ফরিদ আহমেদ : এলোকেশী যখন বিধবা হলো, তখন তার বয়স মাত্র আট বছর। হাস্য-বদনে পুতুল নিয়ে খেলা করছিলো সে। এমন সময়ে তার বিধবা হবার খবর এলো। বৈধব্য কী, সেটা তার বোঝার কথা না। এলোকেশী না বুঝলেও বড়রা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরেছিলো বলে এলোকেশীর মা উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে এলোকেশীকে ডেকে নিয়ে তার হাত থেকে সব গয়না খুলে নিলো। সবাই এমন হা-হুতাশ আর কান্নাকাটি করছে বলে এলোকেশীর মনেও খানিকটা ভয় তৈরি হলো। সেই ভয় থেকে তারও কান্না পেয়ে গেলো।
এলোকেশী যে সময়ে বিধবা হয়েছিলো, সেটা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। ওই সময়ে মেয়েদের জন্য বাল্যকালে বিধবা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা ছিলো। একেবারের দুধের বাচ্চা কন্যা শিশুদের জীবন সম্পর্কে কিছু বোঝার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। সেই বিয়ে আবার হতো দামড়া লোকজন এবং ঘাটের মড়া বৃদ্ধদের সাথে। ফলে, এই সমস্ত নিষ্পাপ কন্যারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেদের বিধবা হিসাবে দেখতো।
এই সামাজিক কুসংস্কারের সাথে আরেক কুসংস্কারও ছিলো। মেয়েগুলোর পুনর্বার বিয়ের ব্যাপারে সমাজের নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সেই সময়ে বিধবা বিবাহ অল্পস্বল্প চালু হলেও, মোটা দাগে সমাজ এটাকে নেতিবাচক চোখেই দেখতো। ফলে, এদের অনেকেই যৌবনে গিয়ে নানা প্রলোভনে বিপথে পা বাড়াতো। নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করলে সেটা ভিন্ন দিকে বাঁক নেবে, এটাই স্বাভাবিক।
এলোকেশীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। তবে, সেটা ঘটার আগে এলোকেশী কিছুটা পড়ালেখা শিখে ফেলেছিলো। ওই সমাজ ব্যবস্থাতে মেয়েদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। এলোকেশীর জন্যেও শিক্ষার বন্দোবস্ত কেউ করেনি। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা এলোকেশী কিছুটা পড়াশোনা শিখে ফেলে। তার ভাইগুলো সব পাঠশালাতে যেতো। পাঠশালা থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পরে এলোকেশী তাদের কাছে আবদার করে পড়াশোনা শিখতো।
শরীরের যৌবনের ছোঁয়া লাগতেই সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হতে থাকে এলোকেশীর শরীরে। তার রূপ যৌবনের কথা ছড়িয়ে গিয়েছিলো বাইরে। যে কারণে তাদের বাড়ির পিছনের বাগানে এক যুবক চলে আসে ছদ্মবেশে। নিয়মিত সে প্রেমসূচক বাক্য শোনাতে থাকে এলোকেশীর কানে। বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কিশোরী সেই সব প্রেমময় কথামালা শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠে। তার মন মোহিত হয়ে যায় যুবকের প্রেমে। বিধবা অলে স্বাভাবিক নিয়মে প্রেমিক যুবককে বিয়ে করা সম্ভব নয়। যে কারণে একদিন তার সাথে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এলোকেশী।
