তানজির আহমেদ রাসেল : বৃটেনের বর্ষসেরা চিকিৎসক (জেনারেল প্র্যাকটিশনার অব দ্য ইয়ার) নির্বাচিত হয়েছেন বৃটিশ বাংলাদেশি ডা. ফারজানা হোসেইন। বৃটেনে প্রতিবছর চিকিৎসকদের (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) জন্য এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ও করোনাভাইরাস মহামারিতে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে স্বাস্থ্যসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ বৃটেনের ২০১৯ সালের বর্ষসেরা চিকিৎসক নির্বাচিত হয়েছেন ফারজানা। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) এই ঘোষণা দিয়েছে। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ৭২ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে ফারজানাকে সম্মান জানাতে তার ছবি দিয়ে বিলবোর্ড টাঙানো হয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত পিকাডেলি সার্কাসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়। এ খবর দিয়েছে আইটিভি নিউজ।

পূর্ব লন্ডনের নিউহাম এলাকায় বসবাসকারী ডা. ফারজানা হোসেইন প্রাইমারি কেয়ার নেটওয়ার্কের (পিসিএন) ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। ডা. ফারজানা ও তার টিম করোনা মহামারিতে বৃটেনের রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

তিনি গত ৩ বছর নিউহ্যামের স্থানীয় চিকিৎসা কমিটিতে ছিলেন। সেই সঙ্গে নিউহ্যামের ‘জেনারেল প্র্যাকটিশনার ফেডারেশন’-এর বোর্ড ডিরেক্টরের দায়িত্বও পালন করে আসছেন। এ ছাড়াও তিনি বৃটেনের ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ প্রাইমারি কেয়ার (এনএপিসি)’র কাউন্সিল সদস্য। গত ১৮ বছর ধরে স্থানীয় পর্যায়ে এই খেতাব পেয়ে আসছিলেন। এবার তিনি জাতীয় পর্যায়ে বর্ষসেরা চিকিৎসক মনোনীত হলেন।

বৃটেনের সুপরিচিত ইংরেজি সংবাদ মাধ্যম ইস্টার্ন আইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ডা. ফারজানা জানান, ছোটবেলা থেকেই ঔষধ আর রোগী দেখে দেখেই তিনি বড় হয়েছেন, কারণ তার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, পাঁচ বছর বয়সে বড়দিনে আমি বাবার সঙ্গে যখন হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তখন নার্সরা আমাকে চকলেট দিয়েছিল। আমি বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ওয়ার্ডের রোগী দেখেছিলাম। ফারজানা বলেন, আমি মেডিকেলে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় মা মারা যান। আমি লন্ডনের বাইরে মেডিকেল হোস্টেল থেকে অসুস্থ মাকে দেখতে লন্ডন এসে ফেরত যেতে না চাইলে, মা বলতেন- আমি ঠিক হয়ে যাবো, তোমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। মায়ের চাওয়া ছিল আমি যেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারি। মায়ের মৃত্যু আমাকে কেবল ডাক্তারি পড়তে নয়, রোগীদের সত্যিকারের সেবা প্রদানে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি জানি না, আজ প্রায় দুই দশক পরে এসে আমি মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি কি-না। তবে আমি সব সময় চেষ্টা করি আমি যখন আমার রোগীদের দেখাশোনা করি তখন আমি মনে করি তারা কারও পরিবার।

বৃটেনের আইটিভি’র কাছে এক প্রতিক্রিয়ায়
ডা. ফারজানা বলেন, এটা জীবন পরিবর্তন করার মতো একটি ঘটনা। বিশ্বখ্যাত বৃটিশ ফটোগ্রাফার ‘জন রানকিন’ যারা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, মডেল কেট মসসহ বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের ছবি তুলে থাকে, তার তোলা আমার ছবি আজ বিলবোর্ডে শোভা পাচ্ছে, এটা সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি সমস্ত বৃটেনের চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, যারা এই মহামারির সময় জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করে যাচ্ছে।
ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের জন্মদিন উপলক্ষে তাদের ওয়েবসাইটে ডা. ফারজানার প্রোফাইলের এক জায়গায় তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাপী মহামারিটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিদিন কাজ করতে গিয়ে মানুষের জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য তৈরিতে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি কতটুকু গর্ববোধ করছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই সময় আমাদেরকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেবার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতে হবে।

ডা. ফারজানার বাবা ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বৃত্তি নিয়ে বৃটেনে এনেস্থেটিস্ট হিসেবে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে যান। কিন্তু সে সময় দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বৃত্তি হারান তিনি। ফলে স্ত্রী ও এক বছরের সন্তানকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েন। তখন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে এনেস্থেটিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং সেখান থেকেই অবসর নেন তিনি। উল্লেখ্য, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের বর্ষসেরাদের তালিকায় ডা. ফারজানার সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের সেরা আরো ১১ জনের ছবিও বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে।