মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

তেয়াত্তর…
এই সব কিছু ভেবে ২০১২ সালের ২ ফেরুয়ারি আমার অকালে হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে ছোট ভাই মিশেলের সাইত্রিশতম জন্মদিনে পাপিনিউ’র একেবারে কেন্দ্রভ‚মির এক জনাকীর্ণ কমিনিউনিটি সেন্টার থেকে আমার নেতৃত্বের প্রচারণা শুরু করেছিলাম। সেদিন সোফি আর আমার সন্তানরা আমার একবারে পাশে বসেছিল। আমি সেদিন উপস্থিত সবার উদেশ্যে বলেছিলাম, আমি এই নেতৃত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলাম মূলত দুটি কারণে, যার একটি হচ্ছে কানাডার প্রয়োজন একটি নতুন নেতৃত্ব আর কানাডার জনগণের চাই নতুন এক পরিকল্পনা। আমি এটাও সবাইকে জানিয়েছিলাম, আমি যদি এই লড়াইয়ে বিজয়ী হই, তবে আমি যে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুবো, সেটা হবে কানাডার মধ্যবিত্ত জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। আমি আরও বলেছিলাম, বর্তমান সরকার এ দেশকে সুন্দর করার জন্য তেমন কিছুই করতে পারেনি। আমাদের দেশের সৌন্দর্য্য, বৈচিত্রতা আর আমাদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য যে সুন্দর একটি দেশ তৈরীর কাজ সেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সর্বোপরি হার্পার সরকার আমাদের মধ্যে যে বিভেদ আর দ্ব›েদ্বর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে সেটা কোনভাবেই কানাডার জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। এখন আমাদের সময় হয়েছে এর অবসান ঘটানো। কানাডা পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এক দেশ, আমাদের এমন এক নেতৃত্বের প্রয়োজন যা আমাদের দেশের এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে এগুতে সাহায্য করবে এবং আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে মহিমান্বিত করবে।

এমনই এক চুলচেরা দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টা বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের মধ্যবিত্তদের শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয় ছাড়াও আরও অনেক দিক আছে যা আমাদের ভালোভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। এটা ধরে নেয়া হয়, আমাদের দেশের মূল শক্তির প্রকাশ ঘটে অটোয়ায়, আমাদের রাজধানী শহরে। আর এই সুন্দর মুহূর্তগুলো আসে মূলত রাজনৈতিক নেতাদের হাত ধরে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এটা কখনও সেখানে সৃষ্টি হয় না। এটা একটা আরেকটা শেখার বিষয় যা লিবারেলদের ভালোভাবে জানার দরকার ছিল। আমি আমার বক্তৃতাই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলাম, রাজনৈতিক শ্রেণী নয়, বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণীই দেশটাকে এক করেছে, বা টিকিয়ে রেখেছে। আর কানাডার এই সাধারণ মানুষদের আশা আর প্রত্যাশার মধ্যেই নিহিত আছে দেশের মূল জীবনী শক্তি। এই মানুষগুলো ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সুরে’র নতুন অভিবাসী হোক বা কুইবেক সিটিতে বাস করা দশ প্রজন্মের কানাডিয়ান হোক, যেই হোক না কেনো। কানাডার এমন সব নেতার প্রয়োজন যারা সাধারণ মানুষদের এই চাওয়া পাওয়াকে বুঝতে পারবেন, আর সেগুলো পূরণের জন্য কাজ করে যাবেন। অবশ্যই এমন কোন নেতার প্রয়োজন নেই যারা গুটি কতক মানুষের প্রত্যাশাকে পূরণ করার জন্য এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধারের জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকবেন।

আমি লিবারেলদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, খেয়াল করলে দেখা যায় সারা কানাডায় এই চিত্র বিরাজ করছে। এখন আমাদের প্রয়োজন, দেশের সাধারণ মানুষের এই আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমাদের এক নতুন ধারার রাজনীতির জন্ম দেয়া।

জাস্টিন ট্রুডো

বিগত কয়েক বছরে লিবারেলদের পক্ষে মূল্যবোধের ধারণাটা ধরতে পারা বা কিভাবে এটা তৈরি করা যেতে পারে সেটার উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না। এই কারণেই আমি বারবার বলি, লিবারেল পার্টি কানাডার জন্ম দেয় নাই, বরং কানাডায় লিবারেল পার্টির জন্ম দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আমার পার্টির দীর্ঘ সময় ধরে এত বেশী সফলতা পাওয়ার কারণ হচ্ছে, এটা ছিল কানাডার সব মানুষের আশা-প্রত্যাশা পূরণের এক আস্থার স্থান। সব সময়ই এটা ছিল সাধারণ মানুষের একবারে নাগালের মধ্যে। কিন্তু এই দিনগুলিতে সেটা লিবারেল পার্টির নেতারা ভুলতে বসেছে। আর এর জন্যে লিবারেল পার্টিকে এক চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।

এদের কেউ’ই মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে গুরুত্বের সাথে কিছু ভাবেও নি বা করেও নি। কিন্তু এটাতো একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কানাডা একটা বহুজাতিক সৌহার্দের দেশ, আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এখানকার মানুষরা যে যে স্তরেই থাকুক না কেনো নিজেদের এক অসাধারণ আগ্রহ আর গতিময় প্রচেষ্টায় নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায়। এই মানুষগুলো পৃথিবীর যে সংস্কৃতি থেকেই আসুক না কেনো, বা যে ধরনের বিশ্বাসই নিজেদের মধ্যে লালন পালন করুক না কেনো, তারা সবাই মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে, এই ভ‚মিই হচ্ছে সেই আবাসস্থল যেখানে বাস করবে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। এমনকি তারা তাদের নিজেদের জন্মভ‚মির চেয়েও এই ভ‚মিতে বাস করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং মনে করে, এটাই এখন তাদের নিজেদের ভূমি। তাদের এই ভাবনার মূলে রয়েছে রাষ্ট্র এই মানুষগুলোকে এমন ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এছাড়াও, এখানে এই মানুষগুলো পান এক ধরনের অর্থনৈতিক মুক্তি। এমন এক অবস্থায় আমরা যারা দীর্ঘ প্রজন্ম ধরে এখানে বাস করি, তারাও এই নতুন অভিবাসীদের খুব সহজেই নিজের করে নিই। এবং এই মানুষগুলোর এই ভ‚মির প্রতি ভাবনা এবং উপলব্ধিবোধ আমাদের খুব সহজেই তাদেরকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। তারা অন্য যে কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হোক না কেনো, এবং আমরা যদি সেই বিশ্বাসের সাথে একমত পোষণ নাও করি, সেক্ষেত্রে সেটা তেমন কোন বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পায় না। আমরা যখন এই সবাই মিলে এক সাধারণ এবং নিজেদের ভ‚মির স্বপ্নকে খুঁজে পায়, আর সবাই মিলে এই দেশকে আরও সুন্দরের পথে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখি, তখন আমরা সবাই সবার প্রতি এক স¤প্রীতির হাত বাড়িয়ে দিই। সবাই একে অপরের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। (চলবে)