ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৩তম ভার্চুয়াল আসরটি মে মাসের ২০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকারদের নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি নিয়ে বলেন ‘রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার’ বইয়ের লেখক, রবীন্দ্র গবেষক পীতম সেনগুপ্ত। বিভিন্ন স্বরলিপিকারদের স্বরলিপি করা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনায় ছিলেন গুণী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী-শিক্ষক তানিয়া মান্নান ও মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা। সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।
‘গীতবিতান’-এ রবীন্দ্রসঙ্গীতের পুরোপুরি পরিচয় মেলে না। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শব্দটি পূর্ণতর রূপ পায় ‘গীতবিতান’ ও ‘স্বরবিতান’ এই দুই বইয়ের (স্বরবিতানের অনেক খণ্ড) সমন্বয়ে। কাজেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং প্রধান বিষয় স্বরবিতানকে সবার আগে মান্যতা দিতে হয়। স্বরলিপি সংক্রান্ত বিতর্কের বিষয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমীরা কমবেশি সবাই জানেন। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একেবারেই হয় না তা হলো – রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি লেখার ইতিহাস এবং স্বরলিপি-রচয়িতাদের প্রসঙ্গ। অল্প কয়েকজন জনপ্রিয় স্বরলিপিকারদের নামটুকু ছাড়া অধিকাংশ রবীন্দ্রগানের অনুরাগীদের জানা নেই কবির গান শোনার যে সৌভাগ্য হচ্ছে তার পেছনে কোন্ কোন্ গুণী মানুষের অসামান্য অবদান কাজ করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কমবেশি দু-হাজার গানের মধ্যে মাত্র দু-একটি গানের স্বরলিপি নিজে করেছিলেন। ১৬২তম রবীন্দ্রজয়ন্তীতে, সেই অনালোচিত-ব্রাত্য রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার এবং তাঁদের স্বরলিপি করা রবীন্দ্রগানের পরিবেশনা নিয়েই ছিল এবারের পাঠশালার আসর।
‘রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার’ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। প্রকাশক কলকাতার সাহিত্য সংসদ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে – ‘রবীন্দ্র-গানের সকল স্বরলিপিকারদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।’ বইয়ে ৩২ জন রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার সম্পর্কে লেখা আছে। আরও আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানের বর্ণানুক্রমিক সূচি, রাগ/সুর ও তালসহ রচনাকাল এবং স্বরবিতানের নাম্বার ও স্বরলিপিকারদের নাম।
আলোচক পীতম সেনগুপ্ত ও সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলীর মধ্যে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলাপচারিতার মাধ্যমে রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকারদের নিয়ে কয়েকটি ভাগে আলোচনা হয়।
আসরের শুরুতেই স্বল্প আলোচিত-অনালোচিত স্বরলিপিকারদের তালিকা একটি ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। স্বরলিপিকারদের মধ্যে আছেন – অনাদিকুমার দস্তিদার, অরুন্ধতী দেবী চট্টোপাধ্যায়, অশোকা দেবী চৌধুরী, আর্নল্ড এড্রিয়েন বাকে, ইন্দিরা দেবী চৌধুরী, কাঙালীচরণ সেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিভা দেবী চৌধুরী, প্রফুল্লকুমার দাস, বামনমোহন শিরোদকর, বিদ্যাধর ভেঙ্কটেশ ওয়াঝালকার, বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়, ভি বালসারা, ভীমরাও হসুরকার শাস্ত্রী, মোহিনী দেবী সেনগুপ্ত, রমা কর মজুমদার, রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শৈলবালা রায়, সমরেশ চৌধুরী, সরলা দেবী, সাহানা দেবী, সুধীরচন্দ্র কর, সুভাষ চৌধুরী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, সুশীলকুমার ভঞ্জচৌধুরী, হিমাংশুকুমার দত্ত, অবনীভ‚ষণ গোস্বামী, কৃষ্ণকিশোর দাস, দিলীপকুমার রায়, প্রিয়নাথ রায়, প্রেমলতা দেবী, বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর স্টাফ নোটেশন করেছেন – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, হার্বার্ট আর্থার পপলে, দ্যানিয়েঁল আল্যাঁ ও আর্থার গেডেস।