এলোকেশীর প্রেমিক যুবকের নাম ক্ষেত্র বাবু। ধনী পরিবারের সন্তান সে। এলোকেশীকে নিয়ে পালিয়ে গেলেও তাকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কারণ সে নিজেও বিবাহিত। তবে, তার বধূ নিতান্তই বালিকা বলে সেই বধূর প্রতি তার কোনো অনুরাগ জন্মায়নি। ক্ষেত্র বাবু এলোকেশীকে নিয়ে নতুন এক বাড়িতে ওঠায়। সহজ ভাষায় ক্ষেত্র বাবুর রক্ষিতাতে পরিণত হয় এলোকেশী। ওই সময়ের বাবু সংস্কৃতিতে ধনী লোকদের জন্য রক্ষিতা রাখাটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিলো। ফলে, ক্ষেত্র বাবু আর এলোকেশীর সম্পর্ক নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ক্ষেত্র বাবুর পরিবার বিষয়টা জানতো। তারা এই সম্পর্ককে মেনেও নিয়েছিলো।
সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এক সময় অসুস্থ হয়ে ক্ষেত্র বাবু মারা গেলে। নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। ক্ষেত্র বাবুর পরিবারও আর তাকে লালন পালন করতে ইচ্ছুক নয়। এই রকম অবস্থায় এলোকেশীর জন্য একটাই মাত্র রাস্তা খোলা ছিলো। নিজের রূপ এবং যৌবনকে বিক্রি করা। সুশ্রী হবার কারণে কাজটা সহজও হয়ে গিয়েছিলো তার জন্য।
কাজটা সহজ হলেও মানসিক পীড়ন থেকে এলোকেশী কখনো মুক্তি পায়নি। নিজেকে ঘোর পাতকিনী বলে বিবেচনা করতো সে। প্রতিনিয়ত ভুগতো আত্ম-দংশনে। এই দংশন থেকে, পাপাচার থেকে কীভাবে প্রতিকার পাবে সেটা নিয়ে সবসময় ভাবতো সে।
এই রকম সময়ে তার বাইবেলের কথা মনে পড়ে। ক্ষেত্র বাবু বেঁচে থাকার সময়ে এক খ্রিস্টধর্ম প্রচারিকা তাকে বাইবেলটা দিয়েছিলো। পড়ালেখা জানতো বলে কিছুটা পড়েছেও সে। তবে, এই আত্ম-দংশনের কালে সেই বাইবেলটাই তার বন্ধু হয়ে ওঠে। এর মাঝেই নিজের পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পায় সে। বাইবেলে তার মতোই এক ব্যভিচারী নারীকে লোকজন পাথরাঘাতে মারতে চাইলে, যীশু বলেছিলেন তোমাদের মধ্যে যে কোনো পাপ করো না, সে প্রথম পাথরটা ছুড়ে মারো। এই কথা শোনার পরে পাথর ছুড়তে ইচ্ছুক সব লোক সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো। বাইবেলের ভ্রষ্টা নারী যদি পরিত্রাণ পেতে পারে, সে কেনো পাবে না, এই চিন্তাই এলোকেশীকে বাইবেলের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
এর মধ্যে এলোকেশী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যায়। যেখানে এক ধার্মিক খ্রিস্টান নারীর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে । তার অনুপ্রেরণা হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে এলোকেশী তার পাপের জীবনকে বিসর্জন দেয়। পরিশ্রম করে উপার্জন করা শুরু করে। বেশ্যাবৃত্তি করে উপার্জনে কোনো সুখ না পেলেও, কায়িক পরিশ্রমের এই উপার্জনে আনন্দ আর সুখের জীবন হয়ে ওঠে তার।
