ফারজানা নাজ শম্পা: আনোয়ার দোহা একজন অমায়িক সদালাপী ব্যক্তিত্ব যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কানাডায় মূলধারায় বাংলা বইয়ের প্রসার ও বাণিজ্যিকি করণে নিবেদিত আছেন। বেঁচে থাকার ছক কাটা জীবন হতে একটু দূরে থেকে স্বতন্ত্র ধারায় চিন্তা করেন আর হৃদয়ে ধারণ করেন বাংলাদেশের দেশাত্মবোধের ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কানাডায় মূলধারায় বাংলা বইয়ের সহজলভ্যতার অভাব জনিত শুন্যতা তাঁকে তাড়িত করতো সেই অদম্য বাসনা হতে কানাডায় বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠন অধ্যুষিত জনপ্রিয় ড্যানফোর্থ সড়কে ২৯৭২ ড্যানফোর্থ এভিনিউ’তে নিজের শেষ সম্বলকে পুঁজি করে গড়ে তুলেন ‘এটিএন মেগা স্টোর’ (atnmegastore@gmail.com) নামের প্রতিষ্ঠান।

কানাডার পরবাসী বাঙালি ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁর বাংলা ভাষা সাহিত্য ও কৃষ্টির আবহ লালিত উপকরণ সম্ভারে পূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে একটি বিশেষ আলাপচারিতায় যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে প্রথমে আমার নিউইয়র্ক হতে কানাডায় আগমন। বাংলাদেশের দেশাত্মবোধ হৃদয়ে লালন করে ২০০২ সালে প্রাথমিকভাবে ধ্রপদী ও আধুনিক বাংলা গান চলচ্চিত্রর অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট, সিডি ইত্যাদি দিয়ে যাত্রা শুরু করি।

পরবর্তীতে স্থানীয় বাংলা বইপ্রেমী কানাডা প্রবাসী কয়েকজনের বিশেষ উৎসাহে কানাডায় বাংলাভাষা সাহিত্য বিকাশের নিরিখে হৃদয়ে লালিত আমার অদম্য এবং সুপ্ত ইচ্ছের সফল বাস্তবায়ন ঘটে ২০০৬ সাল হতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সব ধরনের বই, অভিধান, বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উৎসব সাময়িকী যেমন ঈদ ও পূজার বিষয়ে অন্যান্য উৎসব সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে সেই যাত্রা শুরু করে এখনো পর্যন্ত পথ চলছি’। কোন আদর্শ প্রেক্ষাপট তাঁকে এই উদ্যোগে প্রাণিত করেছিল সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি মূলত হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবাসে আমেরিকা ও কানাডা কয়েকটি উচ্চতর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেই। কানাডায় হিসাব বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষক রূপে দীর্ঘ সময় কর্মরত ছিলাম। তবে কানাডায় মূলধারায় ও অভিবাসী বাঙালির অঙ্গনে বাংলা ভাষার প্রসার পরিচিতি অব্যাহত রাখার তাগিদ ও বাংলা বইয়ের প্রাপ্তির শুন্যতা অন্তরে তীব্র তাড়না আমাকে বাংলাদেশের স্বকীয় পরিচয় সমৃদ্ধ এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ে লালিত বাংলা বইয়ের দোকান গঠনের সিদ্ধান্ত নেবার শক্তি দেয়।’

সুসাহিত্যের মাধ্যমেই সুন্দর জীবনবোধসম্পন্ন জাতি গড়ে তোলা সম্ভব, তাই কানাডায় অধিবাসী-প্রবাসীদের ও পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস লালিত ক্ষেত্র সমুন্নত রাখার নিরিখে তাঁর এই উদ্যোগ। তাঁর অনুকরণীয় জীবন দর্শন আদর্শেও বিশ্বাস প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘একজন বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি দায়বদ্ধতা ছোটবেলা থেকে বইয়ের সাথে আমার গভীর সম্পৃক্ততা এবং অপরকে ভাল বই পড়ানোর মানসিক তৃপ্তি এবং এই প্রক্রিয়ায় সুকুমার বিকাশে এই দর্শনেই কানাডায় বাংলা বই বিপণন ও স¤প্রসারণে আগ্রহী হয়েছি। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবু সায়িদের জীবনবোধ আমার অনুকরণীয় আদর্শ।’ তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বইয়ের সংগ্রহ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘দুই বাংলার বরণীয় লেখকদের স্মরণীয় জনপ্রিয় লেখা, উপন্যাস ও কবিতা, অনুবাদ গল্প সমৃদ্ধ সকল বয়সের পাঠক উপযোগি বই আমাদের সংগ্রহে আছে। শিশুদের জন্য বাংলা বর্ণ শেখা, গণিত ও সংখ্যা গণনা, ছড়া, কবিতা ও গল্পের বই এবং কিশোরদের জন্য ফিকশান, নন-ফিকশান সব ধরনের উপন্যাস, গল্প ও কবিতাসহ বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন ধর্মীয় বই সংগ্রহে রয়েছে। পাঠকদের চাহিদা অনুসারে অর্ডার নেয়া হয়। বাংলা সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন করে যেমন মৃৎ শিল্প, পোড়ামাটি, বাঁশ, বেত ও কাঠজাত মনকাড়া গৃহসজ্জা, চিত্র ও উপহার সামগ্রী, বাংলাদেশের পতাকা ও পতাকা খচিত টি-শার্ট, সুভেনীর, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ইতিহাস ধারণ বা লালন করে না, এমন পণ্য সামগ্রী আমি আমাদের সংগ্রহে রাখি না।’