রবীন্দ্রনাথের গান সংরক্ষণের পেছনে থাকা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কোথাও সচরাচর আলোচনা হয় না। অথচ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ এই বহুল জনপ্রিয় বিষয়টি কিন্তু শুধুমাত্র ‘গীতবিতান’ গ্রন্থের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় না। ‘গীতবিতান’-এর পাশাপাশি ‘স্বরবিতান’ (৬৫ খণ্ড) এর সংযোগেই ‘রবীন্দ্রসংগীত’-এর আসন। কেন এমনটা বলা হয় – এর জবাবে পীতম সেনগুপ্ত জানিয়েছেন ‘গীতবিতান’-এ রবীন্দ্ররচিত প্রায় দু-হাজারের মতো গান মুদ্রিত আছে। এর মধ্যে আঠারোশর মতো গান সুরে বদ্ধ আছে, যা বিভিন্ন খণ্ডের স্বরবিতানে লিপিবদ্ধ। এর বাইরে বাকি দু-শোর মতো গানের সুর আর আজ পাওয়া যায় না। হারিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ সেই সমস্ত গানের সুর করে থাকলেও কাছে-পিঠে স্বরলিপি করতে জানা কোনো সঙ্গীতবিশেষজ্ঞকে পাননি সুরটিকে স্বরলিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণের জন্য। ফলে গীতবিতান-এর সেই গান গীতিকাব্য হিসেবে মুদ্রিত থাকলেও তা গাওয়া যায় না। সেসমস্ত গানকে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ বলা যায় না। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ বলতে গেলে স্বরবিতানের আশ্রয় তাই অনিবার্য।
রবীন্দ্রগানের স্বরলিপি রচনার আদিকাল থেকে শেষ পর্যন্ত নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এই আলাপচারিতায়। রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকারদের নিয়ে পীতম সেনগুপ্তর গবেষণায় জানা যায় রবীন্দ্রনাথ স্বরলিপি করেছেন তাঁর গানের। তবে সে সংখ্যা নিতান্তই কম। ১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিলাইদহ পর্বে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ১৪টি গান লিখেছিলেন। এর মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর লেখা ‘একি সত্য সকলই সত্য’ গানটি তিনি রেলপথে লিখেছিলেন। এই গানের স্বরলিপি কবি নিজেই করেছিলেন, স্বহস্তে লেখা সেই স্বরলিপি কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর কাছে ছিল। কবির প্রয়াণের তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেন ইন্দিরা দেবী। এবং দাবী করেন সম্ভবত এটাই কবির একমাত্র নিজের করা স্বরলিপি। কিন্তু এই শিলাইদহ পর্বেই তিনদিন আগে অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর কবি লিখেছিলেন ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’ গানটি। এবং এই গানটি একমাস পর প্রথম মুদ্রিত হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকার ১৩০৪ সনের কার্তিক সংখ্যায়। সেখানে এই গানের স্বরলিপিও প্রকাশিত হয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার স্বরলিপিকারের নাম মুদ্রিত হয় রবীন্দ্রনাথের। আরও অবাক করার বিষয় হলো দু-টি গানের স্বরলিপি কিন্তু আকারমাত্রিক স্বরলিপির আদিরূপের। তাই গবেষক পীতম সেনগুপ্ত জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবেই স্বরলিপি করতে জানতেন এবং তার একাধিক প্রমাণও আছে, যেমন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে গেহেন্দ্রর বিয়েতে পর্তুগিজ সাহেব লোবোর ব্যান্ডে বাজানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজের দু-টি গান ‘শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল’ ও ‘শান্তি করো বরিষণ নীরব ধারে’র নোটেশন লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার থেকে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে শান্তিনিকেতন পর্বে একাধিক স্বরলিপিকারদের পাশে পেয়েছিলেন। তাই নিজে স্বরলিপি রচনা থেকে বিরত থেকেছেন।
পীতম সেনগুপ্তের আলোচনায় নানা প্রশ্নের মাধ্যমে জানা গেছে কীভাবে আকারমাত্রিক স্বরলিপি তৈরি হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়। সেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মূখ্য ভ‚মিকার কথাও আলোচিত হয়েছে। এখানেই আলোচক জানিয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্পাদিত ‘বালক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার ‘সহজ গান শিক্ষা’ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বল্ গোলাপ মোরে বল্’ গানটির স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির গুণী সংগীতজ্ঞ-কন্যা প্রতিভা দেবী স্বরলিপিটি করেছিলেন। এবং এটাই কবির গানের প্রথম মুদ্রিত