ইউসুফ কামাল : প্রবাস জীবনের সুখদুঃখ যেন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে থাকে। সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর আর মনোরম ফুল বাগান (আর সেই বাগানে কেমনে যেন সারা বছরই ওরা ফুল ফোটানোর কৌশল জানে)। কত হরেক রকমের ফুল যে আছে দুনিয়ায়, তার সবই যেন ওরা সব সংগ্রহ করে লাগিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়। আমাদের এলাকার স্বঘোষিত এক বড় পন্ডিত নেতা বলেছিলো চওড়া রাস্তা দিয়ে হাঁটলে নাকি মন বড় হয়, মনের সংকীর্নতা কেটে যায়। বড় সাংঘাতিক কথা। কিন্তু তার নিজের মনের সংকীর্নতা কখনও দূর হয়েছে কিনা তা কখনোই বুঝিনি আমরা। আমি তো অনেকদিন দেশের বাইরে থাকলাম, টু লেন, ফোর লেন, সিক্স লেন দিয়ে চলাফেরা করলাম। গাড়ি চালালাম শত শত মাইল কিন্তু কৈ আমার তো কোন পরিবর্তন হলো না। আগে যা ছিলাম তাই তো আছি একই রকম। বরং মফস্বল শহরের কম চওড়া ইঁটের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই যেন শান্তি পেতাম। বৃষ্টির দিনে স্পঞ্জের স্যান্ডাল পায়ে দিয়ে হাঁটায়, প্যান্টের বা পায়জামার পিছন দিকে কাঁদা ছিটে গায়ের জামা পর্যন্ত ভিজে যেতো, নোংরা হয়ে যেতো। আর এ নিয়ে ‘মা’ এর কত যে বকুনি খেয়েছি, মা বলতেন না ভিজলে হয়তো আরও দু/তিন দিন পোষাকটা চালিয়ে নেওয়া যেত। ‘মা’ এর চিন্তা সাবানের খরচটা একটু বাঁচতো, যা সংসারের জন্য কিছুটা সাশ্রয়ী হতো। এখন বরং মনে হয় ঐ স্বল্প পরিসরের রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই যেন মনের শান্তিটা আরো স্থায়ী হয়।
পাকিস্তান ভারত চির শত্রু দুই দেশ। ভৌগলিক অবস্থান পাশাপাশি হলেও মন এবং চিন্তাধারার অবস্থান একদম বিপরীত মুখি। সেটা ঘটে দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে। ভারত পাকিস্তান খেলা দেখতে গিয়ে দুই দলই মারামারিতে লিপ্ত হয় এও আমরা দেখি হর হামেশাই। কেটির ফ্রেডরিক রোডের ৯ নং বাড়ির বাসিন্দা ফারুখ, লাহোরের সন্তান অপরজন শেহনাজ ভারতের ভ‚পালের সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা।
কেটিতে থাকা অবস্থায় আমাদের ও ওদের মধ্যে পারিবারিক স¤প্রীতি গড়ে ওঠে। ছোট্ট একটা লেক একদিকে আমরা আর সোজোসুজি বিপরীতে দিকেই শেহনাজরা থাকে। এখনো সন্তানাদি আসেনি ওদের পরিবারে তবে শেহনাজের অ্যাডভ্যাঞ্জ ষ্টেজ চলছে। ম্যাটারনিটি লীভে আছে, যে কোন সময়ে সুসংবাদের প্রতিক্ষায় আমরা। ওদের বাবা মা’র ভিসার আবেদন করা হয়েছে আসন্ন নাতি নাতনীর মুখ দেখবার জন্য। অন্তত আমেরিকান সরকার নাগরিকদের এই সুবিধাটা থেকে বঞ্চিত করে না, এটা এদের বিরাট মহানুভবতা। ওরা দুজনই হিউষ্টন মেথিডিষ্ট হাসপাতালে চাকুরী করে। শেহনাজ হাসপাতালের রিশেপশনিষ্ট হিসাবে কর্মরত আর ফারুখ প্যাথলজিষ্ট।