উপরে যে গল্পটা বললাম, সেটা ‘এলোকেশী বেশ্যা’ নামের একটা ক্ষুদ্র উপন্যাস বা গল্পের কাহিনি। এই বইটা প্রকাশিত হয়েছিলো হয়েছিলো ১৮৭৬ সালে। এর লেখকের নাম পাওয়া যায় না। প্রথম সংস্করণে এর প্রকাশকের নাম দেওয়া ছিলো বিবি মিশ লেসলি। অনেকের ধারণা এইান নারীটিই এই বইয়ের লেখক। এই বইটা প্রকাশিত হয়েছিলো বটতলা থেকে। উনিশ শতকে নামী পরিবার কিংবা সমাজপতিদের পরিবারের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা বটতলা থেকে প্রকাশিত হতো। এই সব বইয়ে বেশিরভাগ সময়েই লেখকের নাম থাকতো না। বা থাকলেও সেটা হতো ছদ্ম নাম। এইসব চটুল বইগুলোর সমাজে বেশ চাহিদা ছিলো। ফেরিওয়ালারা এইসব বই ঝুড়িতে করে নিয়ে গিয়ে শহরে ফেরি করতো। এখান থেকেই বটতলার সাহিত্য কথাটা এসেছে। এর মানে হচ্ছে চটুল সাহিত্য।
‘এলোকেশী বেশ্যা’ যে সময়ে বটতলা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, সেই সময়ে বেশ্যাদের নিয়ে বটতলা থেকে বই বের হবার হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। এর পিছনে ছিলো ১৮৬৪ সালে করা চৌদ্দ আইন। চৌদ্দ আইন জারি করা হয়েছিলো বেশ্যাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্বাস্থ্যসম্মত করার জন্য।
বেশ্যাবৃত্তি পৃথিবীর আদিমতম পেশা। পৃথিবীতে অতীত কোনো সমাজ ব্যবস্থাই নারীদের সমান অধিকার দেয়নি, সমান সুযোগ সুবিধা দেয়নি। ফলে, বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য বহু নারীই বেশ্যাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছে। উনিশ শতকেও এই পেশা উজ্জ্বলভাবে টিকে ছিলো কোলকাতাতে। কোলকাতায় তখন বাবুয়ানার যুগ। নতুন বাবুরা বেশ্যাগমনে সিদ্ধহস্ত। কারও কারও ছিলো বাধা রক্ষিতা। এর সাথে রয়েছে অসংখ্য ব্রিটিশ সৈন্য। এই সৈন্যদের বেশিরভাগই অবিবাহিত। এদেরও প্রয়োজন ছিলো তাই পতিতা গমনে। এতে করে সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের যে খুব একটা মাথাব্যথা ছিলো তা নয়। মাথাব্যথাটা শুরু হয় এই পেশার কারণে সৃষ্ট যৌন ব্যাধির কারণে। সাধারণ লোকজন যৌন রোগে আক্রান্ত হলে সরকার হয়তো গুরুত্ব দিতো না। কিন্তু, ব্রিটিশদের কাছে তাদের সৈন্যেদের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। এদের শক্তির জোরেই তারা উপনিবেশকে শাসন এবং শোষণ করতো। সেই সৈন্যরা যখন যৌন রোগে সংক্রমিত হতে থাকে ব্যাপকহারে, তখন ব্রিটিশ সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।। বিপুল সংখ্যক অবিবাহিত তরুণ সৈন্যকে নারীসঙ্গ বঞ্চিত করে রাখা সম্ভব নয়। ফলে, পতিতাবৃত্তিতে উচ্ছেদ করার দিকে সরকার যায়নি। এর বদলে লক হাসপাতাল নামে বিশেষ একটা হাসপাতাল খোলা হয়। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে যে সব পতিতারা পরিছন্ন হিসাবে স্বীকৃতি পেতো, তারাই শুধুমাত্র সৈন্যদের কাছে যাওয়ার অনুমতি পেতো। এই ব্যবস্থা দিয়েও আসলে খুব একটা সমস্যার সমাধান করা যায়নি। অনেক সৈন্যই বাইরের পতিতালয়ে গমন করতো। ফলে, ১৮৬৮ সালে সরকার চৌদ্দ আইন জারি করলো পতিতাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য।
এই আইনে পতিতাদের রেজিস্ট্রি করতে হতো। রেজিস্ট্রি করতে গেলে আগে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো লাগতো। কেউ স্বেচ্ছায় করতে না চাইলে তাকে বাধ্য করারও ব্যবস্থা ছিলো। যে কাউকে ধরে এনে ডাক্তারি পরীক্ষার অধিকার পুলিশকে দেওয়া হয়েছিলো।