স্বরলিপি। এমন করেই জানা যায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা ও সুরে বদ্ধ করার পর তা স্বরলিপি আকারে সংরক্ষণের জন্য কেমন করে তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের পাশে পেয়েছিলেন। বিশেষ করে এই পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা দেবী, ইন্দিরা দেবী, ভাগ্নি সরলা দেবী, নাতনি অশোকা দেবী এবং নাতি দিনেন্দ্রনাথকে পাশে পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে দিনেন্দ্রনাথ এবং ইন্দিরা দেবীর ভ‚মিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির সম্পর্কের রসায়ন জানতে চাইতে আলোচক জানান, কবির জীবনের দীর্ঘসময়ে তাঁর গানের ভাণ্ডারের কাণ্ডারী হিসেবে দিনেন্দ্রনাথ অত্যন্ত গর্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের মধ্যে বৈষয়িক ব্যাপারে কবি তাঁর এই পরমপ্রিয় নাতিকে ভুল বুঝতে শুরু করেন। দিনেন্দ্রনাথ কবির গানের সুররক্ষণে সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না এমনতর নিন্দা সহচরদের কাছে যেমন শুনেছেন, তেমনই নিজেও প্রকাশ্যে নাতির বিরুদ্ধে খুব কঠিন কথা বলেছেন। দিনেন্দ্রনাথ একরাশ অভিমান নিয়েই সবার আড়ালে শান্তিনিকেতনের মায়া কাটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। অথচ তাঁর রবিদা’র জন্য তিনি নিজের অমন প্রতিভাকে বিকশিত না-করে রবীন্দ্রসঙ্গীতেই মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। এমন ত্যাগ কবির অন্য কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত-সহচর করেননি।
আশ্চর্য লাগে সেইসময়ে কবির নীরবতা দেখে। এই দিনেন্দ্রনাথকেই তো তিনি শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকদের সঙ্গীতচর্চার জন্য নিয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁর হাতেই রবীন্দ্রগানের একদল স্বরলিপিকার গড়ে উঠেছিল। কবির গানের স্বরলিপি লেখনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য। এদের মধ্যে একে একে অনাদিকুমার দস্তিদার, রমা কর মজুমদার, সুধীরচন্দ্র কর, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার প্রধান। এঁরা সকলে মিলে রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের বহু গান স্বরলিপিবদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে শৈলজারঞ্জন মজুমদার। আবার শৈলজারঞ্জনের কাছে স্বরলিপি করতে শিখেছিলেন সমরেশ চৌধুরী। এছাড়াও শান্তিনিকেতনে সুশীলকুমার ভঞ্জচৌধুরী, ভীমরাও শাস্ত্রী, বি.বি ওয়াঝালকার, প্রফুল্লকুমার দাস, সুভাষ চৌধুরী প্রমুখেরাও শান্তিনিকেতন সঙ্গীতভবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতন ডাচ সঙ্গীতজ্ঞ আর্নল্ড অ্যাড্রিয়েন বাকে’র নাম আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। তিনি শান্তিনিকেতনে সস্ত্রীক এসে রবীন্দ্রসঙ্গ লাভ করেন। দিনেন্দ্রনাথের কাছে বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন। রবীন্দ্রনাথ আদর করে এই দম্পতির বাংলা নাম দিয়েছিলেন ‘আরুণি’ ও ‘করুণা’। পরে ১৯৩৫ সালে Twenty Six Songs of Rabindranath Tagore বইটি লেখেন, যেখানে তাঁর করা ২৬টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্টাফ নোটেশন আছে। স্টাফ নোটেশন প্রসঙ্গে আলোচক পীতম সেনগুপ্ত রবীন্দ্রগানের প্রথম স্টাফ নোটেশন নিয়ে বলেন। রবীন্দ্রনাথের যৌবনকালের বন্ধু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীই প্রথম রবীন্দ্রনাথের ন-টি গানে স্টাফ নোটেশন লিখেছিলেন। নিজে অত্যন্ত ভালো বেহালাবাদক ছিলেন বলেই স্টাফ নোটেশন তৈরির প্রতি তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল। স্টাফ নোটেশন সাধারণত বাদ্যযন্ত্রে গানের সুর বাজানোর জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। এঁরা দু-জন ছাড়াও আরও কয়েকজন বিদেশি সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রগানের স্টাফ নোটেশন করেন। ব্রিটিশ সংগীতবিদ হার্বাট আর্থার পপলে আছেন। আছেন ফরাসি সঙ্গীতজ্ঞ দানিয়েল আল্যাঁ এবং স্কটিশ সঙ্গীতজ্ঞ আর্থার গেডেস।