বাসা থেকে হাসপাতাল ২৫ মিনিটের পথ। ডিউটি বেশির ভাগ সময় এক সাথেই হওয়ায় সুবিধা বেশি। এক সাথেই যাওয়া আসা করতে পারে। ওদের সাথে আমাদের আরো বেশি অন্তরঙ্গতা হয়েছিলো আমার ঐ হাসপাতালে রেডিয়েশন জনিত চিকিৎসা নেওয়ার সময়ে। অসম্ভব সহযোগীতা করেছিল দুজনে মিলে মিশে। লেকের পানিতে ফারুখ কম পাওয়ারের ছোট্ট একটা মোটর বোট নামিয়েছে, বিকেলে বোটিং করার সময় দু’জনের সংগে দু একজন গেষ্টও জুটিয়ে নেয় নিছক ফান করার জন্য। বয়সে তরুণ বলেই নয়, মনে প্রাণেও সে যথেষ্ট উদারমনা। একদিন সকাল দশ’টা নাগাদ আমার স্ত্রীর জরুরি ডাকে নীচে নেমে এলাম, মনে হলে খুব জরুরি কিছু কাজ পরেছে। বুঝলাম শেহনাজকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে এখুনি, খুবই লজ্জা ইমার্জেন্সি। দেরী করা যাবে না।
আমার গাড়ি নিয়ে স্ত্রীসহ শেহনাজকে নিয়ে ছুটলাম। পরে ভাবলাম সেটা না করলেও চলতো, কিন্তু বাঙালি বলেই হয়তো আমাদের অস্থি মজ্জায় এই মমতাগুলো গ্রোথিত। ৯১১ এ এ্যাম্বুলেন্স ডাকলেও সেটা চলে আসতো কিন্তু সেটার অপেক্ষা না করেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে হাসপাতালের গেটে দেখি উদ্বিগ্ন চিত্তে ফারুখ দাঁড়িয়ে আছে। এ্যাটেডেন্টরা ত্বরিত গতিতে শেহনাজকে খুব সাবধানে স্ট্রেচারে করে ভিতরে নিয়ে গেল। কাজটা করতে পেরে যেন বড় একটা কাজ করতে পেরেছি ভেবে মনে বড় একটা আত্ম সুখ উপলদ্ধি করলাম। জীবনের কিছু কাজ একটা মানুষের জীবনের জন্য চির স্মরণীয় হয়ে থাকে, সারা জিবনের জন্য যা ভোলার নয়।
শেহনাজের মুখের মধ্যে আমি যেন নিজেরই আত্মজকে খুঁজে পেয়েছিলাম ঐ মুহূর্তে, সারা রাস্তা দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে হাসপাতালের গেট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, দুই শত্রু ভাবাপন্ন দেশের মানুষ বিদেশে এসে কেমন আপন হয়ে যায়। পরম বন্ধু, এমনকি স্বামী স্ত্রীর মত পরম আত্মীয় পর্যন্ত হয়ে যায়। দেশে একচেহারা আর বিদেশে ভিন্ন চেহারার কারণ কি? এটাকে কি ডাবল ষ্টান্ডার্ড বলবো নাকি বিদেশে এলে মানুষের মনের বিকাশ বলবো?
মহান আল্লাহ্ তায়ালা তো সব মানুষকেই সৃষ্টি করেছেন তাহলে কেন এই বিভক্তিময় চরিত্র দু জাতির মধ্যে এর সদুত্তর মোটামুটি কারো কাছেই পাওয়া যায় না। তবে আমার মনে হয় সভ্য ও শিক্ষিত সমাজে ধর্মীয় কুসংস্করতা এক প্রকার নাই বল্লেই চলে। সেখানে মানবতাই বড় ধর্ম বলে মনে হয়।
ভেবেছিলাম আল্লাহ আমাকে এক মহান দায়িত্বের মধ্য দিয়ে যেন আমাকে পরীক্ষা করলেন। সব কিছুই সুষ্ঠভাবে শেষ হবার পর মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছি বলেছিলাম, মহান আল্লাহ্ তুমিই সব কিছুর রক্ষা কর্তা। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, লালমাটিয়া, ঢাকা