ডাক্তারি পরীক্ষা এবং পরিচ্ছন্নতার প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর কষ্টকর এবং যন্ত্রণাদায়ক ছিলো। অনেক মেয়েই পরীক্ষা করার পরে তলপেটে রক্তপাত ঘটে মারা গিয়েছিলো। ভয়ংকর এই আইন থেকে রক্ষা পেতে মেয়েরা শহর ছেড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে গ্রামে-গঞ্জে। কেউ কেউ ফরাসি শাসনাধীন ফরাসডাঙাতেও চলে যায় ব্রিটিশ আইন থেকে রক্ষা পেতে।
এই চৌদ্দ আইন নিয়ে সমাজ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রগতিশীল অংশ পতিতা মেয়েদের পক্ষ নেয়, প্রতিক্রিয়াশীলরা বিপক্ষে। দ্বিধা-বিভক্তির সময়েই বটতলা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে বেশ্যাদের নিয়ে অনেক রচনা। সেটারই ধারাবাহিকতা হচ্ছে ‘এলোকেশী বেশ্যা’।
‘এলোকেশী বেশ্যা’-তে অবশ্য বেশ্যাদের সমস্যার চেয়েও খ্রিস্টধর্ম প্রচারণার দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। এমন পতিত অবস্থাতেও যে খ্রিস্টধর্ম পরিত্রাতা হিসাবে আসতে পারে, সেটাই লেখক দেখাতে চেয়েছেন। অনেকটা হানা ক্যাথেরিন মুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বইয়ের মতো। ওই বইতেও লেখক খ্রিস্ট ধর্মের গুণগান গাইবার চেষ্টা করেছিলেন। ওই বইয়ের দুইটা প্রধান চরিত্র ছিলো। একটা হচ্ছে ফুলমণি, আর অন্যটা হচ্ছে করুণা।
ফুলমণি আদর্শ রমণী। যীশু খ্রিস্টকে ভালবাসে প্রাণ দিয়ে। খ্রিস্ট ধর্মের সব নিয়ম কানুন মেনে চলে। শুধু সে একাই না। তাঁর এই সুমতির কারণে তার স্বামীও একই রকমের ধর্মভীরু এবং মহৎ মানুষ। দু’জনেই সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছে ধর্মের আদর্শের। ফলে, তাদের সন্তানেরাও সব সভ্য এবং সুমতি সম্পন্ন। যে কারণে এই বাড়িতে সুখ উথলে ওঠে। এটা হয়ে ওঠে এক সুখ শালা।
অন্যদিকে করুণার আবার এতো ধর্ম-প্রীতি নেই। তার স্বামী মদ্যপ এবং দুষ্টু প্রকৃতির লোক। ধর্ম থেকে বিচ্যুতির কারণে সন্তানদেরও তারা দিতে পারেনি সুশিক্ষা। ফলে, করুণার বড় সন্তান বখে গিয়েছে। একদিন চুরি করতে গিয়ে পিটুনি খেয়ে মারা যায় সে। অন্যদিকে মদ্যপ স্বামীর হাতে লাঞ্ছিত হয়ে অসুখী এক জীবন যাপন করতে থাকে করুণা। তবে, করুণার এই অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তখনই যখন সে ধর্মের দিকে তাঁর মনকে ধাবিত করে। তার স্বামী মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, বাকি সন্তানেরাও সুশিক্ষা পেয়ে সভ্যভব্য হয়ে ওঠে।
তবে, খ্রিস্ট ধর্মের মহাত্মা প্রকাশ করুক আর যাই করুক, এই বইতে যে উনবিংশ শতকের সমাজ ব্যবস্থার একটা অন্ধকার দিকে উঠে এসেছে, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। এইসব বইয়ের সামষ্টিক আঘাতেই সমাজ বদলেছে, কুসংস্কার দূরীভ‚ত হয়েছে। সমাজ থেকে বাল্যবিধবা উঠে গিয়েছে, বিধবা বিবাহ চালু হয়েছে। বটতলার সাহিত্য বলে তাই এগুলোকে উপেক্ষার করার সুযোগ নেই। একটা নির্দিষ্ট সময়ে এরা এদের ভ‚মিকা পালন করেছে।