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও শান্তিনিকেতন পর্ব বাদ দিলে আর বাকি থাকে বাইরের জগত। পীতম সেনগুপ্তর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, সেই সংখ্যাও নেই নেই করে কম নয়। এরমধ্যে ব্রাহ্মসমাজের দুই গায়ক আছেন, যাঁদের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। এরা হলেন কাঙালীচরণ সেন এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। উনিশ শতকে আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত সভাগায়ক ছিলেন কাঙালীচরণ। সেই আমলে কাঙালীচরণ সেন-কৃত তিন খণ্ডের ‘ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি’ গ্রন্থমালার খুব চল ছিল। রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর খুবই হৃদ্যতা ছিল।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের স্বরলিপি সেই আমলে কাঙালীচরণ করেছিলেন। কবিও নিশ্চিন্তে ছিলেন। ঠিক এমনই নিশ্চিন্তে থাকতেন যখন তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছে পেতেন। সুরেন্দ্রনাথও আদি ব্রাহ্মসমাজের গায়ক ছিলেন। বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম পীঠস্থান বিষ্ণুপুরে তিনি এক সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্মেছিলেন। ‘গীতাঞ্জলি’র গানের সুর প্রথম স্বরলিপিবদ্ধ করেন সুরেন্দ্রনাথই। এমন আরও অনেকেই ছিলেন এই বৃত্তে। তবে ঠাকুরবাড়ির আঙিনা টপকে রবীন্দ্রগানের প্রথম স্বরলিপি রচয়িতার নাম শৈলবালা রায়। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি। ১৩০০ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের দু-টি গানের স্বরলিপি মুদ্রিত হয়েছিল। একটি গান ‘তোমার কথা হেথা কেহ ত বলে না’, অপরটি ‘এ কী এ সুন্দর শোভা’। সেই ‘ভারতী’ পত্রিকা জানায় যে এই দু-টি গানের স্বরলিপি করেছেন শৈলবালা রায়। কিন্তু কে এই শৈলবালা রায়, যিনি ঠাকুরবাড়ির সদস্য নন, অথচ রবীন্দ্রগানের স্বরলিপি রচনা করেছেন। বহু তথ্য ঘেঁটে গবেষক পীতম সেনগুপ্ত অবশেষে আবিষ্কার করেন শৈলবালাকে। শৈলবালার ডাক নাম ‘খুসি।’ ঠাকুরবাড়ির সদস্য না হলেও তাঁর নিয়মিত ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত ছিল। কারণ, স্বর্ণকুমারী দেবীর বড় মেয়ে হিরন্ময়ী দেবীর সহপাঠি ছিলেন ব্রাহ্মনেতা দুর্গামোহন দাশের কনিষ্ঠা কন্যা শৈলবালা। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। শৈলবালার বড় বোন অবলা দাশ, যিনি পরে জগদীশচন্দ্র বসুর সহধর্মিনী হন। এমনই একজন রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার হলেন মোহিনী দেবী সেনগুপ্ত। ‘এই তো তোমার আলোকধেনু’ গানটির স্বরলিপি তিনি করেন। কিন্তু তাঁর পরিচয় খুব সহজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তাঁর সম্পর্কে এটুকুই জানা গেছে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের গানের একজন দক্ষ গায়িকা ছিলেন এবং নজরুলের বহু গানের স্বরলিপি রচনা করেন। প্রসঙ্গক্রমে সাহানা দেবীর কথা উল্লেখ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের গানে সাহানা স্বরলিপি লিখেছিলেন। সাহানা তাঁর মাসি রবীন্দ্রনাথের স্নেহের পাত্রী অমলা দাশের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের এমন একটি গান শিখে নিয়েছিলেন যা দ্বিতীয় কারো জানা ছিল না। এমনকি স্বয়ং গন্ধর্বও সুর ভুলে গিয়েছিলেন গানটির। সেই ‘দিন ফুরালো হে সংসারী’ গানটি গেয়ে সাহানা কবিকে চমকে দিয়েছিলেন। সাহানার গান শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তুমি যখন আমার গান করো শুনলে মনে হয় আমার গান রচনা সার্থক হয়েছে।’ এ পর্যায়ে সাহানা দেবীর কণ্ঠে রেকর্ডকৃত এ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।
পীতম সেনগুপ্ত ও শিউলীর কথোপকথনে আরও অনেক স্বরলিপিকারের নাম ও প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্বরলিপিকারদের স্মরণে একগুচ্ছ রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের দুই প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তানিয়া মান্নান ও মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা। তাঁদের একক কন্ঠে একের পর এক গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
স্বরলিপিকার ভি বালসারার জন্মশতবর্ষে ও সাহানা দেবীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে আন্তরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়ে এবং রবীন্দ্র-গানের সব স্বরলিপিকারদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে, স্মরণ করে পাঠশালার এ আসরের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হয়।