নিজের জন্ম, পরিবার ও শিক্ষাজীবন ও জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘আমার জন্ম ১৯৫৪ সালের অগাস্ট মাসে বৃহত্তর কুমিল্লার চাঁদপুর জেলায়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করি, আমার পড়ালেখার বিষয়ের সাথে যদিও ভাষা-সংস্কৃতির যোগাযোগ কম তথাপি আমার বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতি অদম্য নেশা সদাই আমাকে আকৃষ্ট রাখতো। কর্ম দক্ষতার প্রসারে দেশে বিদেশে হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একাধিক পেশাভিত্তিক ডিপ্লোমা নিয়ে আমার অধ্যায়ন জীবনের পরিধি প্রায় ৩৫ বছর। আমাদের ৪৩ বছরের বিবাহিত জীবনে তিন কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা আমি। কন্যারা সবাই বিবাহিতা এবং স্বামী সন্তানদের নিয়ে টরেন্টোতে আছেন। আমার স্ত্রী শুধু আমার জীবনেরই নয় আমার ব্যাবসায় সার্বক্ষণিক সঙ্গিনী। আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত যখন বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করি এবং “কাজীর সামনে কবুল বলা”। আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী অপার শুন্যতা হতে সৃষ্টি “পিতা ও মাতার ম্তৃ্যু শোক।” আমার অবসর মেলে খুব কম। আমার মতে অবসর হলো এক কথায় আগামী কালের জন্য মগজ ধোলাই।’

তাঁর পছন্দের সাহিত্যিকদের বিষয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল ‘দুই বাংলার প্রায় সব লেখকই আমার প্রিয়, তবে সবার লেখাই যে আমার সম মাত্রায় ভালো লাগে এমন নয়, রম্য রসাত্মক লেখা বেশি আকৃষ্ট করে। তাঁর আগ্রহের তালিকায় আছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, জসিমউদ্দিন, আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ প্রমুখ। ভ্রমণ, শপিং আর ভাল কোন বই সংগ্রহ করে অন্যকে পড়ানো আমার শখ বলতে পারেন। অদূর ভবিষ্যতে কানাডার বাংলা সাহিত্য অনুরাগী এবং সংস্কৃতি প্রেমীদের সহযোগিতায় টরেন্টোতে একটি বাংলা পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা তাঁর আগামীর কর্ম পরিকল্পনা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনা এবং গবেষণা সম্পর্কে তাঁর মতামত ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা অবশ্যই হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো এক্ষেত্রে প্রকৃত গবেষণার চেয়ে অনেক লোক দেখানো বা রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত হয়ে পড়ছে যা আমার বিবেচনায় সঠিক দিক নির্দেশনা বিহীন উদ্যোগ। মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ দেশাত্মবোধের অবস্থান হতে কাজ করতে হবে।’ তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমার প্রাপ্তির অভিজ্ঞতায় কঠোর বাঁধা এবং উৎসাহ দুটোই ছিল। বাংলা বইকে কানাডায় মূলধারায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে আজকের গ্রহণযোগ্য স্থানে নেবার অভিপ্রায়ে আমাকে প্রচুর কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে, কানাডায় হাজার হাজার ডলার ভর্তূকি দিতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তবে আমার শখ বা দেশপ্রেম দুই কারণে কোন বাঁধাই আমাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না এবং আমি হাল ছাড়িনি।

ভাল বই আমাদের পরিশুদ্ধ মনন গঠন এবং বিশুদ্ধ চিন্তা করতে শেখায়। এই বোধকে সামনে রেখেই আনোয়ার দোহা টরেন্টোতে অগ্রসর হয়েছেন। টরেন্টোতে সংক্ষিপ্ত সফর এবং আনোয়ার দোহা ভাইয়ের দোকানে যখনই গিয়েছি তিনি উষ্ণ আন্তরিকতায় ও পারিবারিক আতিথ্যে আমাদের ভরিয়ে রেখেছেন। আমি লিখি সেটা অবগত হয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাঠ ও কেনার নির্দেশনা ও বই উপহার দিয়েছেন। আমাদের আলাপচারিতায় অমায়িক সদালাপী এবং দেশপ্রেমিক এই প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব অনর্গল বলেছিলেন বাংলাদেশের অশ্রুত ইতিহাসের মূল্যবান বিভিন্ন দিক। কানাডায় বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারন করে শ্রদ্ধাভাজন আত্মপ্রত্যয় দীপ্ত এই ব্যক্তিত্বের উদ্যোগ সুদীর্ঘ সফলতা লাভ করুক।

আনোয়ার দোহা ভাইয়ের কানাডার মূলধারায় বাংলা বইয়ের দীর্ঘ পথযাত্রায় মাঝে মধ্যেই ‘এটিএন মেগাস্টোর গ্রন্থনীড়ে কানাডায় বসবাসরত এবং কানাডায় সফরকারী বাংলা ভাষা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী সাহিত্যিক ও সাংষ্কৃতিক গুণীজনের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আর কানাডার বাংলা সাহিত্য ইতিহাস অনুরাগী পরবাসী পাঠক লেখকসহ অভিবাসী পাঠকরা খুঁজে পায় দেশের স্বকীয় আত্মপরিচয় সমৃদ্ধ চিন্তার আনন্দেলোক। কোভিড মহামারীকালিন সময়ে কানাডায় বাংলা বইয়ের ক্রেতা সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও আনোয়ার দোহা দমে যাননি। কানাডা ও উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিরা তাঁর প্রতিষ্ঠান হতে বই কিনে বাংলা ভাষী ও বাংলাদেশিরা তাঁদের জাতিগত আত্মপরিচয়জাত চিন্তার উত্তরণ ঘটিয়ে আনোয়ার দোহা ভাইয়ের অনন্য উদ্যোগের পাশে থাকবেন সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

ফারজানা নাজ শম্পা : লেখক ও সাংবাদিক, হ্যালিফ্যাক্স, নোভা স্কশিয়া