। তানজিনা স্যাম্পল সংগ্রহ করতেন আর ঘরে বসে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করতেন তার স্বামী। জেকেজির কাছ থেকে শেখা বিদ্যা কাজে লাগিয়ে এই দম্পতিও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মাসখানেকের করোনা বাণিজ্যের টাকায় একটি নতুন প্রাইভেটকার কেনার কথা ভাবছিলেন হুমায়ুন কবীর। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর নকল সার্টিফিকেট বাণিজ্যের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন এই দম্পতি।

কে এই ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী : ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর জীবনও রূপকথার মতো। আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্য একজন লন্ডনে। আর আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় আরিফের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছেন। তদন্ত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি ভাগিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামে এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা আর অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা। স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্ট করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী। পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন ডা. সাবরিনা। এ ছাড়া জেকেজির এক কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনায় গুলশান থানার আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করেন সাবরিনা।

আরিফ যেন আরেক ‘সাহেদ’ : সংশ্নিষ্টরা বলছেন, জেকেজির আরিফ চৌধুরী যেন রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার বহুরূপী প্রতারক আরেক মোহাম্মদ সাহেদ। সাহেদের মতো আরিফেরও একাধিক নাম। ভোটার আইডিতে নাম আরিফ মিয়া থাকলেও নিজেকে পরিচয় দিতেন আরিফ চৌধুরী নামে। আরিফ মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত। নিজে নিয়মিত ইয়াবা খান। গ্রেপ্তারের পর তেজগাঁও থানার আনা হলে মাদকের জন্য ছটফট করতে থাকেন। মাদক না পেয়ে এক পর্যায়ে থানার সিসি ক্যামেরাও ভেঙে ফেলেন তিনি। এ ছাড়া তার প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মী আরিফকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় জড়ো হন। তারা থানার বাইরে হট্টগোল করতে থাকেন। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নেপথ্যে আরও রাঘববোয়াল : জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেজিস্টার চিকিৎসক হিসেবে চাকরিরত অবস্থাতেই জেকেজির চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন ডা. সাবরিনা। কীভাবে কার মাধ্যমে এই কাজ হাতিয়ে তিনি হাতিয়েছেন, সে ব্যাপারে চলছে অনুসন্ধান। পুলিশের সন্দেহ, এর সঙ্গে প্রভাবশালী রাঘববোয়ালরা জড়িত। জেকেজি অবৈধ কর্মকাে র বিষয়ে তদন্ত কাজ গুছিয়ে এনেছে পুলিশ।

তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘জেকেজির সঙ্গে কারা কীভাবে জড়িত, তা তদন্তে উঠে আসছে। প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। ডা. সাবরিনাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।’